ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উপকূলীয় চাষীর মুখে হাসি

প্রকাশিত: ১১:৪১, ২০ এপ্রিল ২০১৯

উপকূলীয় চাষীর মুখে হাসি

উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের ফসলে সবুজের সমারোহ। বিনা চাষে ভুট্টার বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি। এক সময় যে জমিতে লবণের আবরণ জেগে উঠতো সেই জমি এখন সবুজে ঘেরা। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। কম খরচে বিনা চাষে ভুট্টার বাম্পার ফলন পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত কৃষকরা। জানা গেছে, উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ততার কারণে পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। এক ফসলি হিসেবে শুধু আমনের চাষ করে কৃষকরা। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসে এ জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা ২-১০ ডিএস-মিটার। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে জমিতে লবণের আবরণ জেগে উঠে। লবণাক্ততার কারণে ফসল পুড়ে যেত বিধায় কৃষক ওই জমি চাষাবাদ করছে না। রবি মৌসুমে লবণাক্ততার কারণে কোন রবি শস্য উৎপাদন হয় না। লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (এসিআইএআর) এবং কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) অর্থায়নে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় আমতলী উপজেলার লবণাক্ত বান্দ্রা এলাকায় বিএআরআই (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) পটুয়াখালী গবেষণা বিভাগ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও কৃষিতত্ত্ব বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ এবং সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্য মতে দেশের মোট ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পতিত জমি রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৮.৪ লাখ হেক্টর লবণাক্ত ভূমি। চার দশকে শতকরা ২৭ ভাগ এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ষকালে মাটি-পানির লবণাক্ততা ২ ডিএস-মিটারের কম থাকলেও শুষ্ক মৌসুম বিশেষ করে মার্চ ও এপ্রিল মাসে তা বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস-মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্তার পরিমাণ বেশি থাকায় কোন রবি শস্য উৎপাদন হয় না। এই লবণাক্ত পতিত জমিতে আবাদ করার জন্য সরেজমিন গবেষণা বিভাগ আমতলী উপজেলার বান্দ্রা বাজার সংলগ্ন সেকান্দারখালী গ্রামে ৩০ জন কৃষক নিয়ে একটি দল গঠন করে। ওই কৃষকদের উৎসাহিত করে চাষাবাদ শুরু করে। বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রথমে ২০১৬ সলে গবেষণামূলক ৫০ শতক জমি চাষ করে। তেমন সফলতা পায়নি। ২০১৭ সালে ১ হেক্টর, ২০১৮ সালে ১.৫ হেক্টর ও এ বছর ৩ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করেছে। দিন দিন এ প্রযুক্তির প্রসারতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকরা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে। কৃষকদের বীজ, সার, আগাছা নিড়ানো, সেচ, কীটনাশক ও জমি চাষাবাদে সকল প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে এ প্রকল্প। সরেজমিন গবেষণা বিভাগ লবণাক্ত জমিতে লবণ সহিষ্ণু জাতের ভুট্টা চাষের ওপর চার পদ্ধতিতে গবেষণা চালায়। আমন ধান কাটার পর পরই বিনা চাষে ১৪ দিন বয়সের ভুট্টার চারা রোপণ, স্বল্প চাষে ভুট্টার বীজ বপণ, বিনা চাষে ভুট্টার বীজ কাদায় পুতে দেয়া এবং জমিতে জোঁ আসার পর প্রচলিত চাষের মাধ্যমে ভুট্টার চাষ। গবেষণায় চারটি পদ্ধতির মধ্যে আমন ধান কাটার পর পরই বিনা চাষে ১৪ দিন বয়সের ভুট্টার চারা রোপণ করে সবচেয়ে ভাল সফলতা পেয়েছে বলে জানান কৃষক ও সরেজমিন গবেষণা বিভাগ। তবে স্বল্প চাষে ভুট্টার বীজ বপন এবং বিনা চাষে ভুট্টার বীজ কাদায় পুঁতে দেয়া পদ্ধতিসমূহ কৃষকের প্রচলিত চাষ পদ্ধতি অপেক্ষা ভাল ফলন দিতে সক্ষম। কৃষক নাসির উদ্দিন জানান, গত পাঁচ বছর পূর্বে এ জমিতে লবণের কারণে কোন রবি শস্য হতো না। সরেজমিন গবেষণা দলের প্রযুক্তি ও পরামর্শে গত তিন বছর ধরে জমিতে রবি শস্য বপন করছি। ভাল ফলন পাচ্ছি। এ বছর ৯০ শতক জমিতে ভুট্টা, সূর্যমুখী ও মুগডাল চাষ করেছি। কৃষাণী নাজমা বেগম জানান, এ বছর ১ একর জমিতে বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে রবি ফসল চাষ করেছি। ফলন ভাল হয়েছে। এক সময় এ জমিতে আমনের ধান চাষ ছাড়া কিছুই হতো না। এখন এ জমিতে রবি শস্য উৎপাদন হচ্ছে। প্রকল্পের গবেষক বিএআরআই এর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রহমতপুর, বরিশালের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কৃষিতত্ত্ব) ড. মোঃ আলিমুর রহমান বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় বেশিরভাগ জমি এক ফসলী (আমন ধান-পতিত-পতিত)। আমন ধান কাটার পর মাটি ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সেচের উপযোগী মিষ্টি পানির অভাব এবং উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার জন্য লাগসই কৃষি প্রযুক্তির অভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে যথাক্রমে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ এবং ৫৫ ভাগ জমি পতিত থাকে। বর্ষাকালে মাটি-পানির লবণাক্ততা ২ ডিএস-মিটার এর কম থাকলেও শুষ্ক মৌসুম বিশেষ করে মার্চ ও এপ্রিল মাসে তা বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস-মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্তার পরিমাণ বেশি থাকায় কোন রবি শস্য উৎপাদন হয় না। তিনি আরও বলেন, লবণাক্ততার প্রভাব কমানোর মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বিএআরআই-এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগসহ সরেজমিন গবেষণা বিভাগ এবং সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য গবেষণা কাজ করছে। এসিআইএআর-কেজিএফ প্রল্পের অর্থায়নে কৃষিতত্ত্ব বিভাগের আওতায় চলতি রবি মৌসুমে (২০১৮-১৯) বিনা চাষে ভুট্টা, আলু, কাওন ধান ও রসুন আবাদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য চার ফসলভিত্তিক ফসল বিন্যাসের প্রবর্তন এবং সূর্যমুখী ও ভুট্টা বপনের ওপর গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। লবণাক্ত জমিতে লবণ সহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবিত ফসল ফলাতে সক্ষম হলে কৃষকের জমি আর এক ফসলি থাকবে না, চার ফসলিতে রুপান্তিত হবে। -মোঃ হোসাইন আলী কাজী, আমতলী-বরগুনা থেকে
×