ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শৈশবের রঙিন স্মৃতি, গ্রামীণ পণ্যের পসরা

প্রকাশিত: ১১:১১, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

শৈশবের রঙিন স্মৃতি, গ্রামীণ পণ্যের পসরা

মোরসালিন মিজান ॥ আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি/বাঁশি কই আগের মতো বাজে না/মন আমার তেমন যেন সাজে না/তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি...। ছেলেবেলাটাকে, সত্যি, দূরে কোথাও ফেলে এসেছে বাঙালী। গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলা আর নেই। প্রায় হারিয়ে গেছে। এখন মেলা মানে মেলার রঙিন স্মৃতি। শৈশবের সে স্মৃতিকে জাগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন- বিসিক। সরকারী সংস্থাটি বাংলা একাডেমি চত্বরে আয়োজন করেছে বৈশাখী মেলার। গত কয়েক বছরের ধারবাহিকতায় এবারও পহেলা বৈশাখে মেলার আনুষ্ঠনিক উদ্বোধন করা হয়। তার পর থেকে চলছে। পরিসরটি খুব বড় নয়। আবার ছোটও বলা যাবে না। বৃক্ষ শোভিত চত্বরে শতাধিক স্টল। একটা সরল উপস্থাপনা। প্রতিদিনের গ্রামীণ জীবন, সমাজ, সংস্কৃতির ছবি তুলে ধরার আন্তরিক চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন স্টলে লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন। গ্রামীণ ঘর-গৃহস্থালি। মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেত শিল্প, কাঁসা ও পিতল শিল্প, সূচি শিল্প, শোলা শিল্প, দারুশিল্পÑ কী নেই! বিভিন্ন জেলার লোক ও কারুশিল্পীরা, প্রসিদ্ধ কারিগররা নিজেদের তৈরি পণ্যসামগ্রী দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন। শহরে শৌখিন মানুষ কৌতূহলী চোখে দেখছেন। চলছে কেনাকাটা। মঙ্গলবার একাডেমি চত্বর ঘুরে দেখা যায়, পুরোটা জুড়ে স্টল সাজানো হয়েছে। বাঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য খুব চোখে পড়ে। কুলা তৈরি করা হয়েছে। আছে চালুনি। বিভিন্ন আকারের ঝুড়ি তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথায় বিশেষ যে টোপরটি পরেন কৃষকেরা, বাঁশ দিয়ে বানানো সে টোপরও দেখা যাচ্ছে মেলায়। মহিলারা এসব কাজ বেশি করছেন বলে জানা যায়। মেলার একাধিক স্টলে মৃৎশিল্পের নিদর্শন। আছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি। শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা চিত্রিত হাঁড়ি অনেক দূর থেকে দৃষ্টি কাড়ে। ছোট ছোট হাঁড়ির গায়ে উজ্জ্বল রং। দারুণ সব চিত্রকর্ম। ফুল-লতা-পাতার নক্সা। খ্যাতিমান শিল্পী সুশান্ত পালের ছেলে সঞ্জয় পাল স্টলে বসেই হাঁড়িতে তুলির আঁচড় দিয়ে যাচ্ছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা আমাদের বাপ দাদাদের পেশা। বহুকাল ধরে তারা শখের হাঁড়ি তৈরি করে এসেছেন। এখন আমরা করছি। এক সময় কুটুম বাড়িতে মিষ্টি পিঠা ইত্যাদি পাঠাতে শখের হাঁড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন গৃহসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয় বলে জানান তিনি। মৃৎশিল্পের আরেকটি স্টলে পোড়ামাটির পাত্র। পটারি। চায়ের কাপ পিরিচ। প্রতিটি কাজ নিখুঁত। শিল্পী মনের খেয়াল পাত্রের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘পোড়া মাটির নক্সা ঘর’ নামের স্টলটি পরিচালনা করছেন আবুল কালাম মিয়া। তিনি বলেন, ঢাকার রায়ের বাজারে ১৯৭৫ সালে এই কাজ শুরু করেছিলাম আমি। তখন সেখানে শত শত হিন্দু বাড়ি। পাল বংশের লোকেরা কাজ করেন। মুসলমানদের মধ্যে এই চর্চা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। মরণচাঁদ পালের কাছে কাজ শিখি। বিখ্যাত শিল্পীর শিক্ষাটা এখনও ধরে রেখেছেন বলে জানান তিনি। শোলাশিল্পের একটি স্টলেও আছে ফুল পাখি। শোলা কেটে গোলাপ বেলি শাপলা বানানো হয়েছে। আছে বানর, কুমিরও। তৈরি করা হয়েছে গরুরগাড়ি। বরের বিশেষ টোপরটিও দারুণ সুন্দর করে গড়েছেন। মেলায় কাঁসা ও পিতল শিল্পের নিদর্শন দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন ধামরাইয়ের দিলীপ সরকার। মেয়েদের হাতের বালা, গলার হার গড়েছেন তিনি। বেশ আকর্ষণীয়। এখনও এসব কেউ পরেন? জানতে চাইলে কারিগর বলেন, যারা কদর বুঝেন তারা পরেন। ঘরে ব্যবহার করেন কাঁসা পিতলের সামগ্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছেন পারভীন আক্তার। তার নক্সিকাঁথার সংগ্রহ যথারীতি মুগ্ধ করে। মেলায় তাঁতের শাড়ি, থ্রিপিস ইত্যাদিও পাওয়া যাচ্ছে। এক কোণে আছে লোকজ বাদ্যযন্ত্রের স্টল। কুষ্টিয়া থেকে একাধিক কারিগর নিজেদের তৈরি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছেন। একটি স্টলে বাউলের সাধানযন্ত্র একতারা। কেউ শখ করে কিনছিলেন। কেউ হাতে নিয়ে চেষ্টা করছিলেন সুর তোলার। অন্য একটি স্টলে শুধু বাঁশি। বাঁশের বাঁশি দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন ঢাকার কারিগর লাল মিয়া। তার স্টলে বাঁশের বাঁশির এত জাত দেখে অবাক হতে হয়। কোনটি আকারে ছোট। কোনটি বড় বা মাঝারি। নামের দিক থেকেও ভিন্নতা আছে। একটিকে বলা হচ্ছে মুখ বাঁশি। অন্যটি আঁড় বাঁশি। লাল মিয়া জানান, এলিফ্যান্ট রোডে থাকেন তিনি। সেখানে সারাবছর বাঁশি তৈরির কাজ করেন। চমৎকার বাজাতেও পারেন। বললেন, এটা সাধনার বিষয়। হুজুগে শিখতে চাইলে কেউ সফল হবেন না। আলাদা করে বলতে হয় মিষ্টান্নর কথা। মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের মিষ্টি নিয়ে এসেছে সোনারগাঁওয়ের কারিগররা। বড় একটি স্টলে কদমা, বাতাসা, মোড়ালি, আঙ্গুরী, আমিরতি, উখড়া, নিমকি, নকুল দানা, লাড্ডু আরও কত কী! দেখে শৈশবে ফিরে যাবেন যে কেউ। বাইয়োস্কোপ, পুতুল নাচ ইত্যাদিও আছে মেলায়। ঘুরে আসুন। দেখে আসুন ফেলে আসা দিন। স্মৃতি হয়ে যাওয়া বৈশাখী মেলা। দশদিনের আয়োজন চলবে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত।
×