ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজা

চক্ষু ‘চড়কগাছ’ হওয়ার মতো অবস্থা-ঢল নামে মানুষের

প্রকাশিত: ১০:২২, ২০ এপ্রিল ২০১৯

চক্ষু ‘চড়কগাছ’ হওয়ার  মতো অবস্থা-ঢল নামে মানুষের

সঞ্জয় সরকার ॥ জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের ওপর দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন জলজ্যান্ত মানুষ! লম্ফঝম্প করছেন ধারালো কাটা-ছুরি বা দায়ের ওপর। জিহ্বায় লোহার শলাকা ভেদ করে ঘুরছেন এদিক-সেদিক। কেউ কেউ আবার পিঠে গেঁথে দেয়া বড়শির সাহায্যে ২৫-৩০ ফুট উঁচু চড়কাকৃতির গাছে ঘুরছেন অনবরত। কেউ আবার রামদা-ত্রিশূল হাতে উদ্দাম নেচে চলেছেন শিব-কালীর বেশে। দর্শনার্থীরা ঘিরে ধরছেন তাদের। দর্শনার্থীদের উদ্দেশে ছিটিয়ে দিচ্ছেন খেলনা-বাতাসা-পানি। হাজার হাজার পুণ্যার্থী মুহুর্মুহু উলুধ্বনি আর ঢাক-কাসি-শাঁখ-সিঙ্গার শব্দে মুখরিত করে তুলছেন গোটা এলাকা। ‘চক্ষু চড়কগাছ’ হয়ে ওঠার মতো এমন সব ভয়ঙ্কর ও বিচিত্র আয়োজনের মধ্য দিয়েই প্রতিবছর গ্রামবাংলায় অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব ‘চড়কপূজা’। সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ বছরের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। চড়কপূজার আনুষ্ঠানিকতার ধরন অন্য পূজা-পার্বণের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এটা অনেকটা আদিম লোকাচারের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা এ পূজার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়। চৈত্রের শেষদিনে অনুষ্ঠিত হলেও পূজার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয় আরও দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকে। পূজাকে কেন্দ্র করে আয়োজকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। আর পূজার দিনে চড়কপূজার মাঠ পরিণত হয় সকল ধর্মাবলম্বীদের মিলনমেলায়। চড়কপূজা মূলত গ্রামীণ কৃষি দেবতা শিবের আবাহন। দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি, নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভ, মনের বাসনা পূরণসহ মহাদেবতা শিবের সন্তুষ্টিলাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। শিবের গাজন, গম্ভীরাপূজা, নীলপূজা বা হাজরাপূজাও চড়কপূজারই নামান্তর। সাধারণত তথাকথিত ‘নিচু বর্ণের’ হিন্দুরা চড়কপূজার আয়োজন করেন। উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা কখনও এ পূজায় অংশ নেন না। তবে আধুনিককালে কিছু কিছু এলাকায় কথিত ‘উচ্চ বর্ণের’ হিন্দুদেরও চড়কপূজার আয়োজনে শামিল হতে দেখা যায়। ওদিকে আয়োজনের দিকটি নির্দিষ্ট বর্ণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর আনন্দ-উৎসবে সকল বর্ণ-মতের হিন্দুরাই অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবছর চড়কপূজায় হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষদের ঢল নামে। চড়কপূজাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে চৈত্রসংক্রান্তির বারোয়ারি মেলা। চড়কপূজার ইতিহাস ॥ কবে কখন চড়কপূজার প্রচলন হয়- এর সঠিক ইতিহাস জানা আজ দুঃসাধ্য। ‘লিঙ্গপুরাণ’, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’ এর মতো আদি ধর্মগ্রন্থগুলোতে শিবারাধনার উল্লেখ থাকলেও চড়কপূজার উল্লেখ নেই। এমনকি গোবিন্দনন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ এবং রঘুনন্দের ‘তিথিতত্ত্ব’তেও চড়কপূজার কথা বলা হয়নি। অনেকের মতে, তান্ত্রিক সাধনা এবং লৌকিক বিশ্বাসকে ভিত্তি করেই এ পূজার প্রচলন। কালের পরিক্রমায় আনুষ্ঠানিকতার ধরন এবং ব্যাপ্তি কিছুটা কমে এলেও বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও ঘটা করে চড়কপূজার আয়োজন করা হয়। ঝিনাইদহের মহেশপুরের ফতেপুরে চড়ক উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে কয়েকশ’ বছর ধরে। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা তার নিচু বর্ণের প্রজাকুলের জন্য এ ধর্মীয় উৎসব শুরু করেছিলেন। একইভাবে নেত্রকোনার ঋষিপাড়া, সাতপাই, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর শিবমন্দির, শ্রীধরপুর কালীমন্দির, বাহাদুরপুর মন্দির, বরিশালের জুসখোলা, পাবনার পূর্ণানন্দ যোগাশ্রম, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, ঠাকুরগাঁও সদরের বুড়াশিব মন্দির, নাটোরের শঙ্করভাগ মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে শত বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে চড়কপূজা। ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ সালে চড়কপূজায় বড়শি ও জ্বলন্তবাণ বিদ্ধ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আয়োজকরা তাদের ঐতিহ্য ও পূজার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে আদিম বর্বরতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এসব দৈহিক যন্ত্রণার নানা কলা-কৌশল আজও টিকিয়ে রেখেছে। চড়কপূজার নানা পর্ব ॥ বাংলাদেশে বর্তমানে যে চড়ক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়- তার বেশ কয়েকটি পর্ব রয়েছে। এক এক করে পর্বগুলো পালন করার মধ্য দিয়েই পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মূল পূজা চৈত্রের শেষদিনে অনুষ্ঠিত হলেও প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয় সপ্তাহ দুই আগে থেকে। এসবের নেতৃত্ব দেন একজন গুরুসন্ন্যাসী। তার সঙ্গে থাকেন আরেক জন ‘বালা’। চড়কপূজার সূচনা হয় অধিবাসের মধ্য দিয়ে। এ পর্বে গ্রামের নবীন-প্রবীণরা মূল সন্ন্যাসীর কাছ থেকে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। সন্ন্যাসীরা পূজার দিন পর্যন্ত আতপ চালের ভাত ও নিরামিষ খাবার খান। তাদের খাবার জোগাড় করতে হয় বাড়ি বাড়ি ‘মাঙন’(মাগন) করে। চড়কপূজার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ‘পাট স্নান’ বা ‘পাট নাচানি’। চড়কের দেব প্রতিকৃতির নাম ‘পাট’। কাঠের তৈরি ‘পাট’ দেখতে অনেকটা নৌকার আগার মতো। পাটের মধ্যে থাকে শিবলিঙ্গ। এটি সারাবছর মন্দিরে বা ঘরের কোন পবিত্র স্থানে রাখা থাকে। পূজার সাতদিন আগে তা নামানো হয়। এরপর রাতে গুরুসন্ন্যাসী স্নানের উদ্দেশে সেটি নদীতে নিয়ে যান। এ সময় আয়োজকরা সঙ সেজে অর্থাৎ ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানবের মুখোশ পড়ে সন্ন্যাসীকে বাধা দেয়। সন্ন্যাসী তার তান্ত্রিক ক্ষমতায় সব বাধা উপেক্ষা করে পাট স্নান করিয়ে তাতে তেল-সিঁদুর-চন্দন মেখে দেন। এ সময় মুহুর্মুহু ঢাক, কাঁসর-ঘণ্টা-সিঙ্গা বাজানো হয়। পাট স্নানের পরবর্তী পর্বটির নাম ‘পাট নাচানি’। সন্ন্যাসীরা পাট মাথায় নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়িতে যান। তখন বালা গান পরিবেশন করেন। সন্ন্যাসীরা কালী, শিব প্রভৃতি রূপ ধারণ করে ঢাকের তালে তালে পরিবেশন করেন সঙ নৃত্য। কেউ কেউ ধারালো রামদার ওপর খালি পায়ে লাফঝাঁপ করে অথবা অন্যান্য উপায়ে ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখান। বাড়ির কুলবধূরা পাটে তেল-সিঁদুর-চন্দনের ফোঁটা দিয়ে প্রণাম করেন। সবশেষে কিছু উপকরণÑ যেমনÑ নগদ টাকা, চাল, তেল, আলু, নারকেল, শসা প্রভৃতি দিয়ে তাদের বিদায় করেন। কোথাও কোথাও এসব উপঢৌকনকে বলা হয় ‘সিধা’। সন্ন্যাসীরা আসার সময় সিধার সামান্য অংশবিশেষ ফেরত দিয়ে আসেন। গৃহস্থবধূ পরিবারের মঙ্গল কামনায় তা ধানের গোলায় রেখে দেন। শহরাঞ্চলে চড়কপূজার আগে সন্ন্যাসী দল বা আয়োজকদের শিব-পার্বতী বা কালী সেজে বিভিন্ন দোকান এবং বাসাবাড়িতে গিয়ে বাদ্য-বাজনা সহযোগে নেচে-গেয়ে পূজার তহবিল এবং উপকরণ সংগ্রহ করতে দেখা যায়। কিছু এলাকায় অষ্টক গান পরিবেশনেরও রেওয়াজ আছে। চড়কপূজার আর দু’টি পর্ব হচ্ছে চড়ক ঘোরানো এবং নীলপূজা। চড়ক ঘোরানো হয় সংক্রান্তিতে অর্থাৎ মূল পূজার দিনে। আর নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয় সংক্রান্তির রাতে। চড়ক ঘোরানো ॥ ‘চড়ক ঘোরানো’ হচ্ছে চড়কপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব। ২৫-৩০ ফুট উঁচু বৈদ্যুতিক খুঁটির মতো সোজা একটি বৃক্ষ খন্ড কেই বলা হয় ‘চড়ক গাছ’। কদম গাছের মূল কান্ড দিয়ে তৈরি করা হয় এটি। সারাবছর গাছটি জলে ডোবানো থাকে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে তা ঢাকঢোল পিটিয়ে ওঠানো হয়। এরপর বারোয়ারি তলায় বা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় চড়কপূজা। মূল সন্ন্যাসী পূজার পৌরহিত্য করেন। এ সময় অনেকে কবতুর, পাঁঠাবলি দেন। বিকেলের দিকে চড়ক গাছটি সোজা করে মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়। গাছের আগায় বেঁধে দেয়া হয় কাঠ ও দড়ি। সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করা সন্ন্যাসীরা তখন স্নান করে নতুন ধুতি পরে মূল সন্ন্যাসীর কাছে এসে মন্ত্রপুত হন। তন্ত্র-মন্ত্র শেষ হলে তাদের মেরুদ-ের নিচে লোহার তৈরি বড় সাইজের একটি করে বড়শি গেঁথে দেয়া হয়। এরপর বড়শিটি বেঁধে দেয়া হয় গাছে ঝুলিয়ে রাখা দড়ির সঙ্গে। মহাদেবতা শিবের নাম নিয়ে বড়শি ও দড়ি সহযোগে ঝুলে থাকা যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষগুলো চড়কার মতো গাছের চারপাশে ঘূর্ণন শুরু করেন। ঘূর্ণনের সময় নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনদের উদ্দেশে ছিটিয়ে দেন বাতাসা, ফল প্রভৃতি। নারীদের উলুধ্বনি আর ঢাক-কাঁসর-ঘণ্টা-সিঙ্গার শব্দে তখন সেখানে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন আদিম উল্লাস দেখে আগন্তুকদের চক্ষু তখন সত্যি ‘চড়কগাছ’ হয়ে ওঠ। দীর্ঘক্ষণ চড়ক ঘূর্ণন শেষে তাদের গাছ থেকে নামিয়ে আনা হয়। বড়শি খুলে দেয়ার পর গুরুসন্ন্যাসী একদলা মাটি নিয়ে তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে তাদের পিঠের রক্তাক্ত ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। এতে রক্তপাত বন্ধ হয়। চড়কপূজার মাঠে সন্ন্যাসীদের আরও কিছু শারীরিক কসরত প্রদর্শন করতে দেখা যায়। প্রতিটি কসরতই একক ধরনের নরক যন্ত্রনার (!) মতো। কিছু সন্ন্যাসীদের দেখা যায়, জিহ্বায় লোহার শলাকা ঢুকিয়ে তা হেঁটে হেঁটে দর্শনার্থীদের দেখাছেন। আবার কেউ কেউ উদ্দাম নেচে চলেছেন রামদা হাতে নিয়ে। মানুষজন তাদের দেখে ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন। আবার জ্বলন্ত আগুনের কুন্ডলি বা কাঁটার ওপর দিয়েও দিব্যি হেঁটে বেড়ান কেউ কেউ। দৈহিক যন্ত্রণার এমন সব কসরত প্রদর্শনের আগে অনেকে পেটভরে তাড়ি, চোলাই মদ বা গাঁজা সেবন করে বুঁদ হয়ে নেন। ফলে যন্ত্রণা আর যন্ত্রণাকে মনে হয় না। আর এভাবেই একে একে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ঐত্যিবাহী চড়কপূজা। চৈত্রসংক্রান্তির মতো চড়কপূজাও আবহমান গ্রাম-বাংলার লোকায়ত এক উৎসব। দেশের অনেক এলাকায় এখন আর আগের মতো চড়কপূজা হয় না। আবার হলেও এর ব্যাপ্তি ও আনুষ্ঠানিকতার ধরন বদলে গেছে। তবে চড়কপূজায় এখনও সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের ঢল নামে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের চৈত্রসংক্রান্তির সঙ্গে চড়কপূজা আজও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
×