ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. রুবানা হক ॥ বিজিএমইএ নারী নেতৃত্বের অভিষেক

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

ড. রুবানা হক ॥ বিজিএমইএ নারী নেতৃত্বের অভিষেক

ড. রুবানা হক। মার্জিত, স্পষ্টভাষী ও সদালাপী এক নারী ব্যক্তিত্ব এবং ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সহধর্মিণী। পছন্দ করেন কল্যাণের স্বপ্ন দেখতে ও মানুষের মাঝে সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে। তার ব্যক্তিজীবন ও জীবনসংগ্রাম সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন কাটে ভিকারুননিসা নূন স্কুল, হলিক্রস কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই অনন্য মেধাবী ও বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে আসছেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে স্ট্যান্ড করার রেকর্ড রয়েছে তার। ১৫ বছর বয়স থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতেন। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই তো কর্মময় ব্যস্ত জীবনেও আমরা দেখতে পাই তিনি পড়ালেখায় এতটুকু পিছপা হননি কিংবা কোন কিছুই তাকে লেখাপড়ার সংস্পর্শ থেকে ছিন্ন করতে পারেনি। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরুষোত্তম লালের প্রকাশনা সংস্থা ও রাইটার্স ওয়ার্কশপের ওপর ‘রাইটার্স ওয়ার্কশপ : এজেন্ট অব চেঞ্জ’ বিষয়ে পিএইচডি এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হন তিনি। এক সময় টিভিতে উপস্থাপনা করেছেন । ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন সাউথ এশিয়া টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে । তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ট্রাস্টি মেম্বার। বর্তমানে তিনি মোহাম্মদী গ্রুপের কর্ণধার । এই গ্রুপের ২১ টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। সৃজনশীল মনোভাবাপন্ন এই মানুষটির বিচরণ সাহিত্যাঙ্গনেও। কবিতা, প্রবন্ধ লিখতে পছন্দ করেন তিনি। ‘টাইম অব মাই লাইফ’ তার লেখা বিখ্যাত কবিতার বই। তিনি যে শুধু লেখেন তাই নয়, পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ২০০৬ সালে কবিতা লিখে অর্জন করেছেন সার্ক সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জ্বল জ্বল করছিল তার নামটিও। রুবানা হকের বর্ণিল কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। প্রয়াত আনিসুল হকের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পড়ালেখার দিকে বেশি আগ্রহ থাকায় শিক্ষকতায় বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন। কিন্ত ব্যবসায়ী স্বামীর শারীরিক অসুস্থতার দরুন তিনি বেশিদিন শিক্ষকতা করতে পারেননি। অতিরিক্ত কাজের চাপে প্রয়াত আনিসুল হক তার ব্যবসায়িক কাজকর্ম একা সামলাতে পারছিলেন না। তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্ত্রীর সাহায্য চাইলেন। ব্যবসার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও রুবানা হক স্বামীর আবদার ফেলতে পারেননি। শিক্ষকতা ছেড়ে স্বামীর ব্যবসায়িক কাজকর্মে বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত । এভাবেই ব্যবসায় জগতে পদার্পণ ঘটে তার। দেখতে দেখতে প্রায় ২৩ বছর পার করে আজ তিনি একজন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী । নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছে তিনি মায়ের মতো। কার কি সমস্যা, কেন এই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে –এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন এবং যথাসম্ভব দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করেন। রুবানা হকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো তিনি ব্যবসায়িক বিষয়ে দ্রুত ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত। এ গুণটি তার স্বামীকে বেশ মুগ্ধ করেছিল। সম্প্রতি তৈরি পোশাক শিল্পমালিক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তার এই অর্জন যেন পেছনের আর সমস্ত অর্জনকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণিত, শুধু পোশাক শিল্পশ্রমিকদের কাছেই নয় তিনি গোটা ব্যবসায়ী মহলেই এক আস্থার প্রতিচ্ছবি। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার আদায়ে বরাবরই আপোসহীন এক নেত্রী ও অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেন সব সময়। বিজিএমইএ’র সভাপতি হওয়ার আগে থেকেই ব্যবসায়িক খাতের দুর্বলতা দূরীকরণে নানা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও যথাসম্ভব তা বাস্তবায়ন করতে দেখা গেছে। আর এখন তো রয়েছেন একেবারে কাক্সিক্ষত প্ল্যাটফর্মেই। নির্বাচনের ফলের পর তিনি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক তথা পুরো ব্যবসায়িক খাতের দুর্বলতা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের শ্রম তুলনামূলক সস্তা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কিছু শিল্পকারখানা কতিপয় অসুবিধার কারণে প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে অবনতিও রয়েছে। এমনি বহুবিধ সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ব্যবসায়িক মহলে। সমস্যা থাকবেই। ভাল কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এসব মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের শ্রমবাজারের ভাবমূর্তির তুলনামূলক উন্নয়নকল্পে এবং শ্রমিকদের কল্যাণ ও শিল্পস্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের স্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, যথাসময়ে ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি, মজুরি বৃদ্ধি, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্কোন্নয়ন, দুর্বল শিল্পগুলোর সহায়তা প্রদান প্রভৃতি তার কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। তার সঙ্গে আমরাও স্বপ্ন দেখি মানসম্মত ও উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশের। যেখানে থাকবে না কারও কোন অভাব, অভিযোগ; শ্রমিকরা পাবে তার ন্যায্য পাওনা, পাশাপাশি মালিকরাও দেখবে তাদের ব্যবসায়ে লাভের মুখ। রুবানা হক আজ যে পর্যায়ে এসেছেন, আমাদের দেশের অতীতের নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির গল্প শুনলে তা অকল্পনীয় মনে হয়। শতভাগ না হলেও দিন দিন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী এগিয়ে চলছে নিরন্তর, তাদের আত্মমর্যাদার স্থানটিকে করছে সমুজ্জ্বল। আর তা সম্ভব হচ্ছে তাদের নিরলস কর্মপ্রচেষ্টায় কাকতালীয় কোন ঘটনার মাধ্যমে নয়। এভাবেই জীবনসংগ্রামের মশাল প্রজ্বলিত করে আমাদের সমাজে জেগে উঠুক আরও শতসহস্র রুবানা হক, দূর হোক সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার।
×