ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তিনি যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের ক্যাশিয়ার, বাংলা ভাইর ঘনিষ্ঠ সহচর হয়েও ২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন বহাল তবিয়তে

নিজে অনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত অথচ তিনিই ছাত্রদের নৈতিকতা শেখাচ্ছেন

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

নিজে অনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত অথচ তিনিই ছাত্রদের নৈতিকতা শেখাচ্ছেন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নিজেই অনৈতিকভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ বাগিয়ে নিয়ে বাইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি তার শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শেখাচ্ছেন। তাও আবার মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘ অবৈধ চাকরি জীবনে সরকারের লাখ লাখ টাকা তিনি বেআইনীভাবে নিয়েছেন। খোদ রাজধানীর মিরপুরের হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) কামিল মাদ্রাসায়ই ঘটেছে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এই শিক্ষক এক সময় জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছিলেন শীর্ষ ছয় জঙ্গীর অন্যতম বাংলাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যু কার্যকর হওয়া মীর কাশেম আলীর ক্যাশিয়ার। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের দিন আনন্দ মিছিল বের করায় হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে বেধড়ক মারধরের পর এবং পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে এমদাদ নামে এক জেএমবি জঙ্গী নিহত হওয়ার পর রীতিমতো আলোচনায় আসেন এই শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরির্দশন ও নিরীক্ষা বিভাগের দীর্ঘ অনুসন্ধানেও ওই শিক্ষকের অবৈধ নিয়োগসহ নানা বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িত থাকায় এই শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে আপত্তি উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) ফাজিল মাদ্রাসায় সরকারী বিধি মোতাবেক একজন উপাধ্যক্ষসহ শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সরকারী বিধি মোতাবেক উপাধ্যক্ষ হিসেবে কাউকে নিয়োগ পেতে হলে তার আরবী বিষয়সমূহে অধ্যক্ষ বা সহকারী অধ্যাপক বা প্রভাষক হিসেবে কমপক্ষে ৬ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই শিক্ষক যথারীতি আবেদন করেন। তিনি নিয়োগও পেয়ে যান। এমনকি ’৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে অদ্যাবধি সরকারী টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ শিক্ষক আফজাল হোসেনের দাখিল করা কাগজপত্রে দেখা যায়, তিনি ’৯৫ সালে যাত্রাবাড়ীর তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে কামিল, ’৯৩ সালে ফাযিল আর ’৯১ সালে আলিম পাস করেন। আর ’৮৯ সালে ছারছীনা দারুস সুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। তার চাকরিতে আবেদন করার জন্য যে ন্যূনতম ছয় বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তা নেই। আফজাল হোসেনের পিতার নাম মুহাম্মদ আজিজুল ইসলাম। বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা থানাধীন বেংগাড়ির আশরাফপুরে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর করা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহর করা এক আবেদনে বলা হয়েছে, আফজাল হোসেনের নিয়োগ পাওয়ার সময় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন বজলুর রহমান। এই অধ্যক্ষ আফজাল হোসেনকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় আফজাল হোসেনের ক্যারিশমা। তিনি মাদ্রাসায় গোপনে জামায়াত-শিবিরপন্থী শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যান। পরে অধ্যক্ষ বজলুর রহমানকে নানাভাবে মানসিক ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে জোরপূর্বক বজলুর রহমানের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র আদায় করেন। এমন পরিস্থিতি চলার সময় ২০০১ সালে আফজাল হোসেনের নিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। তারই প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর মাদ্রাসাটি অডিট করে। অডিট রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় দেড় লাখ টাকা নয়ছয় হয়েছে। ওই টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া অডিট রিপোর্টে আফজাল হোসেনের নিয়োগ নিয়ে আপত্তিতে বলা হয়, তিনি ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি যোগদান করেন। উপাধ্যক্ষ হিসেবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও ফাজিল মাদ্রাসার প্রভাষক হওয়ার বা অধ্যক্ষ হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। এতে করে তাকে কিভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এ অবস্থার মধ্যেই জোরপূর্বক ২০০২ সালের ২২ এপ্রিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন আফজাল হোসেন। দায়িত্ব নিয়েই বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি মীমাংসার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সবাইকে ডাকা হয়। সে সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেই আফজাল হোসেন ও তার লোকজন বজলুর রহমানকে মারধর করে। তখন জেলা প্রশাসকের অফিসের লোকজন বজলুর রহমানকে রক্ষা করে। এ ঘটনার পর অভিমানে বজলুর রহমান মাদ্রাসায় আসা বন্ধ করে দেন। শেষ পর্যন্ত পেনশন ও অন্যান্য টাকা না পেয়েই মারা যান তিনি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপালনকালে নানাভাবে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তারই প্রেক্ষিতে ’১০ সালের ১৭ মে কে এম সাইফুল্লাহ নামের এক শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বরখাস্ত হওয়ার পর আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে মাদ্রাসায় জামায়াত-শিবির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলতে থাকে। ১০ সালে এমদাদ নামে মাদ্রাসার এক ছাত্র পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা যাওয়ার পর আফজাল হোসেন সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য বের হতে থাকে। নিহত এমদাদ আফজাল হোসেনের সরাসরি ছাত্র ও ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল। এমদাদ ছিল নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি সদস্য। এমদাদের সূত্রধরে মিরপুরে জেএমবি জঙ্গীদের বোমা তৈরির আস্তানা আবিষ্কৃত হওয়ার পর জঙ্গীদের সঙ্গে আফজাল হোসেনের যোগাযোগ থাকার অভিযোগ ওঠে। আস্তানায় থাকা জঙ্গীদের অনেকেই আফজাল হোসেনের মাধ্যমে মাঝে মধ্যে মাদ্রাসায় যাতায়াত ও রাত কাটাত বলে ধারণা করা হচ্ছিল। এই শিক্ষক যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফঁাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর এক সময়ের ক্যাশিয়ার ছিলেন। মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ি এলাকায় তুরাগ নদের পাড়ে গড়ে তোলা তামান্না পার্কের মালিক জামায়াত নেতা ঝিনাইদহের আব্দুল্লাহ আল মামুনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন এই শিক্ষক। তারই সূত্রধরে এই শিক্ষক গোড়ান চটবাড়ি এলাকায় বাড়ি করেছেন। পরে নানা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ মাদ্রাসাটিতে অভিযান চালিয়ে আফজালসহ তার কয়েক সহযোগীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার লাঠিসোটাসহ গ্রেফতার করে। স্থানীয় এক প্রভাবশালী মহিলা এমপির সহযোগিতায় তিনি পরে ছাড়া পান। এখনও তার বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ আছে। সূত্র জানায়, ’১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। সেদিন হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) কামিল মাদ্রাসা থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আফজাল হোসেন, স্থানীয় জামায়াত শিবির নেতাকর্মীদের নিয়ে অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহকে বেধড়ক মারধর করে। আফজাল হোসেনের ধারণা, প্রিন্সিপালের মদদেই জামায়াত নেতার ফাঁসির দিনে মাদ্রাসা থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়েছিল। তার নির্দেশে ও উপস্থিতিতেই মাদ্রাসার ভেতরে জামায়াত-শিবিরের লোকজন ওই অধ্যক্ষকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। এলোপাতাড়ি আঘাতে অধ্যক্ষের বাঁ হাত, কপাল, দুই পা ও পিঠে একাধিক চাপাতির কোপ লাগে। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন জড়ো হলে দুর্বৃত্তরা চলে যায়।
×