ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ শুরু

অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও চিকিৎসাসেবার মান বাড়েনি

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও চিকিৎসাসেবার মান বাড়েনি

নিখিল মানখিন ॥ কর্মসূচী গ্রহণ, জনবল নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও দেশের সরকারী চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যসেবার মান প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তার চাপ গিয়ে পড়ে বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর। স্বার্থান্বেষী চক্রের সিন্ডিকেট সচল থাকায় সরকারী চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবার মান তেমন প্রশংসা কুড়াতে পারেনি। বর্তমান সরকারও স্বাস্থ্য সেক্টরকে দুর্নীতি ও দলীয় লোকজনের অহেতুক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে পারেনি। বিভিন্ন সময় নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির অনেক ঘটনায় অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র মানুষ জটিল ধরনের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা করাতে পারে না। তবে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় ঘটলে দেশের প্রত্যেক মানুষ স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পাবে। আর বিদ্যমান অবকাঠামোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্বাস্থ্য সেক্টরের সংশ্লিষ্ট জনবলের মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান সারাবিশ্বের অনুকরণীয় হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার শুরু হয়েছে ‘ জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ -২০১৯’। হু হু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফিন্যান্সিং রিসার্চ দলের প্রধান জাহাঙ্গীর এ এম খান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে চার শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারী হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারী ফি বেসরকারী হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারী হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সকল হাসপাতালে ওষুধ ও অন্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোন ঘাটতি নেই। বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ ॥ বেসরকারী হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা। কোয়াক চিকিৎসক ॥ দেশের চিকিৎসা সেক্টরের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন কোয়াক চিকিৎসকেরা। এ ধরনের চিকিৎসকদের থাকে না কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ও অভিজ্ঞতা। কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তারা কিছু চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করেন। সেই সীমিত জ্ঞান দিয়ে তারা নিজেদের মতো করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যান। এতে অনেক রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা নেই ॥ বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এতে বয়স্ক নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে এখনও বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। বয়স্ক ও অন্য বয়সী রোগীর রোগ ও রোগের চিকিৎসার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বয়স্ক হলে রোগই দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে না বা বয়স্করা সেগুলো ঠিকমতো অনুভব করেন না বা ভালভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায়, খুব জটিল বা মারাত্মক অসুখে বৃদ্ধ রোগী সাধারণ অবসাদ, দুর্বলতা, অস্বস্তি এ ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ যা বলেন ॥ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও উন্নয়ন অতুলনীয় এবং বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার এমন অবকাঠামো বিশ্বের কোথাও নেই। বিশ্বের অনেক দেশের চিকিৎসাসেবা অত্যাধুনিক হতে পারে। কিন্তু ওই সব দেশে স্বাস্থ্যসেবার ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মতো শক্তিশালী নয়। ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব জনকণ্ঠকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বিদ্যমান জনস্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ। চলমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওই অবস্থার জন্য থাকতে হবে বাড়তি প্রস্তুতি। কিন্তু ওই ধরনের প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বর্তমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। যেখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন রশিদী-ই মাহবুব। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় সমন্বিত কার্যক্রম নেই ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ অন্য অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিক নির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের শতভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। অভিযোগ ॥ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জনবল বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি সরকারী চিকিৎসাসেবায়। সরকারী হাসপাতালে জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেই বেসরকারী চিকিৎসাসেবা। দেশের অধিকাংশ মানুষ বেসরকারী হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না। অসুস্থতার চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। সরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ সঙ্কুচিত করে তুলছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। আর এমন অবস্থায় দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ধনী সব শ্রেণীর মানুষের জন্য ন্যূনতম মানসম্পন্ন সেবা প্রদান জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক কোন নীতিই বাস্তবে কার্যকর করে তুলতে পারেনি সরকার।
×