ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে আজ কত কথা মানসপটে ভেসে উঠছে। ’৭১-এর ২৫ মার্চ দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির জনকের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি, সেই নির্দেশিত পথে তোমরা এগিয়ে যেও। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আমার কথা ভেব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাকে গ্রেফতার করবে। হয়তো ওরা আমাকে ফাঁসির দ-ে দ-িত করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।’ অসাধারণ দৃঢচেতা মহান নেতা ছিলেন জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ রাতে মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে আমরা অবস্থান করি। রাত ১২টায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচ- গোলাগুলি। এক রাতেই পাকবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরও আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি। ’দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিস্ড।’ তারপর ২৬ তারিখ থেকে কারফিউ জারি হয়। ২৭ তারিখ ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানীগঞ্জ চলে যাই। কেরানীগঞ্জ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওতে শুনতে পেলাম চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নানের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ তথা ‘উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’-এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব এবং এএইচএম কামরুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো, মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বলেছিলেন, ‘এখানে থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি।’ এপ্রিলের ৪ তারিখ আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোসহীন, এক কাতারে দ-ায়মান। এপ্রিলের ১০ তারিখ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নব-নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়; ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্ত্বর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে বলতে হয়, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সনদ। এই সনদ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কোলকাতা থেকে একটা গাড়িতে করে রাত ৩টায় রওয়ানা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশী-বিদেশী অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান বাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ এবং ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবকালীন দৃশ্যপট। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা গগনবিদারী স্বরে ‘জয়বাংলা’ জয়ধ্বনি দিল। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহণ করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের (এসপি মাহবুব, বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র (গবসনবৎ ড়ভ ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সনদ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সকলেই তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজীতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তাঁর পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তাঁরা বলেছেন। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতাম আমি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা শ্রী দুর্গাপ্রসাদ ধর (যিনি ‘ডিপি ধর’ নামে পরিচিত) মাঝে মাঝে কলকাতার হোটেল ‘হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল’-এ আমাদের মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করতেন। মিস্টার ব্যানার্জী (যার ছদ্মনাম ছিল মিস্টার নাথ) নামে ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এই সাহায্য আমি মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতাম। দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং হতো। সেখান থেকে মুজিব বাহিনীর সদস্যবৃন্দ দমদম বিমানবন্দরে নামার পরে ব্যারাকপুরে নিয়ে যেতাম। সকলেই তখন নিরলস পরিশ্রম করেছি। দেরাদুনে প্রশিক্ষণ শেষে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানি না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার নির্দেশিত পথে আমরা এ যুদ্ধ চালিয়ে যাব এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ আজ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। আজকাল মাঝে মাঝে অনেকের অনেক বক্তব্য শুনি যার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। আসলে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যা কিছু হয়েছে, তার সবকিছুই বঙ্গবন্ধু পূর্বেই ঠিক করে রেখে গিয়েছিলেন। ভারতে গেলে কোথায় সাহায্য পাব, কিভাবে সরকার গঠিত হবে, সবকিছুই হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে জাতীয় নেতা শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দীন ভাই, ভারতে গিয়ে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে ভারত সরকারের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে প্রভূত সাহায্য প্রদান করেছেন। অনেকেই অনেক কথা বলে যে, মুজিব বাহিনীর সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের ভুল বোঝাবুঝি ছিল। কথাটি মোটেই সত্য নয়। সরকারের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে আমি নিয়মিত ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে সরকারের দফতরে যেতাম। জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে সবকিছু তাদের অবহিত করতাম। আমরা যে মুজিব বাহিনী গঠন করেছিলাম তার প্রকৃত নাম ছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ সংক্ষেপে বিএলএফ। সেটাকেই আমরা বঙ্গবন্ধু মুজিবের নামে ‘মুজিব বাহিনী’ নামকরণ করেছি। অনেক অজানা ইতিহাস রয়েছে। একদিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি আরেকদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সেই মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী। তাঁর বিচার চলছে। বিচার চলাকালে ডিফেন্স ল’ইয়ার হিসেবে একে ব্রোহীকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ। বিকজ ইয়াহিয়া খান ইজ দি প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান। ইয়াহিয়া খান ইজ দি চীফ মার্শাল’ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। হি ইজ দি কনফার্মিং অথরিটি অব মাই ডেথ সেনটেন্স। অলরেডি হি টোল্ড, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। যেহেতু রায় দেয়া হয়ে গেছে। সুতরাং আমি নিজেকে ডিফেন্ড করব না। ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অনুরোধ করেছিলেন, আমার একটা অসম্পূর্ণ কাজ রয়ে গেছে সেটা হলো মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে আমি এই কাজটি করতে চাই। ভুট্টো সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানওয়ালী কারাগারের প্রিজন গভর্নর হাবীব আলীকে মেসেজ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে সরিয়ে হাবীব আলীর বাসভবন চশমা ব্যারাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। যাতে কমান্ডো গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পারে। তারপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। আজ দেশের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করে। গত বছর ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ জাতীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। আমি মনে করি, যারা ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করেন না, যারা ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগর দিবস’ পালন করেন না, তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদী মৃত্যুকে বরণ করেছেন তাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতার অনুরোধে স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ’৭২-এর ১২ মার্চ তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ ভারতের সুমহান আত্মত্যাগকে তাচ্ছিল্য করে আজও যারা ‘দেশ বিক্রির’ কথা বলে-বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই তাদের চিহ্নিত করেন ‘অর্বাচীন’ হিসেবে। ২০১৯’র ১৭ এপ্রিল ৪৮তম মুজিবনগর দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে গেছেন,-সেই পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলে দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। [email protected]
×