ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

পূর্ব পাকিস্তানীদের আমৃত্যু যুদ্ধের অঙ্গীকার ॥ ২১ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ২১ এপ্রিল ২০১৯

পূর্ব পাকিস্তানীদের আমৃত্যু যুদ্ধের অঙ্গীকার ॥ ২১ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল দিনটি ছিল বুধবার। মেহেরপুরের অখ্যাত গ্রাম ভবেরপাড়া। মুজিবনগর সরকার আত্মপ্রকাশের পর মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী বাহিনী সেখানকার ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধে ৩য় ইস্টবেঙ্গলের ৬ জন শাহাদাত বরণ করেন। লন্ডনে আইরিশ শ্রমিক দলের বৈদেশিক বিষয়ক কর্মকর্তা ড. কোনার ক্রুইজ বলেন, পূর্ববঙ্গের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা সাম্রাজ্যবাদী ও দমনমূলক যুদ্ধের এক দৃষ্টান্ত। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তাঞ্চল থেকে প্রেরিত বার্তায় অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের জেনারেল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য বিশ্ব নেতাদের কাছে আবেদন জানান। এদিন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্ব ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। মেজর ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য লাকসাম ত্যাগ করে কুমিল্লার মিয়ার বাজারে চলে আসে এবং সেখানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল যশোরে পাকবাহিনীর নাভারন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে ১৫ জন পাকসেনা আহত ও ১০ জন নিহত হয়। হিলিতে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী হিলি দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কিশোরগঞ্জ প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর সৈন্যরা ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে পঞ্চগড় শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পাক হানাদার বাহিনী এইদিন প্রতু্যুষে ফরিদপুরের গোয়ালন্দঘাট আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পর সকাল ৯টায় গোয়ালন্দঘাট দখল করে। একই সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে তারা ছত্রী বাহিনী অবতরণ করে। দুপুরে হানাদার বহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। পাকসেনারা সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে আশ্রিত শরণার্থীদের মধ্য থেকে অধিকাংশকে পার্শ্ববর্তী দিনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একই দিনে শহরের কাটিয়া এলাকার এ্যাডভোকেট কাজী মসরুর আহমেদ ও তার শ্যালক শেখ মাসুদার রহমানকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী সুলতানপুর কুমোরপাড়ায় একই পরিবারের তিন ব্যক্তিতে হত্যা করে এবং শেখ মশির আহমেদের বাড়ি ধ্বংস করে এবং উক্ত বাড়ির সন্মুখে সাতক্ষীরা সিলভার জুবিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের ও সাতক্ষীরা কোর্টের মোহরার পুণ্য শাহকে গুলি করে হত্যা করে। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানো এক বাণীতে পাকিস্তান বাহিনীর কার্যক্রমের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে জানান। ঢাকায় মুসলিম লীগ নেতা খান এ. সবুর সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার জন্য নিজ নিজ এলাকায় ভিজিলেন্স কমিটি গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। এই দিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ’একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও পূর্ব পাকিস্তানীদের আমৃত্যু যুদ্ধের অঙ্গীকার’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ বলা হয়, গরুর গাড়িতে, রিকশায়, বাইসাইকেলে, কেউ কেউ ট্রাকে, কিন্তু বেশিরভাগ লোক এবং মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ থেকে হেঁটে ভারতের সীমান্তের দিকে ছুটছে। মেহেরপুর থেকে আধা মাইল পিছনে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্প থেকে মর্টার এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রের গুলি ধেয়ে আসছে। ‘পাঞ্জাবিরা মেহেরপুরে কামানের গোলা এবং বোমা ফেলছে’ একদল বাঙালী চিৎকার করে ভারত সংলগ্ন সীমান্তে একটা ট্রাক লক্ষ্য করে বলল, যেটা গ্রাম থেকে শুধু শেষ অস্ত্রধারী লোকদের নিয়ে সীমান্ত পারি দিচ্ছিল। ভারত সীমান্তের চার মাইল এর মতো পথ- খাঁ খাঁ প্রায় জনমানবশূন্য গ্রাম। মেহেরপুরের অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিগণ একদিন আগেই শহর ছেড়ে চলে গেছে। আজকে যারা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে আছে খালি পায়ে শরণার্থী, ছয় বাচ্চা নিয়ে মলিন পোশাকে মহিলা, মাথায় মালসাম্যান নিয়ে বোঁচকা বোঝাই করা লোকজন, বিছানা ভেঙ্গে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন দু’জন লোক, একজন অন্ধ লোক, যে কিনা তার অন্ধের যষ্ঠি গরু নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বলছি না যে, বাংলাদেশ হবার কারণগুলো এখন আর আবেদন নেই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান যদি কোনদিন স্বাধীন হয়, সেটা কখনও গত চার সপ্তাহে যেই ধরনের ‘স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব’ দেখলাম, তার মাধ্যমে অন্তত সম্ভব না। স্বাধীনতা হয়তো আসবে, তবে কয়েক সপ্তাহে না, কয়েক বছরে, আরও কঠিন লড়াই এবং অল্প কাব্যের মাধ্যমে, প্রচলিত যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এবং সম্ভবত আদর্শবাদের বুলি না কুপচিয়ে সশস্ত্র বামপন্থী গেরিলাদের মাধ্যমে। অনেকখানি আবার নির্ভর করবে ভারতের উপরে, তারা কতটুকু অস্ত্র এবং সীমান্তে সহযোগিতা দেবে দীর্ঘায়িত এই স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। কিন্তু যাই হোক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তান কঠিন সমস্যায় পড়বে। সামনে বর্ষার মৌসুম শুরু হবে, এই অবস্থায় তারা দখলকৃত সুদীর্ঘ গ্রাম বাংলায় কিভাবে তাদের সৈন্য মোতায়েন করবে। তাদের পুনরায় দখলকৃত কলোনিতে তারা প্রশাসনই বা কিভাবে চালাবে। পূর্ব পাকিস্তানের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিকে বা কিভাবে জোড়া লাগানো হবে আর কিভাবেই বা পূর্ব পাকিস্তানকে সীমিত পশ্চিম পাকিস্তানী সম্পদের আবর্জনার স্তূপ থেকে বাঁচানো যাবে। বাঙালী প্রতিরোধ এর প্রতি ভারতের সমর্থনকেই বা কিভাবে মোকাবেলা করা হবে যাতে এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে তাদের সমর্থন আরও না বাড়ে। পাকিস্তানের সমস্যা আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে যদি পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, অথবা এই দুর্দিনে পশ্চিম পাকিস্তান এর অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল বা রাজনীতিবিদরা ঐক্যবদ্ধ না থাকে। বাঙালিরা বিস্ময়করভাবে যুদ্ধের জন্য একেবারে অপ্রস্তুত ছিল, অথচ যুদ্ধ যে কোন সময় শুরু হতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেক বাঙালিই এমনকি কয়েক বছর ধরে করে আসছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, তাদের কোন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বা লিয়াজোঁ বা বোঝাপড়া ছিল না, যে কারণে গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলা তাদেরকে ভুগতে হচ্ছে। নেতৃত্ব সাধারণভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে এবং কিছু ক্ষেত্রে সরকারী চাকরি করা লোকের হাতে ছিল। গত সপ্তাহের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের বাহিনী শহর খালি করে চলে যাচ্ছে আর পাকিস্তানী মিলিটারি রাস্তায় নামছে প্রায় কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই। আমাদের কাছে কিছু প্রতিবেদন আছে যে, বাংলাদেশী নেতারা এবং যোদ্ধারা গ্রামের দিকে সরে যাচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার জন্য। কিন্তু মেহেরপুর বা এরকম কিছু জায়গা, যেখান থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলার সরাসরি সীমান্ত আছে, সেখানে লোকজন সোজাসোজি ভারতে চলে যাচ্ছে। এখনকার একজন স্কুলের প্রিন্সিপাল যিনি গত সপ্তাহেই সাংবাদিকদের বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীতে স্বাগত জানিয়েছিলেন, তিনি এখন ভারতের একটি সীমান্তবর্তী শহর গেড়েতে একটি অতিথিশালায় গিয়ে উঠেছেন। তিনি বললেন ‘আমাদের ৭৫ মিলিয়ন লোক শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাবে।’ আনন্দ বাজার পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের ভরাডুবি’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, দুর্বুদ্ধির বশে বাংলাদেশের ওপর হিংস্র আক্রমণ চালাইয়া ইয়াহিয়া বাঙালীদের জন্য যে কবর খুঁড়িয়াছিলেন তাহাতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকেই না মাটি দিতে হয়। তাহাদের অঙ্গচ্ছেদ তো ইতিমধ্যেই হইয়া গিয়াছে। হাজার চেষ্টা করিলেও সে কাটা শরীর আর জোড়া লাগাইতে পারিবে না। কিন্তু এ অংশটুকু তাহার একান্ত নিজস্ব সেটুকুও যে ফৌজী দাওয়াই প্রয়োগ করিয়া বাঁচাইয়া রাখিতে পারিবে, এমন ভরসাও কম। রক্ত শুধু পূর্বেই ঝরে নাই, ঝরিয়াছে পশ্চিমেও। আসলে অবশ্য সে রক্ত পূর্বেরই, নিজের দেহে তাহা সঞ্চারিত করিয়াই পশ্চিম শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে। নিয়তির এমনই পরিহাস, পূর্ববঙ্গের বুক চিরিয়া যে রক্ত পান করিয়া পশ্চিম পাকিস্তান এত তেজ? সে আর্থিক রক্তই তাহাকে ঢালিতে হইতেছে বাংলাদেশকে শায়েস্তা করিবার জন্য। অপর্যাপ্ত রক্তক্ষয় এখন তাহাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিতেছে। তহবিল শূন্যতার কারণে বিদেশ হইতে কিছুই আমদানি করা যাইতেছে না, একে একে মিত্রের দলও হাত গুটাইতেছে। আরও দিন কতক এমনভাবে চলিলে পাকিস্তানের দুর্দশা চরম হইবে। বেকারত্ব এমনিতে ভয়াবহ। কলকারখানা কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের অভাবে যদি বন্ধ হইয়া যায় তাহা হইলে পশ্চিম পাকিস্তানেও তো হাহাকার পড়িয়া যাইবে। বিদেশ হইতে পাকিস্তান যে বৈষয়িক সাহায্য আসে এক চীন হইতে যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকু হয়তো মিলিবে, কিন্তু অন্যেরা আপাতত সাহায্যদান স্থগিত রাখিয়াছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান সকলেই বাংলাদেশের রণাঙ্গনের দিকে তাকাইয়া আছে- সেখানে একটা ফয়সালা না হইলে দান খয়রাত আবার শুরু করিবে না, এমন একটা ভাবও তাহারা দেখাইতেছে। এমনকি ত্রাণের জন্য যে টাকা জাপান বরাদ্দ করিয়াছিল তাহাও দিতে সে বেশ নারাজ। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×