ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাইনাস হওয়ার ভয়ে প্যারোল চাচ্ছেন না খালেদা!

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২০ এপ্রিল ২০১৯

 মাইনাস হওয়ার ভয়ে প্যারোল চাচ্ছেন না খালেদা!

শরীফুল ইসলাম ॥ কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করার বিষয়ে দলের নেতারা আগে ইতিবাচক থাকলেও এখন নেতিবাচক অবস্থানে। এর কারণ, খোদ খালেদা জিয়া নিজেই প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছেন না। দেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস হওয়ার ভয়ে তিনি প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছেন না বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র মতে, বিএনপির একটি বড় অংশ চেয়েছিলে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে। কিন্তু দলের অপর অংশটি সরাসরি এ কৌশলের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। খালেদা জিয়ার আত্মীয়স্বজনরাও চেয়েছিলেন তিনি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে দেশে কিংবা বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিক। এ পরিস্থিতিতে পয়লা বৈশাখের দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে এ বিষয়ে নির্দেশনা চাইলে তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি আত্মীয়দের কাছে বার্তা পাঠানÑ তিনি কখনও প্যারোলে মুক্তি চাননি, এখনও চাচ্ছেন না। তবে বিশেষায়িত কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া যায় কিনা এ বিষয়ে তিনি আত্মীয়স্বজন ও নেতাকর্মীদের চেষ্টা চালাতে বলেন। আর তার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে যেন কোন চেষ্টা চালানো না হয় সে ব্যাপারে আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক থাকার কথাও বলেন। সূত্র মতে, বিএনপির উদারপন্থী নেতারা চেয়েছিলেন যেহেতু কারাবন্দী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ তাই তাকে প্যারোলে মুক্ত করে দেশে কিংবা বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে। এ জন্য তারা তাকে প্যারোলে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া নিজেসহ দলের কট্টরপন্থীরা এ কৌশলের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তারা মনে করেন, প্যারোলে মুক্তি দিয়ে একবার বিদেশে পাঠাতে পারলে খালেদা জিয়াকে আর দেশে ফিরতে দেয়া হবে না। আর তাহলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয় নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ কারণে উদারপন্থীরা খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির আবেদন করার প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েও থেমে যায়। খালেদা জিয়া নিজেই প্যারোলে মুক্তির বিরোধিতা করায় এখন বিএনপি নেতারা আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি তার মুক্তির দাবিতে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচী পালনের কথা ভাবছেন। তবে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়েও খালেদা জিয়ার আপত্তি রয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি চান দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজপথে আন্দোলন করে তার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবি আদায় করুক। এর কারণ, ২০১৫ সালে টানা ৯২দিন অবরোধ কর্মসূচী পালনকালে পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা-ে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর দেশ-বিদেশে বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে চরম সমালোচনা হয়। এ কারণে বিএনপিকে চরম মূল্য দিতে হয়। এখনও বিএনপি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। তাই আবারও কোন আন্দোলনে গিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিএনপির রাজনীতিতে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে জানান, কারাবন্দী খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয় নিয়ে বেশ ক’দিন ধরে যে গুঞ্জন চলছে তা ঠিক নয়। কারণ, যার প্যারোল নিয়ে কথা হচ্ছে তিনি নিজেই তা চাচ্ছেন না। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে গেলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়বে। এর ফলে সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মনোবল নষ্ট হবে। আর এ নিয়ে সরকারী দলের নেতারাও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। তাই খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে যেতে চান না। তবে দলের কিছু নেতা ও খালেদা জিয়ার আত্মীয়স্বজনরা তার সুচিকিৎসার কথা ভেবে প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক ছিলেন। খালেদা জিয়ার মনোভাব জানার পর এখন তারাও এ বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানে। দলের পক্ষ থেকে এখন আর কেউ খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির কথা বলবেন না। বৃহস্পতিবার নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তিনি কখনও প্যারোলে মুক্তির কথা বলেননি। এর আগের দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চান না। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশে তার প্যারোলে মুক্তির কথা বলা হচ্ছে, যা ভিত্তিহীন। বুধবার মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এলডিপি সভাপতি ও জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার এক সময়ের রাজনৈতিক সহচর কর্নেল (অব) অলি আহমদ বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি খালেদা জিয়া কখনও নিজের সুবিধার্থে আপোস করবেন না। তাই তিনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। খালেদা জিয়াকে যতদূর জানি বা চিনি, আমার থেকে তাকে বেশি কেউ জানে না। রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিকভাবে আমি যেভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম, এভাবে বিএনপির আর কেউ ছিল না। তিনি কখনও নিজের সুবিধার জন্য কারো সঙ্গে আপোস করবেন না। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিনিময়ে বিএনপির এমপিদের সংসদে যাওয়ার কথা আলোচনায় উঠে আসছে এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অলি বলেন, আমি মনে করি কেউ ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে ব্ল্যাকমেল করছে, বিএনপিকে বিপথগামী করতে চাচ্ছে। খালেদা জিয়া কখনও বিএনপিকে বিপথগামী হওয়ার সুযোগ দেবেন না। গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্তির চেষ্টা করে বিএনপি। এক পর্যায়ে কারাগারে খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ ক’জন নেতা তাকে সুচিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তির দাবি জানান। কিন্তু দলের সিদ্ধান্তের বাইরে এ দাবি জানানোর কারণে লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ কিছু নেতা এতে ক্ষুব্ধ হন। এর পর আর দলের কোন নেতা খালেদা জিয়ার প্যারোলের দাবি জানাননি। সম্প্রতি কারাগারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আত্মীয়স্বজনদের ইচ্ছায় বিএনপির কিছু নেতা ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে দেনদরবার শুরু করেন। ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিনে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরুর পর আবার তার প্যারোলের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। বিএনপির ক’জন নেতাও এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবীদের মতামতও নেয়া হয়। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা শুরুর পর ৫ এপ্রিল ২১ দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতারা বৈঠক করে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চান। এর পর খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় আসে। এ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, খালেদা জিয়া যদি সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন, তাহলে বিষয়টি ভেবে দেখব। প্যারোলে মুক্তি পেতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে দলীয় ফোরামে আমাদের সঙ্গে কারো কোন আলোচনা হয়নি। তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
×