ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আউল বাউলের দেশ, মানবিক সমাজ ফিরে পাওয়ার আকুতি

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২১ এপ্রিল ২০১৯

আউল বাউলের দেশ, মানবিক সমাজ ফিরে পাওয়ার আকুতি

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর বর্ষবরণ মানেই উৎসব। অনুষ্ঠান। আনন্দঘন আয়োজনে এবারও বরণ করে নেয়া হলো নতুন বছরকে। ১৪২৬ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি যারপরনাই রঙিন হয়ে ধরা দিয়েছিল। এখনও শহর ঢাকায় সেই আবেশ ছড়িয়ে আছে। তার চেয়ে বড় কথা, এ সময়ে এসে নতুন করে বোধোদয় ঘটে বাঙালীর। এবারও তা-ই দেখা গেল। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে অন্যের আচারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা শহুরে প্রজন্ম নিজস্ব সংস্কৃতির মহিমা প্রচার করেছে। হন্যে হয়ে শেকড়ের খোঁজ করেছে তারা। পহেলা বৈশাখ ছিল জোট বাঁধার। হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেছে। সবারই মাঝে ছিল আউল বাউল লালনের দেশটি ফিরে পাওয়ার আকুতি। মানবিক সমাজ বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে সব মঞ্চ থেকে। এভাবে অনাচার অশুভ অসুন্দরকে পরাভূত করে, পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগাচ্ছে বাংলা নববর্ষ। প্রতিবছরের মতোই ঢাকা সেজিছিল চিরচেনা রূপে। সূর্য ওঠার আগেই জেগে উঠেছিল শহর। ঘরে ঘরে ঘর ছেড়ে বের হওয়ার তাড়া। ছোটবড় সবাই ব্যস্ত। স্নান সেরে বাঙালীর সাজে সেজে পথে নেমে এসেছিলেন। কোন হিন্দু-মুসলমানের বিষয় ছিল না। বৌদ্ধ না খ্রীস্টান খোজেননি কেউ। সবাই বাঙালী। সবাই এক হয়ে ঘোষণা করেছে- সমানভাবে সব ধর্মবর্ণ সম্প্রদায়ের হবে বাংলাদেশ। হোটেল সোনারগাঁ মোড়, শাহবাগ, চারুকলা অনুষদ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর ঘুরে দেখা যায়, সংলগ্ন রাস্তার দুই ধারে মানুষ আর মানুষ। যেদিকে চোখ গেছে, লাল সাদা রং। মেয়েদের শাড়িতে, জামায় ছিল উজ্জ্বল লাল। ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি পরে বের হয়েছিলেন। কারো কারো পোশাকে সাদা লালের মিশেল। তাঁতের শাড়ি, দেশীয় কাপড় ফিরে এসেছিল। এভাবে গ্রামের সরল মানুষ আর সহজ জীবনের কাছে ফিরতে চেয়েছেন শহুরে মানুষ। শুরুটা যথারীতি ছায়ানটের সঙ্গে হয়েছিল। বোমা হামলা চালিয়েও রমনা বটমূলের বিশুদ্ধ চর্চা বন্ধ করা যায়নি। মঞ্চটি থেকে মানবিক সমাজের চির প্রত্যাশার কথা জানানো হয় এবারও। বিগত বছরের নানা অনাচারের চিত্র তুলে ধরে ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন বলেন, আমরা যেন নীতিবিহীন অন্যায়- অত্যাচারের নীরব দর্শকমাত্র হয়ে না থাকি। প্রতিবাদে, প্রতিকার সন্ধানে হতে পারি অবিচল। ওরা অপরাধ করে কেবল এই কথা না বলে প্রত্যেকে নিজেকে বিশুদ্ধ করার আহ্বান জানান দেশের এই নমস্য ব্যক্তিত্ব। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে এখান থেকে সবাই চলেন চারুকলার দিকে। বাকিরা তারও আগে থেকে সেখানে সমবেত হচ্ছিলেন। কেউ দলবেঁধে। কারও সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান। বন্ধুরা প্রেমিক প্রেমিকরা ঘুরে বেড়িয়েছেন। পায়ে পা লাগছিল। গায়ে গা। তবে কেউ কারও যন্ত্রণার কারণ হননি। বরং সব ভুলে একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এই উদ্যাপন নিয়ে স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী উগ্র মৌলবাদীদের কত যে হুঙ্কার! ফতোয়ার পর ফতোয়া। সব পায়ে মাড়িয়েছে মানুষ। গণমানুষের ¯্রােতের কাছে টিকতে পারেনি অপশক্তি। সব বয়সী মানুষের সম্মিলিত শক্তি ধর্ম ব্যবসায়ীদের আরও একবার ‘না’ বলে দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে মৌলবাদীদের বেশি গাত্রদাহ। এবং এখানেই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ। এভাবে প্রতিবাদ গড়ে দিয়ে গেছে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখে নিজেদের মতো করে ঘুরে বেড়িয়েছে মানুষ। চলতে চলতে তুলে ধরেছে গ্রাম বাংলাকে। কারো হাতে ছিল বাঁশি। কারো হাতে একতারা। অনেকেই ঢোল বাজিয়েছেন। নেচেছেন কেউ কেউ। অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকেও গাওয়া হয়েছে বাউল সঙ্গীত। আউল বাউলরা যে উদার অসাম্প্রদায়িক দর্শন প্রচার করতেন, সেই দর্শন ফিরে এসেছে। সঙ্গীত শিল্পীদের মতো চারুশিল্পীরাও ফোক মোটিফ নিয়ে কাজ করেছেন। গ্রামীণ ফর্মে গড়েছেন শিল্পকর্ম। ফোক আর্ট দেখে আবেগে ভেসেছে মন। পাওয়ার আনন্দ, হারানোর বেদনা কী যে অকৃত্রিমভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শহুরে দেয়ালে! এখনও চলছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের বৈশাখী মেলা। বড় বড় শপিংমল রেখে এসব মেলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন নগরবাসী। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বৃহৎ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এখানে বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়েছে কারুশিল্পীরা। শিশু একাডেমি সংলগ্ন দোয়েল চত্বরে বসেছিল কুটির শিল্প মেলা। মনিপুরীপাড়ায় আয়োজন করা হয় পাটপণ্য মেলার। সব মেলা থেকে গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সব মিলিয়ে বছরের প্রথম দিনে লোকায়ত জীবন আর নিজস্ব কৃষ্টির প্রতি বিনাশর্তে নত হয়েছেন শহুরে মানুষ। পূর্বপুরুষের সব দান স্বীকার করে নিয়েছে কৃতজ্ঞচিত্তে। এই যে শহরের বুকে লোকাচার, গ্রামীণ সংস্কৃতি, মেলা- এসবের মধ্য দিয়ে কী আসলে প্রকাশিত হলো? জানতে চাইলে বিশিষ্ট ফোকলরবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ শহরমুখী। গ্রাম ছেড়ে প্রতিনিয়ত শহরে আসছে তারা। কিন্তু তা জীবিকার প্রয়োজনে। মনের যে চাওয়া, সেটি গ্রাম। দিন শেষে গ্রামের সরল মানুষ আর কুটিল-জটিল নয় এমন জীবনের কাছে ফিরতে চায় শহুরেরাও। বৈশাখী উৎসব অনুষ্ঠান মেলায় এ আকুতিই ফুটে উঠেছে বলে জানান তিনি। প্রায় একই রকম ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরজী বলেন, বাঙালীর সবচেয়ে বড় শক্তি তার লোকচেতনা। এই চেতনাকে লালন করার মধ্য দিয়ে, আঁকড়ে ধারার মধ্য দিয়ে এখনও অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। চেতনে কিংবা অবচেতনে আমরা সবাই এই সত্যটুকু স্বীকার করি। শাহ আবদুল করিম গেয়েছিলেন, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম...। সেই দিনগুলোর কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলে বৈশাখ। আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে বার বার আসে বাংলা নববর্ষ। এর মধ্য দিয়ে বাঙালীত্বের জাগরণ ঘটে। নিজের মাটি সংলগ্ন সংস্কৃতি ভুলে থাকা মানুষের বোধোদয় হয়। এটাই সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। বৈশাখ তাই বাঙালীর বড় শক্তি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×