ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সারতাজ আলীম

ভালবাসায় সর্বস্ব উজাড় করার গল্প ॥ কেয়ার ফর পজ

প্রকাশিত: ১২:২১, ২৩ এপ্রিল ২০১৯

ভালবাসায় সর্বস্ব উজাড় করার গল্প ॥ কেয়ার ফর পজ

ঘটনা- ১ এক দম্পতির অনেক শখের দুটি কুকুর। কিছুদিন আগে মালিক দম্পতির মৃত্যুতে শোকে কাতর কুকুর দুটো ভাবতেও পারছিল না তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। কুকুর দুটোর দেখাশোনা করার জন্য মাসে বেশ ভাল একটা অঙ্ক খরচ করতে হয়। মানুষের দায়িত্বই যেখানে কেউ নিতে চায় না সেখানে অবলা প্রাণী দুটির দায়িত্ব কে নেবে? যেখানে মুখ ফুটে কিছু চাইতেই পারে না তারা। সিদ্ধান্ত হয় কুকুর দুটিকে মেরে ফেলা হবে। খবরটি কানে আসে পশুদের সুরক্ষায় কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। শেষ পর্যন্ত তাদের নির্মিত কেরানীগঞ্জের প্রাণী শেল্টার বা অভয়ারণ্যে স্থান পায় কুকুর দুটি। ঘটনা- ২ ফেসবুকের একটি পোস্টের মাধ্যমে জানা গেল চিল বিক্রি করছে একজন। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বিক্রয়কারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে সংগঠনটির কর্মীরা। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী দুটি মুক্ত হয় খোলা আকাশে। প্রাণীদের জন্য ভালবাসার পৃথিবী সৃষ্টিকরা এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নামে কেয়ার ফর পজ। শুরুটা ২০১২ সাল থেকে। সৌরভ শামিমের আদরের কুকুর অসুস্থ হয়ে মারা যায়। প্রাণীদের চিকিৎসক কোথায় আছে আর অর্থাভাব, সবমিলেই কুকুরটির চিকিৎসা করা হয়ে উঠে না। এরপরই সৌরভ, জাহিদ, কোহিনূর, মাহিনুর পণ করেন আর কোন প্রাণীকে তারা কষ্ট পেতে দেবেন না। সেই সংকল্প থেকেই যাত্রা শুরু তাদের। তারা খুঁজে বের করেন তাদের মতো আরও কয়েকজন প্রাণীপ্রেমীকে। প্রাণীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, পোষা প্রাণী পালনের দিকনির্দেশনা তৈরি, অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসা, প্রাণীদের উদ্ধারের পাশাপাশি প্রাণীদের অধিকার খর্ব হচ্ছে এমন কাজে বাধা প্রদানের মতো কাজগুলো তারা করতে শুরু করেন। রাজধানীর বসিলাতে ছোট একটি জায়গায় চলতো তাদের ক্লিনিক এবং অভয়ারণ্য। শুরুর দিকের সময়টা খুব কঠিন ছিল। প্রাণীদের নিয়ে কাজ করায় কটুকথাও শুনতে হয়েছে। তাদের উত্তর খুবই সহজ। হয়ত ক্ষুধা লেগেছে প্রাণীটির, কিন্তু মানুষের মতো চাইতে পারে না বা ছিনিয়ে নিতেও জানে না। হাজারটা বিপত্তি শেষ করে ২০১৭ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত হয় তারা। বর্তমানে বসিলা ছেড়ে আরও বড় জায়গা নিয়ে কেরানীগঞ্জে করা হয়েছে প্রাণীদের আশ্রয়কেন্দ্র। যোগাযোগের সুবিধার জন্য ঢাকার জিগাতলায় নিয়ে আসা হয় চিকিৎসাকেন্দ্র। এরইমধ্যে গাজীপুরে ১০ কাঠা জমিও নিয়েছে কেয়ার ফর পজ। প্রাণীদের জন্য ভালবাসার স্বর্গ তৈরি হবে সেখানে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও কাজ করছে কেয়ার ফর পজ। কীভাবে কাজ করে এই সংগঠন প্রাণী কল্যাণে নিয়োজিত কেয়ার ফর পজ মূলত ৪ ধরনের কাজ করে। রাস্তার বেওয়ারিশ কোন প্রাণীর মেডিক্যাল সহায়তা; এ ধরনের খবর পাওয়া মাত্রই দলের সদস্যরা ছুটে যান। প্রাণীটিকে এনে চিকিৎসা দেয়া হয় তাদের ক্লিনিকে। পরে ফেসবুক গ্রুপ থেকে প্রাণীটির লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রাণীপ্রেমী মানুষেরা। দীর্ঘদিন রেখে চিকিৎসা করতে হয় বা গুরুতর অসুস্থ প্রাণীর ( যেমনÑ একটি বা দুটি পা কাটা পড়া অথবা চোখ উপড়েপড়া বা টিউমার) ঠিকানা হয় তাদের শেল্টারে। সুস্থ হলে প্রাণীটির জন্য সুব্যবস্থার চেষ্টাও থাকে তাদের। দ্বিতীয়ত বেওয়ারিশ কুকুরদের টিকা দেয়া। তৃতীয়ত আটকে পড়া প্রাণীদের উদ্ধার করা। এই কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিপদগ্রস্ত প্রাণীরা স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত থাকে। এদিকসেদিক হলেই মৃত্যু ঘটতে পারে। জাপান গার্ডেন সিটিতে কংক্রিটের ঢালাইয়ের নিচে আটকে পড়া বিড়াল ছানা বা সরু নালায় পড়ে যাওয়া কুকুর। কোথাও কোন প্রাণী আটকা পড়েছে শুনলেই উদ্ধারের জন্য ছুটে যায় দলটি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ প্রাণীকে উদ্ধার সম্ভব হয়েছে তাদের প্রচেষ্টায়। সবশেষে প্রাণীদের সুরক্ষা প্রদান। অদ্ভুত বিষয় হলো দয়ামায়াহীন কিছু মানুষই প্রাণীদের অন্যতম শত্রু। অবলা প্রাণীর উপর নির্যাতন, বন্যপ্রাণী বিক্রি প্রতিরোধে সরাসরি ঘটনা স্থলে ছুটে যায় স্বেচ্ছাসেবীরা। বিগত কয়েকবছরে এ রকম অন্তত ৫০টি স্থানে হাজির হয়ে প্রাণীদের বিরুদ্ধে বর্বরতা প্রতিহত করেছেন তারা। সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে এক তরুণীর বিড়ালছানা হত্যা নিয়েও সোচ্চার ছিল তারা। রামপুরায় ১৪টি কুকুরছানা হত্যা করে মাটিচাপা দেয়ার ঘটনায় তাদের উদ্যোগেই মামলা হয়। এছাড়াও প্রাণীদের অধিকার নিয়ে সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন কার্যক্রম আছেই। অনেকেই মনে করে থাকেন কুকুর-বিড়াল নিয়েই বুঝি তাদের কারবার। কিন্তু না, যে কোন প্রাণী সেটা পাখি হোক বা হিংস্র প্রাণী সবাইকেই সমান গুরুত্ব দেয়া হয়। এমন কি অসুস্থ এক ঘোড়াকে নিয়ে এসেছিল দলটি। অসুস্থ হওয়ায় মালিক তাকে পরিত্যাগ করেছিল। এর বাইরেও তাদের ক্লিনিকে শখের এবং আদরের প্রাণীর টিকা, প্রতিষেধকের জন্য ছুটে আসেন অনেকেই। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৩৫টি প্রাণীর চিকিৎসা হয় জিগাতলার ক্লিনিকে। এসব কিছুতেই বড় ভূমিকা রাখছে কেয়ার ফর পজের ফেসবুক গ্রুপটি। এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার সদস্যের এই গ্রুপে প্রতিদিন ১৫-২০টি বিড়াল এবং ৭-১০টি কুকুর দত্তক নিচ্ছেন প্রাণীপ্রেমীরা। প্রাণী উদ্ধার করা নিয়ে হোক বা নিজ সন্তানের মতো পালন করা প্রাণীটিকে কীভাবে যতœ করা হয় জানাতে গ্রুপে পোস্ট দিচ্ছেন অনেকেই। অভিজ্ঞরা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা সাধ্যমতো পরামর্শ দিচ্ছেন মানুষকে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে সৌরভ শামিম বলেন, ‘আমরা প্রতিটা জেলায় পশু হাসপাতাল করতে চাই যাতে ২৪ ঘণ্টা সেবা এবং টিকা-বন্ধ্যত্বকরণের ব্যবস্থা থাকবে। জেলাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার কাজ করতে চাই। মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাই ওদেরও প্রাণ আছে। আঘাতে ওরাও কষ্ট পায়। বাংলাদেশকে আমরা একটি ‘অহরসধষ-ভৎরবহফষু’ দেশ হিসেবে দেখতে চাই। তাছাড়াও আমাদের প্রাণী অধিকার আইন আরও শক্ত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এটা শক্ত হলে নিষ্ঠুরতা কমবে।’ কেরানীগঞ্জের অভয়ারণ্যে এখনও ১১০টির বেশি প্রাণী আছে। সব মিলিয়ে মাসে ৩ লাখের বেশি খরচ। খরচের বড় অংশটাই যায় প্রাণীদের খাবারের পেছনে, বাকিটা স্থায়ী স্টাফদের বেতন। প্রাণীদের ভালবেসে যাওয়া মানুষের সমর্থনে চলছে এই সংগঠনটি। অনুদান আসলেও সেটা অপ্রতুল। মাত্র এক-ষষ্ঠমাংশ অর্থ জোগাড় হয় অনুদান থেকে। কথা বলে জানা গেল ভাড়া করা জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত অভয়ারণ্যটি। গত ৭ মাসের ভাড়া অর্থাভাবে পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তবে তাই বলে কি কাজ থেমে থাকবে? আর্থিকভাবে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়লেও কাজ থেমে নেই। উদ্যোক্তা সৌরভ শামিম ভালবাসার প্রাণীদের সেবার অর্থ জোগাতে নিজের বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৌরভ একজন ব্যবসায়ী, আরেক উদ্যোক্তা জাহিদ পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। সাত সমুদ্রের ওপারে থাকলেও ফেসবুকের মাধ্যমে কাজের সমন্বয় করেন তিনি। অন্যদের মধ্যে কামাল, নাবিলা, কোহিনূর, রাবিতা, মাহিনুর, সাকতাহ, নিহাদ, সাইমন, ওয়াহিদ, আয়াজ, আবু হাসান, আজমী, তিথি, সাজ্জাদ, রূপন্তী, আয়েশার কথা না বললেই নয়। সব মিলিয়ে ২০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক আছে দলটির। বাকিরাও নানা পেশায় নিয়োজিত। এর বাইরে নিয়মিত না হলেও ছুটির দিন বা নিজের সময় থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে প্রাণীদের ভালবাসার টানে ছুটে যাচ্ছেন অনেকেই। শেল্টারে থাকা প্রাণীগুলো মানুষের কাছে কষ্ট পেয়েও শেল্টারে আসা মানুষগুলোকে বিশ্বাস করে, ভালবাসা চায়। ওদের মায়া ভরা চাহনিতে বাড়তি কোন চাওয়া নেই। তারা শুধু যেন একটু ভালভাবে বাঁচতে চায়। অবলা প্রাণীগুলো যেন কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুলে না। নির্বাক প্রাণীরা একটু ভালবাসা পাক ছোট্ট এই পৃথিবীতে। কেয়ার ফর পজের ফেসবুক গ্রুপ www.facebook.com/ groups/ CareForPawsBD
×