ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জরুরী অবস্থা জারি ;###;বোমা হামলার দায় স্বীকার জঙ্গী গোষ্ঠীর ;###;নিহতের সংখ্যা ২৯০ ;###;শ্রীলঙ্কায় আজ জাতীয় শোক দিবস

শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলা ॥ টার্গেট গির্জা ও পাঁচতারা হোটেল

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৩ এপ্রিল ২০১৯

শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলা ॥ টার্গেট গির্জা ও পাঁচতারা হোটেল

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় রবিবার কয়েকটি গির্জা ও হোটেলে একযোগে চালানো আত্মঘাতী হামলায় নিহতের সংখ্যা ২৯০ ছাড়িয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫শ’। নিহতদের মধ্যে ৩৫ জন বিদেশী রয়েছেন। রবিবার খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের ইস্টার সানডে উদযাপনকালে রাজধানী কলম্বো ও তার আশপাশের তিন গির্জা এবং তিন হোটেলে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সোমবার ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত নামে একটি অখ্যাত গ্রুপ হামলার দায় স্বীকার করেছে। সোমবার রাত থেকে দেশটিতে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। নৃশংস এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। আজ মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কায় জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে।খবর বিবিসি, গার্ডিয়ান, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের। রবিবার খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের ইস্টার সানডে উদযাপনকালে রাজধানী কলম্বো ও আশপাশের তিন গির্জা এবং তিন হোটেলে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কোন গোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে সোমবার ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত নামে একটি অখ্যাত গ্রুপ হামলার দায় স্বীকার করে। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুয়ান বিজয়বর্ধনে বলেছেন, অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৪ জনকে। তবে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। তারা সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক বলে জানা গেছে। বিজয়বর্ধনে বলেন, ‘হামলায় নিহতদের মধ্যে ৩৫ জন বিদেশীও রয়েছেন। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমাদের বিশ্বাস এই সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত সব অপরাধীকে দ্রুত গ্রেফতার করা হবে। তাদের শনাক্ত করা হয়েছে।’ গতবছর একটি বৌদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে উগ্রপন্থী সংগঠন ন্যাশনাল তাওহীদ জামাতের নাম খবরে এসেছিল। মন্ত্রিসভার মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজিথা সেনারতেœ বলেছেন, রবিবারের হামলার পেছনে ‘ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত’ নামে শ্রীলঙ্কার একটি উগ্রপন্থী মুসলিম সংগঠন রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। তবে কেবল স্থানীয় কোন একটি গ্রুপের পক্ষে এত ব্যাপক মাত্রায় সমন্বিত হামলা চালনো সম্ভব বলে মনে করেন না রাজিথা সেনারতেœ। তার বিশ্বাস, কোন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক এর পেছনে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনার দফতর জানিয়েছে, একটি বিদেশী সন্ত্রাসী গ্রুপের সহায়তায় হামলা হতে পারে, সে বিষয়ে দুই সপ্তাহ আগেই সতর্ক করেছিল এক বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা। তাই তদন্তের ক্ষেত্রে বিদেশী সরকারগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হবে। তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে হামলায় অংশ নেয় মোট সাত আত্মঘাতী হামলাকারী। এর মধ্যে সাংরি-লা হোটেলে দুইজন হামলাকারী নিজেদের উড়িয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছ থেকে হোমমেড একটি বোমা উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। রবিবার রাতে বিমানবন্দরের প্রধান টার্মিনালমুখী সড়কে ওই পাইপবোমাটি পাওয়া যায়। পরে বিমানবাহিনী সেটি নিষ্ক্রিয় করে বলে সোমবার জানিয়েছে পুলিশ। শ্রীলঙ্কার বিমানবাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ছয় ফুট লম্বা ওই পাইপবোমাটি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একের পর এক বিস্ফোরণে গির্জা ও অভিজাত হোটেলগুলো কেঁপে উঠেছে। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় ভয়াবহ বোমা হামলা ভারত মহাসাগরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপরাষ্ট্রটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। বোমা হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ক্যাথলিক খ্রীস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। ইস্টার সানডের ভাষণে তিনি এ হামলাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর সহিংসতা বলে নিন্দা জানান। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে এক জনসভায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষের উদ্দেশে ভাষণে ফ্রান্সিস বলেন, ‘আমি এই ভয়ঙ্কর হামলার খবর শুনে খুবই মর্মাহত। বিশেষ করে আজকের এই ইস্টারের দিনে এ হামলা গির্জাসহ অন্য স্থানগুলোতে সমবেত মানুষদের জন্য যে শোক এবং বেদনা বয়ে এনেছে তা খুবই দুঃখজনক।’ পোপ তার ভাষণে বলেনম ‘আমি প্রার্থনার জন্য জড়ো হওয়ার সময় এমন নিষ্ঠুর সহিংসতার শিকার হওয়া খ্রীস্টান সম্প্রদায় ও অন্যদের প্রতি আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা প্রকাশ করছি।’ সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার ব্যালকনি থেকে কথা বলার সময় পোপ বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে শান্তির জন্য আহ্বান জানান। তিনি রাজনীতিবিদদেরও নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা পরিহার করার আহ্বান জানান এবং ক্ষুধা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘনের মুখে বিভিন্ন দেশ থেকে পালাতে থাকা শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর আহ্বান জানান। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল সোমবার মধ্যরাত থেকে জরুরী অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করার অনেক বেশি ক্ষমতা পাবে। তবে এক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না বলে কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছে। কলম্বোতে সোমবার টানা দ্বিতীয় রাতের মতো কারফিউ বলবত থাকে। রাত ৮টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত এই কারফিউ কার্যকর ছিল। কলম্বোর কোচিচিকাদের সেন্ট এ্যান্টনি চার্চে প্রথম বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। দ্বিতীয় হামলা হয় কুতুয়াপিটায়ের সেন্ট সেবাস্তিয়ান চার্চে। তৃতীয় বিস্ফোরণ ঘটে নেগোম্বো শহরের বাত্তিকালোয়া চার্চে। এছাড়া কলম্বোর তিন পাঁচতারকা হোটেলেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে ইস্টার সানডের অনুষ্ঠান চলার মধ্যে এসব হামলা হয়। শুধু নেগোম্বোতেই বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে। ঠিক কী কারণে কারা এ হামলা চালিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। শ্রীলঙ্কা মূলত বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশটির ছয় শতাংশ মানুষ ক্যাথলিক খ্রীস্টান। জনগোষ্ঠী মূলত তামিল ও সিংহলী এই দুই জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একটি স্বাধীন পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশটিতে প্রায় তিন দশক গৃহযুদ্ধ চালিয়েছে তামিলরা। এক দশক আগে ওই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর দেশটিতে বিক্ষিপ্ত সহিংস ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হয়নি। গতবছর মার্চে বৌদ্ধরা মুসলিমদের মসজিদ ও সম্পত্তিতে হামলা শুরু করলে স্বল্প সময়ের জন্য জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিল। এদিকে উত্তেজনা ও গুজব ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রাখার পাশাপাশি দুইদিনের জন্য সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপসহ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা পাঠানোর এ্যাপস দেশটিতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যাতে করে ভুল তথ্য ও গুজব ছড়ানো রোধ করা যায়। শ্রীলঙ্কার বোমা হামলাকারীদের ভারতে প্রবেশের চেষ্টা আটকে দিতে সমুদ্র সীমান্তে ভারতীয় কোস্ট গার্ডকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িতরা সমুদ্র পথে দ্বীপ দেশটি থেকে পালাতে পারে, এমন শঙ্কায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। হামলার মাত্র ১০ দিন আগে দেশটির পুলিশ প্রধান এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। রাজধানী কলম্বোয় ভারতীয় হাইকমিশনেও আগাম সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান পুজুথ জয়সুন্দর ১১ এপ্রিল দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে গোয়েন্দা একটি সতর্কবার্তা পাঠান। ওই সতর্ক বার্তায় বলা হয়, ‘একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত (এনটিজে) নামের একটি সংগঠন বিখ্যাত গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী হামলার ষড়যন্ত্র করছে। কলম্বোর ভারতীয় হাইকমিশনেও হামলা হতে পারে।’ এদিকে দেশটিতে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় ডেনমার্কের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এ্যান্ডার হলচ পাভলসেন ও তার স্ত্রী তাদের তিন সন্তানকে হারিয়েছেন। রবিবার ইস্টার সানডের পরবের দিন দেশটিতে চালানো বোমা হামলায় তাদের চার সন্তানের মধ্যে তিন জন নিহত হন বলে সোমবার পাভলসেনের ফ্যাশন ফার্মের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন। তারা কোথায় ও কখন নিহত হয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে ওই মুখপাত্র অপারগতা জানিয়েছেন। তিনি পাভলসেন পরিবারের প্রাইভেসির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। ড্যানিশ গণমাধ্যম জানিয়েছে, পাভলসেন পরিবার ছুটি কাটাতে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন। চারদিন আগে তাদের এক সন্তান ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন, ওই ছবিতে তাদের অবস্থান শ্রীলঙ্কায় বলে জানানো হয়। ৪৬ বছর বয়সী পাভলসেন ক্লথিং চেইন ‘বেস্টসেলার’ এর মালিক এবং জনপ্রিয় অনলাইন খুচরা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান এএসওএস এর সবচেয়ে বড় অংশীদার। রবিবার সিরিজ বোমা হামলায় বিধ্বস্ত সেন্ট এ্যান্টনি চার্চের কাছ থেকে সোমবার নতুন বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর একটি নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট বোমাটি নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চালানোর সময় তা বিস্ফোরিত হয়। নতুন করে বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে লোকজন এদিক সেদিক ছুটোছুটি শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অনুযায়ী, বিশেষ টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) ও বিমানবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট যখন বোমাটি নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছিল, তখন গাড়িটি বিস্ফোরিত হয়। পুলিশ জানিয়েছে, গাড়িটি হামলাকারীদের ছিল। সোমবার দেশটির প্রধান বাস স্টেশন থেকে ৮৭টি বোমার ডিটোনেটর উদ্ধার করেছে শ্রীলঙ্কার পুলিশ। রাজধানী কলম্বোর ওই বাস স্টেশনে অভিযান চালিয়ে এই ডিটোনেটরগুলো উদ্ধার করা হয়। সিরিজ বিস্ফোরণের ঘটনায় আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা। কলম্বোয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এমন শঙ্কার কথা জানান দেশটির মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রাজিথা সেনারতœ। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি না যে, এই হামলাগুলো শুধু দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ একটি গোষ্ঠী চালিয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এসব হামলা সফল হতে পারত না।’ হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাও জানিয়েছেন রাজিথা সেনারতœ। তিনি জানান, মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিহতদের সবার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য এক লাখ রুপী করে দেয়া হবে। আহতরাও ক্ষতিপূরণ পাবেন। বোমার আঘাতে জর্জরিত গির্জা মেরামতের জন্য সরকারীভাবে তহবিল দেয়া হবে। শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণে সোমবার মধ্যরাত থেকে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের বাতি নিভিয়ে দেয়া হবে। বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য অন্ধকার রেখে সম্মান জানানো হবে হামলায় হতাহতদের প্রতি। এক টুইটে আইফেল টাওয়ার কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘আজ রাত ১২টায় আমরা সকল বাতি নিভিয়ে শ্রীলঙ্কা হামলায় হতাহতদের প্রতি সম্মান জানাব। এর আগে ২০১৭ সালে ম্যানচেস্টারে আরিয়ানা গ্রান্দ্রের কনসার্টে বোমা হামলায় ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় আইফেল টাওয়ার অন্ধকার রাখা হয়েছিল। একই পদক্ষেপ নেয়া হয় শার্লে এবদো ম্যাগাজিনে হামলার ঘটনার পরও। স্বজন হারানো টিউলিপের টুইট ॥ শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় স্বজন হারানোর খবর জানিয়ে একটি টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। রবিবার ওই টুইটার পোস্টে স্বজন হারানোর কথা জানিয়ে শোক প্রকাশ করেন তিনি। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার জনগণের প্রতিও একাত্মতা জানিয়েছেন টিউলিপ। রবিবারের ওই হামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি জায়ান চৌধুরী নিহত হয়েছে। তার বাবা মশিউল হক গুরুতর আহত অবস্থায় কলম্বোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। টুইটার পোস্টে টিউলিপ লিখেছেন, ‘শ্রীলঙ্কায় সংঘটিত হামলায় আমি আজ এক স্বজনকে হারিয়েছি। এটি খুবই বিধ্বংসী ছিল। আশা করি সবাই নিরাপদ থাকবেন। শ্রীলঙ্কার জনগণের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করছি।’ উল্লেখ্য, শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পর্কে টিউলিপের মামা হন। মায়ের ফুফা তো ভাই তিনি। শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওই হামলায় নিহতদের মধ্যে তিনজনের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব এবং দুইজনের মার্কিন ও ব্রিটিশ দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতর থেকে ব্রিটিশ নাগরিক নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করা হলেও সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন তামিল অভিনেত্রী রাধিকা ॥ অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বিখ্যাত তামিল অভিনেত্রী রাধিকা শরতকুমার। তিনিও সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে ছিলেন। বোমা হামলার সামান্য আগেই তিনি বেরিয়ে পড়েন সেখান থেকে। খবর ওয়েবসাইটের। এ বিষয়ে ১৪ লাখ টুইটার অনুসারীর কাছে তিনি লিখেছেন, আমি কলম্বোর সিনামন গ্র্যান্ড হোটেল ত্যাগ করার পর পরই সেখানে বোমা হামলা হয়েছে। এই ভয়াবহতা বিশ্বাস করতে পারছি না। এ নিয়ে টুইট করেছেন তার স্বামী, অভিনেতা ও ভারতে তামিল রাজনৈতিক দল দ্য অল ইন্ডিয়া সামাথুভা মাক্কাল কাটছি দলের প্রতিষ্ঠাতা আর শরতকুমারও। তিনি বলেছেন, ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে কলম্বোতে। এটা নিন্দনীয়। নিরপরাধ যেসব মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। নাস্তার প্লেট হাতেই বিস্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতী ॥ বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে শ্রীলঙ্কার সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলের ইস্টার সানডে ব্রেকফাস্ট বুফের লাইনে শান্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন আত্মঘাতী হামলাকারী। হাতে প্লেট নিয়ে খাবারের অপেক্ষায় থাকার ভান করা এই ব্যক্তি শনিবার রাতে কলম্বোর এই পাঁচতারকা হোটেলটিতে উঠেছিলেন, তখন নিজের নাম মোহাম্মদ আজম মোহাম্মদ বলে জানিয়েছিলেন তিনি। লাইনের সামনে আসার পর যখন তার প্লেটে খাবার দেয়া হবে ঠিক তখনই হোটেলটির জনাকীর্ণ রেস্তরাঁয় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটান তিনি, জানিয়েছেন সিনামন হোটেলের এক ম্যানেজার। বিস্ফোরক তার পিঠে বাঁধা ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আন্তর্জাতিক একটি বার্তা সংস্থাকে তিনি বলেন, ‘তখন সাড়ে ৮টা বাজে। ব্যস্ত সময়। অনেকগুলো পরিবার ছিল। লাইনের সামনে আসার পরই সে বিস্ফোরণ ঘটায়।’ রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি ও ইস্টার সানডের পরব থাকায় সিনামন গ্র্যান্ডের ট্যাপ্রোবেন রেস্তরাঁয় তখন বহু লোকের ভিড় ছিল। ‘তাৎক্ষণিকভাবে যারা নিহত হন তাদের মধ্যে আমাদের যে ম্যানেজার অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছিলেন তিনিও আছেন,’ বলেছেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের মধ্যে আত্মঘাতীও আছেন। পুুলিশ তার শরীরের কিছু অংশ অটুট অবস্থায় পেয়ে সেগুলো নিয়ে যায়। এই আত্মঘাতী শ্রীলঙ্কান ছিলেন বলে জানিয়েছেন হোটেলটির ম্যানেজাররা। তার দেয়া ঠিকানাটি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। ব্যবসার কাজে সে কলম্বো এসেছে বলে তাদের জানিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনের কাছের এই হোটেলটিতে বোমা বিস্ফোরণের পরপরই স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের কমান্ডোরা ঘটনাস্থলে চলে আসেন। কলম্বোর অন্য দুই পাঁচতারকা হোটেল শাংরি-লা ও কিংসবারিতেও প্রায় একই সময় হামলা চালানো হয়। ওই সময়েই কলম্বোসহ তিনটি শহরের তিনটি গির্জায় ইস্টার সানডের প্রার্থনারত কয়েক হাজার লোকের মধ্য আরও তিনটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কলম্বোর ঐতিহাসিক ক্যাথলিক গির্জা সেন্ট এ্যান্থনির শ্রাইনে ঘটা বিস্ফোরণটির প্রচ- ধাক্কায় ছাদের অধিকাংশ উড়ে যায়। গির্জার মেঝেতে ছাদের টাইলস, ভাঙ্গা কাঁচ ও ছিন্নভিন্ন কাঠের টুকরা রক্তে মাখামাখি হয়ে মেঝেতে পড়ে ছিল। কারা এ হামলাগুলো চালিয়েছে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ তা জানায়নি। হতাহতদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেবে লঙ্কান সরকার ॥ রাজধানী কলম্বো ও এর আশপাশের তিনটি গির্জা ও চারটি হোটেলসহ মোট আটটি পৃথক স্থানে ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনায় হতাহতদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেবে দেশটির সরকার। পাশাপাশি গির্জাগুলো সংস্কারের খরচও বহন করবে সরকার। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান দেশটির মন্ত্রিপরিষদের মুখপাত্র রাজিথা সিনারাতনি। খবর ওয়েবসাইটের। সিনারাতনি বলেন, নিহত প্রত্যেকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ বাবদ এক লাখ শ্রীলঙ্কান রুপী (প্রায় ৪৮ হাজার টাকা) এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রত্যেক পরিবারকে দশ লাখ শ্রীলঙ্কান রুপী (প্রায় পাঁচ লাখ টাকা) করে দেবে সরকার। পাশাপাশি আহতদের প্রত্যেকেই এক লাখ থেকে শুরু করে তিন লাখ শ্রীলঙ্কান রুপী পর্যন্ত অর্থ সহায়তা পাবেন। এছাড়া এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রত্যেকটি গির্জা সরকারের খরচেই সংস্কার করা হবে। আত্মঘাতীর স্ত্রী ও বোন পৃথক বিস্ফোরণে নিহত ॥ শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ সিরিজ হামলার শিকার হয়েছে অভিজাত সাংগ্রিলা হোটেল। দেশটির পুলিশ জানিয়েছে, এই হোটেলের আত্মঘাতী হামলাকারীর স্ত্রী ও বোন পৃথক বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছে। শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলি মিরর জানায়, পুলিশ কলম্বোর চীফ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে জানিয়েছে সাংগ্রিলা হোটেলের আত্মঘাতী হামলাকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার নাম ইনসান সিলাভান। আভিসাভেলা-বেলামপিটিয়া সড়কে নিহত আত্মঘাতী হামলাকারীর একটি কারখানা রয়েছে। পুলিশ জানায়, বিস্ফোরণে পর দেমাটাগোদায় তল্লাশি অভিযানের সময় এক আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে তিন পুলিশ নিহত হয়। আদালতে পুলিশ আরও জানায়, সাংগ্রিলা হোটেলের আত্মঘাতীর স্ত্রী ও বোন দেমাটাগোদায় পৃথক বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে। ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত আইএসের লঙ্কান শাখা ॥ ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলায় দেশটির ইসলামি উগ্রবাদী সংগঠন ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতকে (এনটিজে) দায়ী করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তাদের দাবি, এনটিজের সদস্যরা তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, এনটিজে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর লঙ্কান শাখা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিরর’র অনলাইন সংস্কারের এক খবরে বলা হয়েছে, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক। সরকারের দাবি, হামলার অন্তত ১০ দিন আগেই সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক দাবি করেছেন, এনটিজে শ্রীলঙ্কার আইএস শাখা। হামলাকারী শ্রীলঙ্কান নাগরিকরা মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইরাকে আইএসে যোগ দিয়েছিল। সিঙ্গাপুরভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক রোহান গুনারতেœ জানান, আইএস সমর্থকরা অনলাইনে হামলার ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। হামলার নিখুঁত ব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে সন্ত্রাস দমন বিশেষজ্ঞ আলটো লাবেটুবুন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আইএস ও আল-কায়েদা এমন হামলা চালিয়ে থাকে। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় এমন সমন্বিত হামলার ঘটনা অস্বাভাবিক। হামলা তদন্তে ইন্টারপোলের বিশেষ দল ॥ ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় কয়েক দফার ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনার তদন্তে দেশটিতে বিশেষ দল পাঠাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন বা ইন্টারপোল। সোমবার ইন্টারপোলের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে ইন্টারপোল জানায়, শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষের অনুরোধে দেশটিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তদন্তে তাদের সহায়তায় বিশেষ দল ‘ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম’কে (আইআরটি) পাঠানো হচ্ছে। দলটি হামলার ঘটনাস্থল তদন্ত ও বিস্ফোরকগুলো পরীক্ষাসহ পুরো কাজে শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করবে।
×