ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চবি ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ স্থাপনা, বদলে গেছে দৃশ্যপট

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

চবি ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ স্থাপনা, বদলে গেছে দৃশ্যপট

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ এক সময়ে মৌলবাদী জামায়াত-শিবিরের দুর্গ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাস। শিবিরের দুর্ধর্ষ সিরাজুস-সালেহীন বাহিনীর দাপটে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জিম্মি। সময়ের পরিক্রমায় সেদিন এখন আর নেই। বদলে গেছে পুরো দৃশ্যপট। মহান মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনাবিরোধী সকল অপশক্তি লেজ গুটাতে বাধ্য হয়েছে। ক্যাম্পাসের পরতে পরতে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের ঝা-া উড্ডীন। এ যেন নবোদ্দীপনায় ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়, টিলা ও সবুজের ঘেরায় অনিন্দ্য সুন্দর অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু’- এ স্লোগানে বর্তমানে মুখর হয়ে আছে গোটা ক্যাম্পাস। তবে বিচ্ছিন্ন অনাকাক্সিক্ষত যেসব ঘটনা এখন ঘটছে তা সরকারী দল সমর্থিত ব্যানারে কয়েকটি গ্রুপের একক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। তবে এসব বিষয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তির পর্যবেক্ষণে রয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও রয়েছে সতর্কাবস্থানে। সরকারী বরাদ্দে গেল প্রায় তিন বছরেরও অধিক সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ হয়েছে এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে তা অতীতের সকল রেকর্ডকে হার মানাচ্ছে। প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী ৮ শতাধিক শিক্ষক প্রায় ১৯শ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ১৩টি হল ও হোস্টেল নিয়ে বিদেশী একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দেশে র‌্যাংকিংয়ে এক ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার মর্যাদা দিয়েছে। এসবের নেপথ্যে রয়েছে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরকারের দৃঢ়চেতা মনোভাবও ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাশক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের মূল ফটক থেকে শুরু করে ক্যাম্পাস অভ্যন্তরভাগ সেজেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। যাতে কবরস্থ হয়েছে অতীতের কলঙ্কময় অধ্যায়গুলো। রচিত হয়েছে নতুন এক আলোকবর্তিকা। এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসাধ্যও সাধন হয়। যার যে অবস্থান থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে আকাশ ছোঁয়ার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। এসব কথা এখন চবিতে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠার অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখ থেকে প্রতিটি বাঁকে বাঁকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং যাদের অবদানে এদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জন তা নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে নানা স্থাপনা। যা উজ্জ্বল এক বহ্নিশিখার মতো দেদীপ্যমান। কয়েক বছর আগের ও ক্যাম্পাসের বর্তমান চিত্র মেলাতে গেলে যে কেউ ক্ষণিকের তরেও হলেও থমকে যেতে বাধ্য হবেন। যেখানে দীর্ঘ সময়জুড়ে ছিল মৌলবাদী ক্যাডার বাহিনীর ঘাঁটি এবং সে ঘাঁটিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি এখন শক্ত অবস্থানে। ফলে এগিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। নব পর্যায়ে নান্দনিক ছোঁয়ায় আলোকিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। একদিকে নান্দনিকতার ছোঁয়া, অন্যদিকে স্বাধীনতার মূল চেতনা বিকশিত হওয়ার অসাধারণ কীর্তিকলাপ। চোখ জুড়িয়ে যায়, হৃদয়জুড়ে বুলিয়ে দেয় অনাবিল শান্তির পরশ। মুক্তিযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শহীদদের ছবি ও নাম সংবলিত ‘স্তম্ভ’-যার নাম ‘স্মরণ’, দৃষ্টিনন্দন ‘জয়বাংলা’ ভাস্কর্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু পুত্র শেষ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের নামে প্রতিকৃতি নিয়ে নির্মিত হয়েছে স্থাপনা। এছাড়া বদলে যাচ্ছে পুরনো শহীদ মিনার। বাঙালী ও বাংলাভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের নিয়ে যে আবেগের স্থান-সে শহীদ মিনার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত হচ্ছে। সর্বত্র নতুনত্ব ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। এসব চিত্র বাহ্যিক। অভ্যন্তর ভাগের চিত্রেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। বিভিন্ন বিভাগে নতুন নতুন গবেষণা কর্ম, বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা, নতুন হল নির্মাণ, হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস নিয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা, মেডিক্যাল সেন্টার, বিশ্বমানের কয়েকটি বিভাগ, মনোরোগ সারাতে কাউন্সেলিং সেন্টার, ক্রীড়া ও শরীর চর্চার অনন্য মিশেল, দুস্থ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রকল্প, মসজিদ-মন্দির নির্মাণ এবং সর্বোপরি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও উন্নয়নে আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য প্রণীত হয়েছে মাস্টার প্ল্যান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীদের ১২টি আবাসিক হল ও একটি হোস্টেল। বর্তমান সরকারের বিগত আমল থেকে শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হর নির্মাণ কাজ। যা বর্তমানে চালু হওয়ার শেষ পর্বে রয়েছে। নির্মিত হয়েছে শেখ হাসিনা হল। যা ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। নির্মাণ কাজ চলছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল এবং অতিশ দীপংকর হল। যার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এসব হলের মধ্যে দুটি হলে ছাত্রদের। অবশিষ্ট দুটি ছাত্রীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ সংলগ্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ জিমনেসিয়াম। এর নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ শেখ কামাল’ জিমনেসিয়াম। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শের ওপর উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রবর্তন হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’। প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’। যা জাতির পিতাকে নিয়ে আলোকছটায় আলোকিত। ১৭৩২ একর জমি নিয়ে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠের অবস্থান। বছরের পর বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন জমি নিয়ে কোন সীমানা ছিল না। ৫শ একর জমির জরিপ করানো হয়নি রহস্যজনক কারণে। এসব জমি নিয়ে ছিল বিরোধ। সে বিরোধের অবসান হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দীর্ঘ সীমানা প্রাচীর। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য প্রণীত মাস্টার প্ল্যান কাজও শুরু হয়েছে। ফলে বদলে যাচ্ছে প্রতিটি বিভাগের কার্যক্রম। ছোঁয়া লেগেছে ডিজিটাল রূপান্তরের। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হালদা নদী নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা হয়েছে তাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা কাজ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টি কেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠা পেয়েছ ই-লার্নিং সেন্টার, যার নাম এ্যাক্সিসিবল ই-লার্নিং সেন্টার। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেসব মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট রয়েছে সেসবের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে চবি কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে রয়েছে ২১ মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট। বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে ছাড়াও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেনের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফরেস্ট্রি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসের সম্মুখ স্থানে, যা নব প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জানান দিতে থাকবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অতীত ইতিহাস। এসব বিষয়াদি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মশাল নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকা- এগিয়ে চলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি বাঙালি জাতি ঋণী। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ শ্রদ্ধারই বহির্প্রকাশ। তিনি জানান, বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতার যে দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছেন তাতে এ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রতি ঋণীই হয়ে থাকবে।
×