ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরী খেলোয়াড়দের সাফল্যের কথা

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

কিশোরী খেলোয়াড়দের সাফল্যের কথা

সম্প্রতি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে রংপুর বিভাগকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার পাঁচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিশোরী মেয়েরা। এই নিয়ে নান্দাইলে চলছে আনন্দের উৎসব। সকলের মুখে মুখে তাদের সাফল্যের আলোচনা। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। এই বাজিমাত করা সাফল্যের পেছনে দিনগুলো ছিল কষ্টের। ছিল শত বাধাবিপত্তির। সেই বিপত্তি জয় করেছে কিশোরী খেলোয়াড়রা। পাঁচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। সেই বিদ্যালয়ের কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড় তাসমি, স্বর্ণা, মদিনা, রোকসানা, সাবা, হালিমা, সুবর্ণা, মীম, পান্নাসহ ১৭ জন। এই কিশোরীদের পরিবারের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। দিনমজুর, রিক্সাচালক ছাড়াও গার্মেন্টসে চাকরি করে তাদের বাবারা। শুধু এখানেই শেষ নয়। যে বিদ্যালয় থেকে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেই বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই তো এই দলের সবচেয়ে কম বয়সের খেলোয়াড় পান্না প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার আনার সময় সে প্রধানমন্ত্রীকে বলে ওঠে ‘দাদি আমরার ভাল মাঠ নাই। একটা মাঠের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী তার প্রশ্নের উত্তরে মাঠের আশ^াস দেন। এই করুণ অবস্থার মধ্যেও গত বছর তারা বঙ্গমাতা ফুটবলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা খেলায় ট্রাইবেকারে রানার্সআপ হয়েছিল। রানার্সআপ হওয়ায় এই কিশোরীদের গত একটি বছর অনেক অবহেলা সহ্য করে চালাতে হয়েছে অনুশীলন। প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে মেয়েদের ফুটবল খেলা অনেকেই ভাল চোখে দেখে না। এ অবস্থায় বিদ্যালয় থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে নান্দাইল সদরে এসে চ-ীপাশা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে অনুশীলন করতে হতো। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ছাড়াও খাওয়া খাদ্য ছিল নামমাত্র। ধার করে কোচের মাসিক পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হলেও মেয়েদের প্রয়োজনীয় খাওয়া খাদ্য হতো না। এতকিছুর পরও থেমে যায়নি ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহকারী কোচ দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল এবং কিশোরী মেয়েরা। পাহাড়সম মনোবল নিয়ে ঝড়, বৃষ্টি ও রোধকে উপেক্ষা করে নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে গেছেন। এই দলের সবচেয়ে ক্ষুদে খেলোয়াড় পান্নার বাড়ি উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের পাঁচরুখী গ্রামে। তাঁর বাবা দুলাল মিয়া গত প্রায় দশ বছর ধরে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় পিয়নের চাকরি করেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সেখানেই বসবাস করেন। দুলালের আরেক মেয়ে হালিমাও একই দলের খেলোয়াড়। সে পড়ে পঞ্চমে ও পান্না তৃতীয় শ্রেণীতে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দু’জনের খেলাই সকলের নজর কাড়ে। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর আদর পেয়ে পান্না বলে ওঠে, ‘দাদি আমরার খেলার মাঠ নাই। একটা খেলার মাঠের ব্যবস্থা করবেন।’ প্রধানমন্ত্রী এতে আশ্বাসও দেয়। এতে সে এখন মহাখুশি। এ নিয়ে তার নিজ এলাকা নান্দাইলে চলছে ব্যাপক আলোচনা। পান্না বলে, প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেয়ায় আমার আশা পূরন অইছে। দলের ক্যাপ্টেন তাসমির গোলে দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়। তার বাড়ি উপজেলার ভুইয়াপাড়া গ্রামে। বাবা আব্দুল মোতালেব ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তিন ভাই -দুই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। তাদের জমিজমা নেই। তাসমি জানান, এলাকার লোকজন বাজে কথা বলতে পারে এ জন্য প্রথমে তার বাবা-মা খেলায় দিতে চাননি। এরপর তার ইচ্ছার কাছে হার মেনেছে সব বাধা। গার্মেন্টসে সামান্য বেতনে চাকরি করা সেই বাবা এখন মেয়ের এই সাফল্যে অনেক খুশি। রোকসানার বাবা আব্দুল জব্বার, তানিয়ার বাবা দুলাল মিয়া, রুনার বাবা শহীদ মিয়া পেশায় রিকশা চালক। রিক্সা চালিয়ে চলে তাদের সংসারের খরচ। পরিবারের খরচ মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। গরিবের মেয়ে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলবে বিষয়টি যেন কেউ মেনে নিতে পারছিল না। গ্রামের মানুষের মুখে তাদের নিয়ে হাস্যকর কথা শুনে বাড়ি থেকে সাফ জানানো হয়েছে কোন খেলায় যাওয়া যাবে না। এমন অবস্থায় তারা কোনো মতে অভিভাবদের বুঝিয়ে মাঠে শুরু করে অনুশীলন। আজ এই সব রিকশা চালক বাবাদের দেখে সমাজের মানুষ সম্মান করে। বাবারাও তাদের মেয়েদের জন্য আজ গর্বিত। হালিমার বাবা দুলাল মিয়া ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় স্ত্রীকে নিয়ে পিয়নের কাজ করেন। দুই জনের সামান্য উর্পাজনে কোনো মতে চলে তাদের সংসার। মদিনা, সুইটি ও প্রীতির বাবা দিনমজুর। তারা অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই দারিদ্র্যের ঘরে জন্ম নেয়া কিশোরী মেয়েরাই এক অসাধ্যকে সাধন করে আজ দেশ সেরার খেতাব পেয়েছে। এদিকে ঢাকায় বসবাসরত নান্দাইলের একটি সংগঠনের সংবর্ধনা গ্রহণ করে রবিবার সকালে ১৭ সদস্যের চ্যাম্পিয়ন দলটি নান্দাইলে বীরের বেশে ফিরে এসেছে। আগে থেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আতশবাজি পুড়িয়ে, পটকা ফুটিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে ও ফুলের মালা দিয়ে তাদের বরণ করা হয়। বাড়িতে তাদের স্বজনরা অপেক্ষার পর দুপুরের দিকে ঘরে ফেরে। অনেকেই এই কিশোরীদের সঙ্গে সেলফি তুলতে বাড়িতে ভিড় করে। মঙ্গলবার ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ তাদের সংবর্ধিত করে। পাঁচরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিশোরীদের সহকারী কোচ দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ফুটবল খেলা নিয়ে নানা বাজে কথার জবাব দেশসেরা হয়েই দিল তারা। এই টিমে কয়েকটা মেয়ে আছে যারা জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে। কোচ মকবুল হোসেন বলেন, কলসিন্দুরের মেয়েদের কথা আপনারা জানেন। তারা এমনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল যে তাদের রোখার সাধ্য কারও ছিল না। আমি কলসিন্দুরের কোচ ছিলাম। গত বছর পাঁচরুখীর কোচ হয়ে অনুশীলন শুরু করলে সেই কলসিন্দুরকে পরাজিত করে কিশোরীরা রানার্সআপ হয়। কিন্তু এবার আমরা সফল। এই কিশোরীরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পেয়েও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এদেরকে সঠিক পরিচর্যা করতে পারলে আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনবে। নান্দাইল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোসাদ্দেক মেহদী ইমাম বলেন, এটা অভাবনীয় সাফল্য। ওই মেয়েদের উপজেলায়ও সংবর্ধনা দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
×