ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ॥ সাক্ষাতকারে ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ টিপু

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ২০ এপ্রিল ২০১৯

  প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ॥ সাক্ষাতকারে ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ টিপু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে অগ্নিকা-ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ফলে জীবনহানি, অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। গত বছরের সব অগ্নি দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে। এরপরই বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে গ্যাসের চুলা থেকে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ১৬ হাজার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। গত ৮ বছরে সারাদেশে ১ লাখ ৩০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৯২৮ জন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮২৫ জন। ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সংঘটিত অগ্নিকা-ের ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে ঘটছে। তবে অগ্নিকান্ড কখন ঘটবে সে বিষয়টি অনুমান করার উপায় নেই। একটু সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে ‘প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট’ কোর্স করা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ টিপু। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং আর্কিটেকচার টেকনোলজি থেকে তিনি একমাত্র প্রথম সার্টিফাইড ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার। জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি অগ্নি প্রতিরোধে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও তার ইত্যাদি ব্যবহারের সময় পণ্যমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বাড়িঘর ও কলকারখানায় অগ্নি নির্বাপকের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক ত্রুটির পাশাপাশি সিগারেটের আগুন, গ্যাসের চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, রাসায়নিক দ্রব্য, বিস্ফোরণ, আগুন নিয়ে খেলা ও অসতর্কতাসহ নানা কারণে ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকা-। তিনি বলেন, আমাদের দেশের কারখানার মালিকেরা খরচের ভয়ে কারখানায় অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চান না। আবার অনেকেই করতে গিয়েও অনেক খরচের জন্য হিমশিম খাচ্ছেন। এর কারণ হলো দক্ষ ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার এবং দক্ষ লোকের অভাব। যারা বাংলাদেশে ফায়ার সেফটি নিয়ে কাজ করেন তাদের স্বল্প জ্ঞান ও অনেক ক্ষেত্রে ওভার ডিজাইনের কারণে খরচ বেড়ে যায়। আবার সঠিক ডিজাইনেরও ভুলভাবে স্থাপনের কারণে সিস্টেম কাজ করে না। তাই কারখানার মালিকদের উচিত একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ডিজাইন করা। এতে করে খরচও কমবে এবং সিস্টেমও কাজ করবে এবং খরচ কম দেখে বাকিরাও কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এর পাশাপাশি দেশে চালু করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স ফায়ার সেফটির ওপর। এতে দেশে গড়ে উঠবে দক্ষ ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার । আবদুর রশিদ টিপু বলেন, আমাদের দেশে কোন অগ্নিকা- ঘটলে স্থপতিদের মতামত নেয়া হয়। স্থপতি বিভাগে ফায়ার সেফটি নিয়ে পড়ানো হয় কিনা আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, দেশের সরকারী ও বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফায়ার প্রটেকশন এবং ডিটেকশনের আওতায় আনা উচিত। বিভিন্ন ভবনে এই সুবিধা না থাকলে এসব ভবনের অভ্যন্তরে অবস্থানকারী কেউ জানতে পারবে না আকস্মিক অগ্নিকান্ডের তথ্য। তাই প্রতিটি ভবন সুরক্ষিত করতে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা উচিত। তিনি বলেন, উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে কোন অগ্নিকান্ডকে তারা সহজে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে এবং ওইসব দেশে প্রানহানিও অনেক কম। অগ্নি প্রতিরোধে ৫টি প্রস্তাব দেন আবদুর রশিদ টিপু। প্রথমটি হচ্ছে স্প্রিংকলার সিস্টেম। অগ্নিকান্ডে স্প্রিংকলার সিস্টেম একটি সক্রিয় অগ্নি সুরক্ষা পদ্ধতি। এই সিস্টেম পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ দ্বারা পরিচালিত। এই সিস্টেমটি বৃহৎ বাণিজ্যিক ভবন, হাসপাতাল, হোটেল, শিল্প কারখানা, ঘরবাড়ি এবং ছোট ভবনে স্থাপন করা যায়। এ পদ্ধতিটি কিছুটা ব্যয়বহুল। সারা বিশ্বে এই পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে। সম্পূর্ণ ভবন যদি স্প্রিংকলার দ্বারা সুরক্ষিত থাকলে তা হলে ভবনের ৯৬ শতাংশ অগ্নিকান্ডের থেকে সুরক্ষা করা যায়। এ্যামব্রোস গডফ্রে ১৭২৩ সালে প্রথম সফল স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার সিস্টেম তৈরি করেন। আমেরিকায় ১৮৭৪ সাল থেকে স্প্রিংকলার সিস্টেম ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত বিশ্বে স্প্রিংকলার সিস্টেম স্থাপন খরচ টোটাল কনস্ট্রাকশন খরচের ১% খরচ হয়। আমাদের দেশে প্রায় খরচ হয় ২ থেকে আড়াই %। কারণ আমাদের দেশে সব সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দ্বিতীয় হচ্ছে স্ট্যান্ডপাইম সিস্টেম। এটি আরেকটি ফায়ার প্রোটেকশন সিস্টেম। যা ফায়ার পাম্পের সঙ্গে পাইপের মাধমে সংযুক্ত করা থাকে। তৃতীয়টি হচ্ছে ফায়ার এলার্ম সিস্টেম। কোন ভবনে আগুন লাগলে, কেউ যদি দেখতে পায় তাহলে সেই ব্যক্তি এলার্ম সুইচে চাপ দিতে সেন্ট্রালি বেল বেজে উঠবে এবং লোকজন সহজে ভবনে আগুন ছড়ানোর আগেই বের হয়ে আসতে পারবে। তখন কেউ আর ভবনে আটকা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। তৃতীয়টি হচ্ছে ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম। এটি আগুনে লাগার প্রাক্কালে ধোঁয়াকে শনাক্ত করে এবং ফায়ার এলার্ম কন্ট্রোল প্যানেলে সঙ্কেত পৌঁছায়। এতে সহজেই মানুষ অগ্নিকা-ের উৎপত্তি স্থল এবং অগ্নিকান্ডের সম্পর্কে অবগত হতে পারে। চতুর্থটি আগুনকে আবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা। যে কক্ষে বা ফ্লোরে আগুন লাগে সেখানেই আগুনকে ধরে রাখাকেই ফায়ার কনটেইনমেন্ট বলে অর্থাৎ আগুনকে ছড়াতে না দেয়া। এর জন্য যা করা উচিত তা হলো ফায়ার ভোর স্থাপন এবং ফ্লোর টু ফ্লোর পেনিটেশন বন্ধ করা। তা হলে সহজেই এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে আগুন যেতে পারবে না। পঞ্চম হচ্ছে নিরাপদ এক্সিট। প্রত্যেক ভবনের ফ্লোর থেকে সিঁড়ি যদি সেপারেশন করা থাকে তা হলে লোকজন নিরাপদে সহজে ভবন থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে আসতে পারবে। এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে না।
×