ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহ্যের পুতুলনাচ- বিশ্বে বাঙালীর সংস্কৃতি মর্যাদার আসনে

প্রকাশিত: ১১:০৭, ২৩ এপ্রিল ২০১৯

ঐতিহ্যের পুতুলনাচ- বিশ্বে বাঙালীর সংস্কৃতি মর্যাদার আসনে

সমুদ্র হক ॥ দশ আঙ্গুলে ছয় সুতার কৌশলী টানে নৃত্যের ছন্দে বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুতুলনাচ। মঞ্চে ছোট্ট পুতুলনাচের তালে কথা কইছে, পুতুল পরী উড়ে উড়ে গল্প শোনাচ্ছে। মঞ্চের একধারে ঢুলি তাকধিন তাকধিন তাল তুলেছে। হারমোনিয়ামে সুর তুলেছে আরেকজন। এভাবে কোন পুতুল চান মিয়ার সুখী পরিবার, কোন পুতুল নানি-নাতির গল্প বালিকার বিয়ে দিতে নিষেধ করছে। কোন পরী পুতুল মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার বায়না ধরেছে। এ ছাড়াও বাঙালীর সংস্কৃতি গ্রামীণ জীবন পৌরাণিক উপাখ্যানসহ নানা কিছু উঠে আসছে। নিকট অতীতে যা ছিল শুধুই বিনোদন বর্তমানে পুতুলনাচে বিনোদনের মাধ্যমে তথ্য, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ তুলে আনা হয়েছে সরকারের উন্নয়নের প্রচার কার্যক্রমে। পুতুলনাচ প্রাচীন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। শিশুদের চিরকালীন সঙ্গী পুতুল। যে কারণে শিশুদের শিক্ষার শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে পুতুল নাট্যকে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাভা দ্বীপপুঞ্জে পরিভ্রমণকালে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে পুতুলনাচ সম্পর্কে বলেছেন ‘এ যেন মহাভারত শিক্ষার ক্লাসে পাঠের সঙ্গে ছবির (পুতুল) অভিনয় মনে মুদ্রিত করে দেয়’। বিশে^র নাট্যতাত্ত্বিক গর্ডন ক্রেইম বলেছেন, নৃত্য হলো মানুষের আবেগ প্রকাশের অন্যতম বাহন। ভাষা সৃষ্টির আগে মানুষ নাচের মাধ্যমে ভাবের আদান প্রদান করত। ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকায় বলা হয়েছে ‘পাপেটস ক্যান প্রোভাইড এ ডিগ্রী অব এ্যাবসট্রেট্রেন এ্যান্ড স্টাইলিসেশন আন এ্যাটেইনেবল বাই হিউমেন এ্যাক্টর’। বাংলাদেশের বরেণ্যশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম পুতুলনাচকে পাপেট শোর মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। পাপেট- পাপেট্রি এক ধরনের এ্যানিমেশন। কার্টুন আঁকার পর ক্যামেরার মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পুতুলনাচ ক্যামেরার বদলে মানুষ ৩ থেকে দশ সুতায় গল্পের ধারাবাহিকতায় গতি নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে বিশ^জুড়ে কার্টুন পাপেট পরিবেশনার একটি ধারা। বাংলাদেশের পুতুলনাচের ধারা আজ বিশে^ সমাদৃত। বাংলাদেশে পুতুলনাচের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিতাস ও মেঘনা নদীর তীরের কয়েকটি গ্রামে একটা সময় পাল সম্প্রদায় মূর্তি বানানোর পর ফেলে দেয়া মাটিতে ছোট পুতুল বানাতো। ছোট্ট এই পুতুলগুলোকে কাপড় ও ফ্রক পরিয়ে সাজিয়ে সুতায় বেঁধে ওপর থেকে সুতার কৌশলি নড়াচড়ায় গল্পের বর্ণনায় নাচানো হতো। পরবর্তী সময়ে মাটির পুতুলের চেয়ে কাঠের পুতুলের নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। আরও পরে শোলার পুতুলকে খুব সহজে ইচ্ছেমতো নাচানো যায়। বর্তমানের পুতুলনাচে শোলার পুতুলকেই নানা বর্ণে, নানা আঙ্গিকে সাজিয়ে মঞ্চে নাচানো হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রয়েল বীণা। প্রতিষ্ঠিত করেন ধন মিয়া। তিনি গত হওয়ার পর তার ছেলে শামীম মিয়া (৩২) দলকে আরও সমৃদ্ধ করেন। ১৮ পুতুল দিয়ে যাত্রা শুরু এই দলের বর্তমানে পুতুলের সংখ্যা বাড়িয়ে গল্পের ধরন অনুযায়ী কাপড় অলঙ্কার টোপর ইত্যাদি পরিয়ে সূক্ষ্ম তার ও সুতার কৌশলে নাচানো হয়। রয়েল বীণা দলে আছেন কথক শিল্পী হাবিবুর রহমান। তিনি হারমোনিয়ামের সুরের সঙ্গে গল্প বলেন। পাশে ঢুলি সন্তোষ দাস ঢোল বাজিয়ে নাচের ছন্দের তালে সঙ্গত দেন। এই দলে মোট সদস্য ৮ জন। রয়েল বীণা দল গত ক’বছর ধরে বগুড়ার বৈশাখীমেলায় পুতুলনাচ নিয়ে আসছেন। বললেন পরিচ্ছন্ন পুতুলনাচে দেশের সকল উন্নয়নের বর্ণনা দেয়া যায় বিনোদনের মাধ্যমে। বর্তমানে পুতুলকে পরীর পোশাকে নান্দনিকভাবে যে কথামালায় নাচানো হচ্ছে তা দর্শকনন্দিত হয়েছে। এই দল রাশিয়ার তাসখন্দে পাপেট থিয়েটারে অংশগ্রহণ করে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। পুতুলনাচকে ঐতিহ্যের আসনে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নানা কার্যক্রম শুরু করেছে। গত বছর পুতুল নাট্য র্মিপ উন্নয়ন নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এর আগে ৫টি পুতুল নাট্য উৎসব করেছে। ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ মার্চ বিশ^ পুতুল নাট্য দিবসে অংশ নিচ্ছে। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলাদেশের পুতুলনাচের গল্প ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভালে পুরস্কৃত হয় রয়েল বীণা দল। পরবর্তী বছরে ২০১৪ সালে সাতক্ষীরার একটি নারী পুতুল নৃত্যদল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিশ^ পুতুল নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণ করে পুরস্কৃত হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে থাইল্যান্ড হারমনি ওয়ার্ল্ড পাপেট ফিচারে ১২ সদস্যের পুতুল নাট্যদল অংশ নেয়। মঞ্চসজ্জা পুতুলের সুতার টানের দক্ষতার সঙ্গে জসিমউদদীনের টুনটুনি, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর গল্প নাককাটা রাজা গল্পের পুতুল নৃত্য বিপুল প্রশংসিত হয়। সেই আয়োজনে ৩০ দেশের ৬০ আঞ্চলিক বিষয় ঢংয়ে পরিবেশিত বাংলাদেশের উপস্থাপন ছিল বিশ^ মঞ্চে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। গত বছর থাইল্যান্ডের ফুকেটে অনুষ্ঠিত হারমনি ওয়ার্ল্ড পাপেট ফেস্টিভ্যালে অংশ নেয় মুস্তাফা মনোয়ারের মাল্টিমিডিয়া পাপেট থিয়েটার। উৎসবে প্রদর্শিত তার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় গল্প ছিল হাতুড়ে ডাক্তার ও রেড়া। যা পুরস্কৃত হয়। এভাবে বাংলাদেশের পুতুলনাচ লোকনাট্যের প্রাচীন মাধ্যম হয়ে বাঙালীর ঐতিহ্যের সংস্কৃতিকে বিশে^ মর্যাদায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পুতুল নাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র পাপেট থিয়েটার রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপিত হয়েছে ২০১৬ সালে। আনন্দ ও বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা, তথ্য প্রচার ও গণসচেতনতা গড়ে তুলতে বাংলাদেশের পুতুলনাচের ধারাকেই বিশ^ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কল্যাণমুখী প্রচারে পুতুলনাচকে গ্রহণ করে মাঠ পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
×