ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চিঠি গ্রামীণফোনকে ॥ দাবি বেআইনী বলছে সংস্থাটি

বকেয়া সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা দাবি বিটিআরসির

প্রকাশিত: ১১:০২, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

বকেয়া সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা দাবি বিটিআরসির

ফিরোজ মান্না ॥ গ্রামীণফোনের কাছে বকেয়া সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন)। পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য গ্রামীণফোনকে ১০ কার্যদিবস সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কিন্ত গ্রামীনফোন টাকা পরিশোধ না করে বিটিআরসিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। গ্রামীণফোন মঙ্গলবার বিটিআরসির অডিটকে ভিত্তিহীন ও বেআইনী বলেছে। তারা বিটিআরসির অডিট প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে। বিটিআরসি বলছে, গ্রামীণফোনের এ ধরনের বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কোন অপারেটর নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে এভাবে চিঠি দিতে পারে না। বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেছেন, গ্রামীণফোন বিটিআরসিকে কি চিঠি দিল আর না দিল এটা দেখার বিষয় না। চিঠি দিলেও টাকা তাদের দিতেই হবে। সরকারের এত টাকা না দিয়ে তারা বছরের পর বছর ব্যবসা করে যাচ্ছে। ব্যবসা করতে হলে সরকারের পাওনা টাকা দিতে হবে। বিটিআরসি জানিয়েছে, বিটিআরসির নিরীক্ষা (অডিট) অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে বিটিআরসি পাওনা ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি এক লাখ টাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পাওনা ৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) চিঠি দেয়া হয়েছে। নিয়োগকৃত অডিট ফার্মের অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে ও সর্বশেষ বিটিআরসি কমিশনের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা টাকা চেয়ে এ চিঠি দেয়া হয়েছে। এই টাকা অনেক বছর আগের। মূল পাওনা ছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। সুদ বেড়ে এত বিশাল অঙ্কের টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিটিআরসির পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য গ্রামীণফোনকে ১০ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছে। তারা এই সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অডিটের ভিত্তিতে পাওনা টাকা চেয়ে গ্রামীণফোনের কাছে চিঠি দেয় গত বছর। সেটি রিভিজিট বা পূর্ণ মূল্যায়নের জন্য বলে গ্রামীণফোন। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি পুনরায় মূল্যায়ন করে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে বিটিআরসির পুনর্মূল্যায়নেও আপত্তি রয়েছে গ্রামীণফোনের। দ্বিতীয় মূল্যায়নের পরও গ্রামীণফোনের আপত্তিকে মেনে নেয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, গ্রামীণফোনকে পুরো টাকা দিতে হবে। তারা এ টাকা না দিয়ে পার পাবে না। দুই বার অডিট করার পর সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে। তাদের যে সময় দেয়া হয়েছে-ওই সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে আইন অনুযায়ী যা করার তাই করা হবে। এখানে কোন আপোস করার কিছু নেই। এদিকে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক পরিচালিত অডিটে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার দাবিকে ‘আইনগতভাবে ভিত্তিহীন’ বলে অভিহিত করেছে গ্রামীণফোন। মঙ্গলবার বিটিআরসিকে দেয়া এক চিঠিতে গ্রামীণফোন যুক্তিহীন অডিট প্রত্যাহার করার দাবি করে একটি যুক্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। বিটিআরসি ২ এপ্রিল ২০১৯ সালে একটি দাবিনামার মাধ্যমে গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসিকে ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি এক লাখ টাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা পরবর্তী ১০ কর্মদিবসে পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়। বিটিআরসি কর্তৃক নিয়োগকৃত জেভিসিএ অব তোহা খান জামান এ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি অডিট ফার্ম গ্রামীণফোনের ১৯৯৭ সালের যাত্রা থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ইনফরমেশন এ্যান্ড সিস্টেম অডিট পরিচালনা করে এই টাকা দাবি করে। এই অডিটে বিটিআরসি কর্তৃক দাবিকৃত ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি এক লাখ টাকার মধ্যে প্রায় ৭৩ ভাগ বা ৬ হাজার ১৯৪ কোটি ৩ লাখ টাকাই হলো সুদ যা ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ধরা হয়েছে। বিটিআরসি আর একটি ইনফরমেশান এ্যান্ড সিস্টেম অডিটের মাধ্যমে ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সালের গ্রামীণফোনের কাছে থেকে ৩ হাজার কোটি ৩৪ লাখ টাকা পাবে বলে দাবি করে। সুপ্রীমকোর্টের এ্যাপীলেট ডিভিশন সেই অডিটের অডিটর নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। বিটিআরসি ১৯৯৭-২০১১ সময়কালের পূর্ববর্তী অডিটের দাবি নিয়ে আদালতে একদিকে তাদের আইনগত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সালের অডিটে এখন ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দাবি করছে। ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কালের জন্য বিটিআরসি দু’টি দাবি করছে। গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি বলেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সঙ্গে অনেকবার আলোচনা এবং অডিটরকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করার পরেও আমাদের যুক্তিগুলো অডিট প্রতিবেদনে প্রতিফলিত না হওয়া খুবই দুঃখজনক। অডিট চলাকালীন সময়ে আমরা বার বার অডিট প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো তুলে ধরেছি। কিন্তু আমাদের মতামতকে দাবিনামায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে অডিটের প্রতিবেদনের ওপরে আনুষ্ঠানিক জবাব দিতে বলে। গ্রামীণফোন নির্ধারিত সময়ে সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও যুক্তি দাখিল করে। কিন্তু বিটিআরসি তাদের দাবিনামায় শুধু ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে পর্যন্ত দেয়া গ্রামীণফোনের ব্যাখ্যা আমলে নিয়েছে। রাজস্ব বোর্ডের পাওনা বিষয়ে ( যেটি মোট দাবিকৃত টাকার ৩২ ভাগ) গ্রামীণফোনের বক্তব্য হলো, রাজস্ব বোর্ডের হয়ে টাকা দাবি করার কোন এখতিয়ার বিটিআরসির নেই। এই পরিস্থিতিতে অডিটের দাবি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে গ্রামীণফোন বিটিআরসিকে একটি সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আবারও আলোচনার দাবি জানাচ্ছে। গ্রামীণফোনের এই বক্তব্যকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছে বিটিআরসির এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য অপারেটরের কাছ থেকে কোনভাবেই কাম্য নয়। তারা সময় মতো টাকা পরিশোধ না করে বিটিআরসির অডিটকে মিথ্যা ভিত্তিহীন বলার সাহস কোথায় পেয়েছে। প্রথম দফার অডিটে গ্রামীণফোন আপত্তি তোলার পর তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আবার অডিট করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফার অডিটে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি টাকা পাওনা পাওয়া যায়। সেই টাকা পরিশোধ না করে নানা টালবাহানা করছে। তারা বিটিআরসিকে মিথ্যা প্রতারক সংস্থা হিসেবে অপবাদ দিয়েছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া হবে না। তাদের পুরো টাকাই পরিশোধ করতে হবে।
×