ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১১:১৬, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ একজন দৃষ্টিহীন। চোখে কিছু দেখে না। অন্যজন চোখে দেখে বটে। মুখে কথা নেই। তৃতীয়জন চোখে দেখে। কানে শুনে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না। একটি পা কাটা গেছে তার। এতসব সীমাবদ্ধতা নিয়ে, হ্যাঁ, বেঁচে থাকাই কঠিন। কিন্তু লাভলী, হাওয়া ও রাব্বিকে দেখে মন ভরে যায়। প্রতিবন্ধকতা জয় করার পাশাপাশি মঞ্চে অভিনয়ও করছে তারা! লাইভ পারফর্মেন্স। ভাবা যায়? নাটকটির নাম ‘ফিয়ার লেস।’ ঢাকা থিয়েটার প্রযোজনা। নেপথ্যের মানুষটি দলপ্রধান নাসির উদ্দীন ইউসুফ। কত নাটকের কাজ করছেন তিনি! কিন্তু প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েদের নিয়ে এখন চলছে তার নতুন এক্সপেরিমেন্ট এবং এ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দারুণ খুশি তিনি। নাটকটি নিয়ে তার কেন এত আবেগ? এত কেন মুগ্ধতা? জানার সুযোগ হয় গত বুধবার। এদিন শিল্পকলা একাডেমিতে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ৩০ মিনিটের নাট্য প্রযোজনা দেখে অভিভূত হতে হয় শুধু। সমাজ যাদের দুঃখ সুখকে স্বীকার করে না, মানুষের অধিকার দিতে কুণ্ঠাবোধ করে সেই তারা ‘ডিফারেন্টলি এ্যাবল’ বা ‘ভিন্নভাবে পারঙ্গম’। মঞ্চের আলোয় অভিনয় শিল্পীরা তা প্রমাণ করেন। নাটকে প্রতিবন্ধী জীবনের দুঃখগাথা। সংগ্রাম। একইসঙ্গে যৌন নিপীড়নের একটি চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এখানে এসে নাটকটি আরও বেশি সমকালীন হয়ে ওঠে। চরিত্রগুলোর কান্না, হাসি, অন্তর্বেদনা দর্শককে মুহূর্তেই ছুঁয়ে যায়। মুখের ভাষা, অঙ্গ সঞ্চালন ও সাইন ল্যাংগুয়েজ সব কোথায় যেন এসে এক হয়ে যায়। অদ্ভুত এবং জোরালো একটি নাট্য ভাষার সৃষ্টি করে। নাটকের মধ্য দিয়ে লাভলী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, কে আসলে প্রতিবন্ধী? যারা প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেয়ালের শিকার, তারা? নাকি যারা এই বিশেষ মানুষগুলোকে বুঝতে বা গ্রহণ করতে অক্ষম, তারা? ‘ফিয়ার লেস’ নাটকটি লিখেছেন রুমা মোদক। নির্দেশনা দিয়েছেন ওয়াসীম আহমেদ। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তায় মঞ্চে আসা নাটকটিকে এক ধরনের শুরু বলা চলে। এ ধারার নাটক আরও হবে। হবে যে, সেটি নিশ্চিত করলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। দর্শক সারিতে বসে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে নাটকটি দেখছিলেন তিনি। তারও আগে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাহস দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে মঞ্চে তুলে দেন তিনি। পরে আলাপকালে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, এদের এগিয়ে নিতে হবে। ওদের ভেতরে দারুণ সব প্রতিভা আছে, বের করে আনা চাই। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েদের নিয়ে প্রথম ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ করেছিলাম। সেটি করতে গিয়ে ওদের ভেতরের শক্তিটা দেখেছি। এখন বিভিন্ন বিভাগে ওয়ার্কশপ পরিচালনা করছি আমরা। ওয়ার্কশপের মাধ্যমে এমন আরও অভিনেতা অভিনেত্রী তুলে আনব। ঢাকা থিয়েটারের এই নতুন নাট্য ভাবনা সফল হোক। স্বার্থক হোক। নববর্ষ বরণ প্রসঙ্গে আসা যাক। নতুন বছর ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিল বাঙালী। গত রবিবার ছিল পহেলা বৈশাখ। এদিন ভোর বেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। তারও আগে বাসা থেকে বের হয়ে আসতে থাকেন সাধারণ মানুষ। প্রায় সকলের গায়ে নতুন জামা। লোক ঐতিহ্যের পোশাক পরে রমনার বটমূলে সমবেত হন তারা। এখানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। বহুকাল ধরে চলা এই অনুষ্ঠানে এবারও ঢল নামে মানুষের। রাগালাপে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে ছিল একক ও সম্মেলক গান। শতাধিক শিক্ষার্থী হাঁটু ভাঁজ করে মঞ্চে বসেছিলেন। তাদের সম্মেলক পরিবেশনা শুনে, দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুনের মূল্যবান বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। বর্তমান সময়কে পর্যবেক্ষণে নিয়ে দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা করেন দেশের বিশিষ্ট এই সংস্কৃতিজন। এর পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। আয়োজনটির মধ্য দিয়ে এবারও বর্ষবরণ উৎসবের সবচেয়ে রঙিন ও আনন্দঘন রূপ প্রকাশিত হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শোভাযাত্রার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এবারও তারা চারপাশ থেকে র‌্যালিটিকে ঘিরে রেখেছিলেন। পুলিশ র‌্যাব সোয়াতসহ বিভিন্ন বাহিনীর কয়েক শ’ সদস্য অস্ত্র হাতে অনেকটা লেফট রাইট করে চলেন। সাধারণ মানুষের বড় অংশটি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার সুযোগই পাননি। তারা অভিযোগ করে বলেছেন, নিরাপত্তা দেয়ার নামে মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দ বিনষ্ট করা হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না বললেই চলে। ফলে বাঙালী চেতনার মানুষ মাত্রই শোভাযাত্রা দেখে বিব্রত হয়েছেন। চারুকলার সাবেক ছাত্র শিশির বলছিলেন, এটা বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত। আমরা দিব্য চোখে দেখছি দেশে একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও বলেছেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। এর পরও যে ছবি দেখলাম সেটিকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বলা যায় না। এভাবে সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ছোট করা হচ্ছে। অন্যদিকে উগ্রবাদীদের এই ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, বঙালী চেতনায় বিশ্বাসীরা দুর্বল। এভাবে চরম ক্ষতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তার। এদিকে, নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করার যে নির্দেশনা দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটি তারা যথারীতি কার্যকর করেছেন। এর ফলে বিকেলে ঢাকায় তেমন কোন অনুষ্ঠানই ছিল না। একটা ভাঙ্গা হাট দৃশ্যমান হয়। এ নিয়েও বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষেরা নিজেদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মীরা ক্ষুব্ধ। এমনকি সময় সংকোচন করার প্রতিবাদে শেষ মুহূর্তে রবীন্দ্র সরোবরের অনুষ্ঠান বাতিল করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এ প্রসঙ্গে জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আইন শৃঙ্খলার নামে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ আমাদের। বাঙালীর সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসবের সময় বেঁধে দেয়া পুলিশের কাজ নয়। এটি করতে গিয়ে অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলছেন তারা। প্রতিবাদে অনুষ্ঠান বাতিল করার কথা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চাইছি আমরা। তিনি ছাড়া এসব আনুষ্ঠানিকতার তাৎপর্য কেউ বুঝবেন বলে মনে হয় না।
×