এই খানে একরাত্রি চোখ মেলিয়াছে
মতিন বৈরাগী
এইখানে আর কোনো জাগরণ নেই ঘুম ঘুম চোখ
বিকেলের আলোটুকু ঝুলে আছে গাছে
যারা কথা বলে তারা মৃত মন্দিরের দেব-দেবী
চোখ প্রসারিত দেখে না কিছু শোনে না কিছু খাড়া কান
হাঁটে না তারা
একটা সময় সকলের কাঁধে চড়ে তামাশা উড়ায়
এক ঘোর ঘুম লাগা চোখ লম্বা হাই তোলে
পঙ্গু মানুষ
দালান উঠছে পণ্য হয়ে গেছে নারী ধর্ষিতার ম্লানচোখ
নরকের দরজায় যমরাজ হাসে।
এই খানে আর কোন জাগরণ নেই শশ্মানের ভৌতিক ছায়া কবরের নির্জন
ইতিহাস স্থবির সময়ের ঘোর একচোখা রীতি
এই খানে স্বাধীনতা এককের উল্লাস একটা আঙটায় ঝুলে গেছে
মনে হয় অনর্থক দিনপাতে নিশ্চিত গমন
মানুষের ঘটে গেছে পরাজয়-
এইখানে একটা শব্দ ফুটো করছে নীরব আকাশ- আমি আর আমি
পথিকের কানে তার প্রতিধ্বনি অশুভ স্বপ্নের মতো
যায় সব যায়
নানা চৌকাঠে, খড়খড়ি নড়ে
এই খানে এক রাত্রি তার পাখা মেলিয়াছে।
** শীতের কবিতা
সরকার মাসুদ
আমাদের পাতা ঝরার রিক্ত অনুভূতিকে আহ্বান করে শীত
আমি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসি নতুন রূপে
জ্যাকেটে-কোটে-জিন্সে কেতাদুরস্ত হতে উৎসাহ জোগায়
উত্তুরে হাওয়া; এই সুযোগে আমরা আরও ফিটফাট হই
এই সুযোগে শীতের বাতাস এসে ঘিরে ফেলে বনজ জলাশয়, আ!
এই সুযোগে কোমল সুভোধ খরগোশরা আসে জলাভূমির পাশে
ঘাসের নরম ডগা খাওয়ার ছলে তারা আসলে রোদ লাগায় গায়ে...
শীত আসে এজন্যই যে, আমরা সব দল বেঁধে কুয়াশার পাহাড়
আর ভাঁপ ওঠা নদী দেখতে যাবো দূরে...
আমাদের অস্তিত্বের রিনিঝিনি, ছেঁড়া অবসর আমরা ভালো করে
বুঝে নিতে চাই অবিরাম ঝর্নায়
শীতল পাথরে মাথা রেখে কুয়াশায় চোখ রেখে বসে থাকিÑ
আত্মবিস্মৃতির ঢেউয়ে ভেসে যায় আমার মধুর মুহূর্ত সব
জেগে মুখ তুলে দেখি, হায়! বেলা পড়ে গেছে!
শীতের দিনের হ্রস্বতা তৈরি করেছে এক দীপ্ত হাহাকার
তার ভেতরেই আমি পথ করে নিই পাতা আড়ালে
তার ভেতরেই ঝুলে থাকে এক খ- বর্ণিল স্বর্গ-
কিছু সময় বসে থাকে এক ঝাঁক বন-টিয়া;
তাদের পাখার শব্দে গাঢ় হয় আমাদের এলোমেলো রিক্ত অনুভব!
** আছি বেঁচে রক্তের নুন খেয়ে
তারিক-উল ইসলাম
ফিনকি দিয়ে বের নো রক্তের অনেকটাই জমাট বেঁধেছে।
কিছুটা চোয়াল বেয়ে জলের মতো গড়িয়ে পড়ছে।
কালচে লাল সেই রক্তের নুন পৌঁছে যাচ্ছে ঠোঁটে।
জিভ দিয়ে খাচ্ছি চেঁটে।
বাতাসে বিষফণা-সাপ শব্দ তুলে জানাচ্ছে উপস্থিতি।
তবু আছি দাঁড়িয়ে।
ভাবছো, কী সব বলছি?
ভাবছো, হলো না কবিতার বিত্ত-চিত্রকল্প?
না হোক, তবু যে বলতে হচ্ছেই- আছি এভাবেই, কুন্তলা।
অভিমান নয়, অনুরাগ-অনুযোগও নয়, দ্রোহ তাও নয়।
বলা যাবে না হননও। বলা যাবে না স্বেচ্ছা নির্বাসন।
বলা যাবে না সমুদ্রের জলে সুনামি-কম্পন।
ক্ষয়মুখী পাহড়ের ধুলো- বলা যাবে না তাও।
চারপাশে শুনছি হিস হিস শব্দ।
পুড়তে পুড়তে ছুটে যাচ্ছে দ্রুতগামী ট্রেন।
টের পাচ্ছি আঁচ।
দেখছি, জলে ডুব দেয়া পাখি আর আকাশে উড়ন্ত মাছ।
আগুনে পুড়ছে বাড়ি।
বালকের সুতো-পোড়া ঘুড়ি দিচ্ছে এলোমেলো চক্কর।
শুনছি কান্না-চিৎকার, আহাজারি-হাহাকার।
বালকের হাতে তবু লাটিম, নাটাই।
তালুবন্দী ঘর্মাক্ত মারবেল।
জ্বলছে আগুন। আগুন, আগুন; সে আগুনে দগ্ধ সুতো।
আর আকাশ থেকে নেমে আসছে হাঁপরের আগুনে
সদ্য তৈরি অজ¯্র ছুরি।
হচ্ছি রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত।
আছি বেঁচে, কুন্তলা।
জমাট বাঁধা কালচে লাল রক্তের নুন
খেয়ে বেঁচে আছি।
** টেপা পুতুল
শুক্লা পঞ্চমী
একটা ভালোবাসার গল্প বললে এখনো আৎকে উঠো
একটা মুখচোরা প্রেমিকের গল্প বললে চোখ ঠারো
তারপর সেই ছেলেটার প্রথম কথোপকথন নিয়ে যখন প্রেমের পদাবলী লেখি, তখন আঘাত করো।
ছেলেটির কালোঠোঁট টেপাপুতুল গাল
কাকের বাসা চুল আজো আমার রাত্রি জাগার কারণ।
সে ছিল হাওড়ের চওড়া বুকের সচ্চিদানন্দ
কীর্তনখোলা নাটকের গান।
পুনরুদ্ধারের ক্লান্ত পথে একবার শেষ দেখা হয়েছিল
জলঝড়া হিজলের গাল বেয়ে নামছে সৌম্যবালক।
শান্ত ধীর পূর্বে যেমন ছিল মুখচোরা,
পদ্মপাতার শিসে যেমন বাঁশি বাজাতো!
নামহীন ছেলেটি সময়ের কাছে কেন পরাভূত হয়েছিল
সে উত্তর আমি খুঁজিনা। শুধু তার কথা মনে হতেই ভিজে আসে পাঁজর।
কোন শোভাবলে সে আমার সাক্ষাতপ্রার্থী হয়েছিল, জানিনা,
পানকৌড়ির চোখ গলিয়ে অস্থির চঞ্চলতায়
সেদিন দেখেছিলাম তার থরথর কাঁপন।
শিরোনামহীন এক প্রেমের অর্ঘ্য সাজিয়ে, মাখিয়ে দিয়েছিল
সর্বাঙ্গে। আমি তার মুখচোরা হাসির বাঁকা ঠোঁটে
প্রথম জ্যোৎস্না দেখলাম।
** উন্মেষ
শেলী সেনগুপ্তা
পোষা বিড়ালের মতো রাত
চুপ করে বসে আছে আমার পাশে,
পড়ার টেবিলে অলস ছায়া
মুখখোলা কলমের পাশে বিপন্ন শব্দ,
বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস
ঘুরপাক খায় সফেদ বিছানায়,
ক্লান্তির ঘ্রাণ ঠাঁই নিয়েছে রাতপোশাকে
সত্যদর্শী চাঁদের কাছে শপথ করে
আমার ছায়াও ঝুলিয়ে রেখেছি
অপ্রাপ্তির চিত্রল ডানায়!
একদিন
বিপ্লবের আলিঙ্গনে জন্ম নেয়া
প্রাপ্তির ভ্রুণ
শামিল হবে ক্লান্তির শবযাত্রায়।
** ক্ষুধার্ত অন্ধকার
আফিফ জাহাঙ্গীর আলি
দিনের আলো নিভে গেলে সন্ধ্যা অভিমান করে সরলভাবে ঢুকে
রাত্রির একা একা অন্ধকারের অতল পথে
আগুনে পোড়া তপ্তবালিতে ভাঁজা খই যেভাবে ফুটে-
তীব্র অন্ধকারের চাপায় নিদারুণ যন্ত্রণার হাহাকারে
আলোর অভাব মোড়ানো অভিমানী সন্ধ্যা সকাল হয়ে ফুটে
তীব্র ঝলসান বাতাসে চুপসে গিয়ে হাতছানি দেয় অন্ধকার
ক্ষুধার্ত অন্ধকারের শশী দূর গগনে কালোমেঘে ঢাকা
অন্তিম সলতের দগ্ধ ব্যথার ক্রন্দন
আমার একটা নীলাকাশ চাইÑ
যে আকাশে অন্ধকার শেষে আলো ফুটে নিয়মের ধারায়
যেখানে অন্ধকার অধিকল্প বলে কোন অনুশীলন নেই।
** আমি রসিকা বলছি
আরিফা মনি
এ কোন কল্প লোকের গল্প নয়,
আমার জীবনের বাস্তব গাঁথা।
আজ আমার সত্য বলতে, কোন দ্বিধা নেই।
পথের পাশে পাতা কুাঁড়াতে,
দেখেছেন অনেকেই আমাকে
তখন তো কেউ চিনতে পারেন নি,
আমি সেই মেয়ে রসিকা।
পত্রিকাওয়ালা ও মিডিয়াওয়ালার,
আলোচনায় যখন উঠে এসেছি
একাত্তরের বাংলায় তখন আমিই একজন।
হাজারো গাঁ, গ্রামের রসিকার মধ্যে
আমি ই হয়ে উঠলাম অন্যতম।
সাদা, কালো ও রঙিন ছবিতে
ছেয়ে গেল কাগজের পাতা
আমার আমির মধ্যেই এ যেন অন্য আমি।
শীর্ষ সংবাদ: