ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেনাপোল স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতিতে রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

বেনাপোল স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতিতে রেকর্ড

স্টাফ রিপোর্টার বেনাপোল ॥ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে রাজস্ব ঘাটতিতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬শ’ ৪ কোটি টাকা। বেনাপোল বন্দর-কাস্টমসের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও একশ্রেণীর আমদানিকারক-সিএ্যান্ডএফ এজেন্টদের শুল্ক ফাঁকির কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তাসহ দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বলে বিস্তার অভিযোগ বন্দরের একাধিক সূত্রের। আর কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির কারণেই সরকারের রাজস্ব আদায়ে ভাটা পড়েছে বলে অভিযোগ। কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সপ্তাহে সাতদিনে ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্যসেবা। এতে সরকার রাজস্ব হারালেও লাভবান হচ্ছেন একশ্রেণীর কর্মকর্তা এবং কতিপয় আমদানিকারক ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়। সেই হিসেবেই এই বন্দরে ৫ হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা বলে ব্যবসায়ীদের অভিমত। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজের কারণে প্রথম থেকে এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বন্দরে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা আর ব্যবসায়িক হয়রানির কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আসছে না। দেশের ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩ বন্দরের অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। বেনাপোলের স্থলবন্দরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য দেশে যতগুলো বন্দর রয়েছে তার মধ্যে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর হলো বেনাপোল। এর কারণ যেদিন ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় সেই দিন থেকে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যেই আমদানিকৃত পণ্য বন্দরে প্রবেশ করে। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাটা দেশের অন্য যে কোন বন্দরের তুলনায় উন্নত। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। সে কারণে দেশের প্রায় ৮০ ভাগই পণ্য এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়ে দেশে প্রবেশ করে। এই সুবিধা পেয়ে দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা এই বন্দর দিয়ে মালামাল আমদানি করে থাকেন। সূত্র বলেছে পণ্য আমদানির বেলায় এই বন্দরে চলে নানা অনিয়ম। কখনও পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, আবার ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য এনে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়। আর এসব কাজে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে সহযোগিতা করে কাস্টমসের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। সূত্র অভিযোগ করে বলেছে এই বন্দরে বর্তমানে একশ’ টাকার রাজস্ব ফাঁকিতে কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যক্তিটিকে দিতে হয় ৬০ টাকা। ১ লাখে দিতে হয় ৬০ হাজার টাকা। আর কোটি টাকার ফাঁকিতে দেয়া লাগে ৬০ লাখ টাকা। এতে লাভবান হয় আমদানিকারক, সিএ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ও কাস্টমস কর্মকর্তারা। আর চরম ক্ষতির মধ্যে পড়ে সরকার। কাস্টমস সূত্র থেকে জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক বেনাপোল কাস্টমস হাউসে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে আদায় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ঘাটতি রয়েছে ৬০৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। একইভাবে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কিন্তু বিশেষ করে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তাসহ দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় শুল্ক ফাঁকি দেয়ার কারণে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। গত অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বন্দরে গতিশীলতা বাড়াতে এখানকার বাণিজ্যে জড়িত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরস্পরের সমন্বয়, বৈধ সুবিধা দেয়া ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। আর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে তারা সমন্বয় করে কাজ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সব বন্দরে আমদানি পণ্যের ওপর রাজস্ব পরিশোধের নিয়ম এক হতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যের ওপর রাজস্ব ৪ ডলার, বেনাপোল বন্দরে ওই একই পণ্যের ওপর সাড়ে ৪ ডলার শুল্ক আদায় করা হচ্ছে। বন্দরের ধারণ মতা ৩৮ হাজার টন। কিন্তু এখানে সব সময় পণ্য থাকে প্রায় দেড় লাখ টন। জায়গার অভাবে পণ্য খালাস করতে না পেরে ভারতীয় ট্রাক বন্দরে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বৈধ সুবিধা পেলে এ বন্দর থেকে বর্তমানে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে তখন তার দ্বিগুণ আয় হবে। বেনাপোল কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকেদের বলেন, ‘এই বন্দরে কাস্টমস আইন এবং নিময়-কানুন যথাযথভাবে প্রযোগ করার কারণে আমদানিকারকরা এই বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে আমার ধারণা।’ কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমদানিকারক বা সিএ্যান্ডএফ এজেন্টরা এটা বলতে পারেন, এটা তাদের বক্তব্য। আমার ধারণা অবশ্য ভিন্ন। দেশে আরও বন্দর আছে, আমাদের যথাযথ আইন প্রয়োগ করার কারণে তারা অন্যত্র চলে যেতে পারেন। এটা অবশ্য আমার ধারণা।’ বেনাপোল কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার জাকির হোসেন সাংবাদিকদের জানান, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ার কিছু কারণ আমরা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছি। আগামীতে সেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য থাকবে। তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন। বেনাপোল কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘আমদানি কম হলে তো রাজস্ব আয় কম হবেই।’ আমদানি কেন কমেছে, তার উত্তরে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের কারণে আমদানি কম হতে পারে। সেটা আমরা দেখছি। তাছাড়া কাস্টমসে সব কাজ সম্পাদন করেই শুল্ক করাদি আদায় নিশ্চিত করতে হয়। আইন এবং নিয়মকানুন অনুযায়ী পরিপালন করে ডিউটি নির্ধারণ করা হলে আমদানি ও রফতানিকারক সেটা দিতে বাধ্য। আর এ কারণে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, এটা সঠিক নয়।’ এদিকে দেশের অন্যতম এই স্থলবন্দরে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা সম্প্রতিকালে অনেকাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক শ্রেণির অসাধু আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণা ও ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করছে। সবচেয়ে বেশি ফাঁকি হচ্ছে এ্যাসোটেড জাতীয় পণ্য আমদানির বেলায়।
×