ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মামলা- চাঁদে সাঈদী গুজব ছড়িয়ে নাশকতা

সাজা হয়নি কারও ॥ আসামি প্রায় এক লাখ

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

সাজা হয়নি কারও ॥ আসামি প্রায় এক লাখ

শংকর কুমার দে ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ড প্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে নারকীয় তাণ্ডব ও নাশকতা চালানোর ঘটনায় আসামির সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এর মধ্যে দীর্ঘ ছয় বছরে কোন আসামিরও বিচার হয়নি। পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে উত্তরাঞ্চলে সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালায় জামায়াত-শিবির। এই সন্ত্রাসের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানুষ, দোকানপাট, অফিস-আদালত, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি কোন কিছুই রক্ষা পায়নি। রেহাই পায়নি পুলিশের তদন্ত কেন্দ্র, উপজেলা নির্বাহী অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, পরিবহনসহ হাতের কাছে যা মিলেছে সবই। গুজব ছড়ানো হয়, সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, এরপর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে- এমন গুজব ছড়িয়ে মসজিদের মাইকে, মোবাইল ফোনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমন গুজব ছড়িয়ে ধর্মভীরু মানুষকে ঘর থেকে ডেকে এনে সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালানো হয়। দীর্ঘ ছয় বছর আগে সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালানো ও নাশকতার এসব মামলার আসামির সংখ্যা পায় এক লাখ। কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও সাজা হয়নি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে নাশকতা চালানোর ঘটনায় সারাদেশে মামলা হয়েছে ৫৬। এর মধ্যে ৫২টির চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোর ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। চার্জশীটভুক্ত আসামিদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী-ক্যাডার। নামের আসামি ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা হাজার হাজার। দীর্ঘ ছয় বছরে কোন আসামির বিচার হয়নি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানায়, ’১৩ সালের ৩ মার্চ গভীর রাতে বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিত গুজব ছড়ায় যে, সরকার সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দিয়েছে। এরপর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে বলে গুজব ছড়ানো হয় মসজিদের মাইকে, মোবাইল ফোনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমন গুজবে ধর্মভীরু লোকজনকে ঘর থেকে ডেকে বাইরে আনার পর তারা সন্ত্রাসের তা-বলীলায় মেতে ওঠে। ফজরের নামাজের পর লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে জামায়াত-শিবিরের শত শত সন্ত্রাসী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাণিজ্যমেলা, রেলস্টেশন, সদর থানা, ফুলবাড়ী, উপশহর, নারলী, কৈগাড়ি ও স্টেডিয়াম ফাঁড়ি, মোকামতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও বগুড়া সদর থানার অস্ত্রাগার ও আশপাশের মার্কেটগুলোতে লুটপাটের চেষ্টা করে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, বগুড়া-১ আসনের এমপি আবদুল মান্নানের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, রাকসুর সাবেক ভিপি হায়দার আলীর বাড়ি ভাংচুর, দুপচাঁচিয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজানুর রহমান সেলিম খানের বাড়িতে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, এসএ পরিবহনের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, টাকা লুট, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সদর থানা ও শাজাহানপুর থানায়ও তারা হামলা চালায়। ইট ফেলে রাস্তা অবরোধ করা হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নন্দীগ্রাম উপজেলায়। নন্দীগ্রাম থানা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসসহ পনেরোটি অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে আগুন দেয়। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল আশরাফ জিন্নাহর বাড়ি ভাংচুর ও আগুন দেয়া হয়। শুধু এ উপজেলায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে কাঠের গুঁড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। বিআরটিসির বাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সাবগ্রামে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়, শাজাহানপুরের ফটকি সেতুর রেলিং ভেঙ্গে ফেলা হয়। জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা শহরের সাতমাথাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জানমাল ও সরকারী সম্পদ রক্ষায় গুলিবর্ষণ করলে নারীসহ হামলাকারীদের ১৩ জন নিহত হয়। সন্ত্রাসীদের হামলায় কয়েক পুলিশ গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহর ও কয়েকটি উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, এরপর তাকে চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজবে নাশকতার মামলার ঘটনায় ৯৪ হাজার জনকে আসামি করে পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তরা ৫৬ মামলা করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা ৫২ মামলায় দুই হাজারের বেশি আসামির বিরুদ্ধে চার্জশীট দেন। অবশিষ্ট মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, সরকারী দলের আইনজীবীরা অনেক আসামিকে আওয়ামী লীগ সাজিয়ে জামিনে সহায়তা করেছেন। ফলে এসব মামলার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে গত পাঁচ বছরে মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় এলাকাবাসীর মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আসামিদের প্রায় সবাই জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থক। এর মধ্যে কারও বিচার হয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতরে কোন তথ্য নেই বলে পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সাঈদীর মৃত্যুদ- ঘোষণার হয়েছে, বগুড়ার বিভিন্ন মসজিদে মাইকে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে, পরিকল্পিতভাবে এমন গুজব ছড়িয়ে সারাদেশের ১২ উপজেলায় একযোগে তা-বলীলা চালায় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে। উপজেলা পরিষদ ও থানায় হামলার পাশাপাশি ছয়টি পুলিশ ফাঁড়ি, অফিস আদালত, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় তারা। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ করে কারাবন্দী সাঈদীকে মুক্ত করার যড়যন্ত্র করা হয়েছিল। সে দিনের নারকীয় তা-বলীলার নৃশংস ভয়াবহতার কথা মনে হলেই এখনও অনেকে আঁতকে ওঠেন।
×