ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুব্ধ বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের ডাক

অবসর ও কল্যাণ তহবিলে ১০ শতাংশ চাঁদা নিয়ে জটিলতা

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

অবসর ও কল্যাণ তহবিলে ১০ শতাংশ চাঁদা নিয়ে জটিলতা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিলে মাসিক ১০ শতাংশ হারে চাঁদা কেটে রাখার আদেশ ঘিরে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশকে ‘অমানবিক ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের পদক্ষেপ’ অভিহিত করে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বেসরকারী প্রায় সকল শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠন। অবসরের পর দ্রুত প্রাপ্য টাকা পরিশোধের লক্ষ্যে এ আদেশ জারি করা হলেও অতিরিক্ত ৪ শতাংশ টাকা কেটে রাখার বিপক্ষে শিক্ষক নেতারা। আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আদেশ বাতিল না হলে ২ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি ৬ শতাংশ থেকে চাঁদা ১০ শতাংশে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ওই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠানের বৈঠকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তীতে আদেশ জারি করা হয়। তবে আদেশ জারির পর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে আদেশ স্থগিত করে মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মোঃ গোলাম ফারুক যিনি একই সঙ্গে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের সহসভাপতি তিনি বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ এপ্রিল আদেশ দিয়েছে চলতি মাস থেকেই ১০ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখতে। আগে যে আদেশ স্থগিত করা হয়েছিল সেটা এখন কার্যকর করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি আগেই একবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এখন সেটা কার্যকর করতে বলা হয়েছে। যদিও এ ধরনের কোন আদেশ এখনও পাননি বলে দাবি করেছেন কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ সাজাহান আলম সাজু। শিক্ষক অসন্তোষের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা আসলে একটা ষড়যন্ত্রমূলক কিছু হচ্ছে। একটা আদেশের কথা বলা হয়েছে কিন্তু আমি এমন আদেশ এখনও পাইনি। তবে অপর প্রতিষ্ঠান অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ শরিফ আহমেদ সাদী বলেছেন, হ্যাঁ আমরা আদেশ পেয়েছি। এ আদেশ আসলে আগের সিদ্ধান্ত অনুসারেই হয়েছে। এটাকে নেতিবাচকভাবে না দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অবসরের পর শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা পাওয়ার যে ভোগান্তি সেটা তো মূলত হয় ফান্ডের অভাবে। সকলে চেয়েছে যেন একটু বেশি টাকা রাখা হলে অবসর নেয়ার পরে টাকাটা দ্রুত পান। ২০১৭ সালে যে সিদ্ধান্ত ছিল সেটা এখন চলতি মাস থেকে কার্যকর করতে বলা হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও থেকে বর্তমানে প্রতিমাসে ৬ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়। অবসরের পর শিক্ষক কর্মচারীদের লভ্যাংশসহ এ টাকা তাদের দেয়া হয়। অর্থ স্বল্পতায় অবসর ও কল্যাণের টাকা পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয় তাদের। অর্থ স্বল্পতা কাটাতে সরকার বেশ কয়েক দফা থোক বরাদ্দও দিয়েছে এ খাতে। তবে শিক্ষক সংগঠনগুলো ৬ শতাংশের বেশি টাকা কেটে রাখার প্রতিবাদে এখন একাট্টা। বেতন থেকে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের ফান্ডে ৬ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ চাঁদা কর্তনের আদেশের প্রতিবাদে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নেতারা। অবিলম্বে এ আদেশ বাতিল করে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধার পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ পেনশন চালুর দাবি জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক মিসেস বিলকিস জামান বলেছেন, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে এপ্রিল থেকে অবসর সুবিধা বোর্ডের ফান্ডে ৪ শতাংশের স্থলে ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টের ফান্ডে ২ শতাংশের স্থলে ৪ শতাংশ কর্তনের সরকারী আদেশ অবিলম্বে বাতিল করতেই হবে। অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের সরকারী আদেশ ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বাতিল না হলে আগামী ২ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (নজরুল) ও এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরাম। রাজধানীর মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলে যৌথসভায় এ কর্মসূচীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোঃ নজরুল ইসলাম রনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় শিক্ষক নেতারা বলেন, একটি অশুভ চক্রের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন হবে বর্তমান সরকারের জন্য আত্মঘাতীমূলক। তারা আরও বলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে কোন আলোচনা ছাড়াই অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করা হলে শিক্ষকরা আর ঘরে বসে থাকবে না। অবিলম্বে অতিরিক্ত কর্তনের প্রজ্ঞাপন বাতিলে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন শিক্ষক নেতারা। রনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ অমানবিক ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের পদক্ষেপ। এর সঙ্গে কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিবের সম্পৃক্ততা আছে বলে অভিযোগ তার। বলেন, চারবার তিনি এ পদে বসেছেন, আমরা তার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু তিনি ঠিক করছেন না। সভায় বক্তব্য রাখেন মহাসচিব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম প্রিন্স, সিনিয়র সহসভাপতি গাজী মামুন আল জাকীর, অতিরিক্ত মহাসচিব কামরুল খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মোঃ আবুল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ সিরাজুল ইসলাম, সহকারী মহাসচিব মোঃ মঈনুল ইসলাম, সহসভাপতি মোঃ মিজানুর রহমান ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুব্রত কুমার ভট্টাচার্য্য। অতিরিক্ত ৪ শতাংশ চাঁদা কর্তনের আদেশ স্থায়ীভাবে বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স এ্যাসোসিয়েশন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে সংগঠনটি। ৬ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ চাঁদা কর্তনের আদেশের প্রতিবাদে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) নেতারা। অবিলম্বে এ আদেশ বাতিল না হলে কঠোর কর্মসূচী পালন করতে বাধ্য হবেন তারা। নেতারা বলেছেন, শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মারপ্যাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা সরকারীকরণের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য চাঁদার হার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ কর্তনের আদেশ জারি করা হয়। আদেশ দেয়ায় সারা দেশের মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। ১০ শতাংশ চাঁদা কর্তনের আদেশের নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি সৈয়দ জুলফিকার আলম চৌধুরী বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে ১০ শতাংশ কর্তনের সিদ্ধান্ত শিক্ষকদের স্বার্থের পরিপন্থী। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মচারী জাতীয় পরিষদ। সভাপতি মোঃ রফিকুল ইসলাম মন্টু ও মহাসচিব মোহাম্মদ মোস্তফা ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়ে বলেছেন, এমপিওর সামান্য টাকায় শিক্ষক-কর্মচারীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদা বাবদ এতদিন ৬ শতাংশ কাটা হতো। কিন্তু অতিরিক্ত ৪ শতাংশ চাঁদা কাটার আদেশকে শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘না খাইয়ে রাখার অভিনব প্রয়াস’ হাতে নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষক- কর্মচারীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছীন। সংগঠনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন ও মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী বলেন, অবসর ও কল্যাণ তহবিল থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের আদেশ দেশের সব বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্তরে দাগ কেটেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মহল দ্রুত এ আদেশ প্রত্যাহার করে দেশের শিক্ষক-কর্মচারীদের শান্ত করবেন বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জমিয়াতুল মোদাররেছীনের নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশু দৃষ্টি কামনা করেছেন। এদিকে নতুন স্কেলে কল্যাণের টাকা পেতে আবার আবেদন করতে হবে এমন ঘোষণায়ও বাড়ছে শিক্ষকদের ক্ষোভ। ২০১৫ সালের ১ জুলাইয়ের পর যারা অবসরে গেছেন এবং পুরনো স্কেলে কল্যাণ ট্রাস্টের আংশিক টাকা পেয়েছেন, নতুন স্কেলে বাকি টাকা পেতে তাদেরকে আবার আবেদন করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ। এই সিদ্ধান্তে ভোগান্তিতে পড়তে হবে এমন আশঙ্কায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
×