ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্লুকোমা

প্রকাশিত: ১২:০৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

গ্লুকোমা

আমার বন্ধু বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। তাঁর স্ত্রীকে আমার কাছে চোখে চশমার ব্যবস্থাপত্রের জন্য পাঠায়। ভদ্রমহিলা নিজেও একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বিকেলে চেম্বারে চক্ষু পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম তার চোখ থেকে চোখের ভেতরের তরল পদার্থ বের হওয়ার রাস্তাটা সরু। চশমা দিলাম এবং বললাম আপনাকে কিছু পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজন হলে চোখে লেজার চিকিৎসা করতে হবে। সেই রাতে প্রায় সাড়ে বারোটায় আমার বন্ধু ফোন করল তার স্ত্রীর চোখে প্রচ- ব্যথা। মাথা ব্যথা, চোখে ঘোলা দেখছে। তাড়াতাড়ি বললাম তোমার কাছে একটা স্থানীয় হাসপাতাল আছে ওখানে নিয়ে যাও এবং কিভাবে চিকিৎসা করবে তার একটা দিক-নির্দেশনা দিলাম। বন্ধু নিজে চিকিৎসক বলে তার স্ত্রীর চিকিৎসা সেই রাতে খুব তাড়াতাড়ি আমি বাসায় বসেই দিতে পেরেছিলাম। সেই যাত্রায় ভদ্রমহিলা খুব ভালভাবেই বেঁচে গিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তার লেজার করে দেয়া হয়। এখন উনি সম্পূর্ণভাবে গত পাঁচ-ছয় বছর ভাল আছেন। নিয়মিত চোখ দেখিয়ে যান। ওষুধ দরকার হলে ওষুধ দেন। কিন্তু সেই রাতে যদি ঠিকমতো সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা না দেয়া হতো এবং তিনি নিয়মিত আমাদের উপদেশ না শুনতেন তাহলে ওনার চোখ ক্রমান্বয়ে খারাপ পর্যায়ে চলে যেত। অন্য একজন রোগীর কথা বলি যিনি আমার কাছে এসে সকাল বেলা কি কারণে বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখে দেখতে গিয়ে দেখেন উনি খুব কম দেখতে পাচ্ছেন। পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি ওই চোখে প্রেসারের কারণে নার্ভ একেবারেই শুকিয়ে গেছে। খুব আফসোস করলাম এই রোগীটা যদি সময়মতো আমাদের হাতে এসে পৌঁছাত এবং সঠিক চিকিৎসা পেত তাহলে চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে তাঁর চোখকে বাঁচানো যেত। এভাবে কত মানুষ কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব নেই। কিন্তু তার পরেও আশাহত হলে চলবে না। আমরা যারা গুøকোমা চিকিৎসা করে থাকি তাদের কাজ এই রোগটা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবার দৃষ্টিগোচর করা। সতর্ক করে দেয়া, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে এবং নিয়মিত ওষুধ নিতে উদ্বুদ্ধ করা। অন্ধত্বের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা আমরা গুøকোমা চিকিৎসকরা এখন কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কারণ আমাদের সচেতন রোগীরা আমাদের কাছে এসেই বলে ডাক্তার সাহেব আমার চোখে প্রেসার আছে কিনা একটু দেখে দেন তো। তাদের এই সচেতনতা আমাকে গর্বিত করে দেয়। আমাদের চোখে কিছু কিছু অন্ধত্ব আছে যার চিকিৎসা করলে আমরা আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাই। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছানি রোগ। অন্যদিকে গ্লুকোমা এমন একটা রোগ যা মানুষকে এমনভাবে অন্ধ করে দেয় যার থেকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসা কোনভাবেই সম্ভব না। গ্লুকোমা অন্ধত্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার॥ণ। এবং সারা পৃথিবীজুড়ে ৬৭ লাখ মানুষ গ্লুকোমা রোগে ভুগছেন। এই রোগ শিশু কিংবা বয়স্ক মানুষ যে কোন কারও হতে পারে। তবে বিশেষ করে যারা চল্লিশোর্ধ, যাদের ডায়াবেটিস, মাইনাস পাওয়ার অথবা যাদের পরিবারে বাবা বা মা গ্লুকোমার রোগী তাদের অবশ্যই নিয়মিত গুøকোমার জন্য চোখ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। চোখের প্রেসার চোখের প্রেসার কিন্তু ব্লাড প্রেসার নয়। চোখের ভেতরে পানির মতো এক জাতীয় পদার্থ আছে যা চোখের নির্দিষ্ট আকার এবং চোখের ভেতরের জিনিসপত্রের খাদ্য যোগান দেয়। এই তরল পদার্থ চোখের ভেতরে নির্দিষ্ট হারে তৈরি হয় এবং নির্দিষ্টভাবে অন্য রাস্তা দিয়ে বের হয়ে এসে চোখের প্রেসারের ভারসাম্যতা রক্ষা করে। কোন কারণে এই পানি যদি চোখ থেকে ঠিকমতো বের হতে না পারে কিংবা বেশি পরিমাণে তৈরি হয় তখন চোখে প্রেসার বেড়ে যায়। তাকেই আমরা বলি ‘গ্লুকোমা’। কেন চোখের প্রেসার আপনার চোখের জন্য মারাত্মক আমাদের দৃষ্টিদানকারী একমাত্র স্নায়ু অপটিক নার্ভ চোখের গ্লুকোমার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি নির্ভর করবে আপনার চোখের প্রেসার যত বেশি কিংবা কতক্ষণ ধরে আপনার চোখে এই অতিরিক্ত প্রেসার ছিল অথবা অপটিক নার্ভ আগে থেকেই দুর্বল কিনা তা। সত্যি কথা বলতে কি অতিরিক্ত চোখের প্রেসার খুব অল্পসময়েই চোখের অপটিক নার্ভকে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে চোখের প্রেসার যদি অল্প বাড়ে তা ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টিকে ধ্বংস করে গুøকোমা হলে যে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে কিংবা তার কোন চিকিৎসা নেই এই কথাটা পুরোপরি সত্য নয়। যে দৃষ্টি কমে গেছে সেটা ফেরত আনা সম্বব নয় কিন্তু যত টুকু দৃষ্টি আছে তা ওষুধ, লেজার, অথবা প্রয়োজন হলে সার্জারি করে সেটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তাই গ্লুকোমা হলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে সময়মতো তা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তা মোকাবেলা করুন। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষু বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গুøকোমা বিশেষজ্ঞ, সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ গুøকোমা সোসাইটি [email protected]
×