ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা তাদের জীবন অসহ্য বানিয়ে দেব! ॥ ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

আমরা তাদের জীবন অসহ্য বানিয়ে দেব! ॥ ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল, দিনটি ছিল শুক্রবার। বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। নিজ মাতৃভূমিতে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার লক্ষ্যে মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে নির্বাচিত করা হয়। একাত্তরের এই দিন বিকেলে একটি দল রেকিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা, অপরটি কলকাতা প্রেসক্লাবে যায়। রাঙ্গামাটির খাগড়া রেস্ট হাউসে অবস্থানরত পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ এক প্লাটুন সৈন্যের ওপর ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে অফিসারসহ ২০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। বাকি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সংঘর্ষের পর নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। কুমিল্লার গঙ্গাসাগর ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ্যে পাকবাহিনী প্রবল গুলিবর্ষণ করে। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে স্থানান্তরিত হয়। রাতে আবার মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পারে ইছাখালী বিওপিতে সদর দফতর স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে ভারতীয় বিওপির দূরত্ব মাত্র ৬০০ গজ। সকাল ১১টায় পাকসেনারা পার্বতীপুর থেকে ১টি ট্যাঙ্কসহ ভারি অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভবানীপুরের হাওয়া গ্রামের ডিফেন্সের ওপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ফুলবাড়িয়ার দিকে যাত্রা করলে পিছু পিছু পাকসেনারাও ফুলবাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। ভেড়ামারায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণে সুবেদার মোজাফফর তার বাহিনী নিয়ে পিছু হটেন। সামরিক অবস্থানের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভেড়ামারা পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। দিনাজপুর শহর সম্পূর্ণরূপে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পাকবাহিনী ময়মনসিংহ জেলা দখলে সমর্থ হয়। এরপর পাকবাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ অবলীলাক্রমে চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী কুমিরা থেকে সীতাকুণ্ড এসে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। পাকবাহিনী কুষ্টিয়া দখল করে এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী বিহারীদের জেলখানা থেকে ছেড়ে দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে সারা শহরে পাকসেনারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র দখল নিয়ে দিনব্যাপী মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে আশুগঞ্জ বিদ্যুত কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ করায়ত্ত করার জন্য সংঘর্ষ হয়। কুড়িগ্রাম বাজারের কালিবাড়ী সংলগ্ন ‘চিটাগং ক্লথ স্টোর এ অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী তাদের ক্যাম্প পুরনো ডাকঘর পাড়ার ‘নাহার ভিলায়’ স্থানান্তর করে। ঢাকায় কার্ফুর মেয়াদ সকাল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবিলম্বে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক-খাজা খয়েরুদ্দিন,সদস্য-নুরুল আমিন, একিউএম শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আজম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী, মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল মতিন, অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার, ব্যারিস্টার আফতাব উদ্দিন আহম্মেদ, পীর মোহসেন উদ্দিন, এএসএম সোলায়মান, একে রফিকুল হোসেন, মওলানা নুরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তোয়াহা বিন হাবিব, মেজর (অব) আফসার উদ্দিন, দেওয়ান ওয়ারেসাত আলী ও হাকিম ইরতাজুর রহমান খান। সন্ধ্যায় নুরুল আমিনের নেতৃতে শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ গবর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে জানায়, শত্রু নিধনে তারা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করবে এবং নিজেরাও দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হবে। লন্ডনে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের মুক্তি আন্দোলন খুবই কম দেখা যায়, যার প্রতি সর্বশ্রেণীর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। আবার এই ধরনের আন্দোলন খুব কম দেখা যায়, যেখানে অধিকার আদায়ের জন্য অস্ত্রশস্ত্রের এত অভাব। প্রতিটি জায়গায় পুরো প্রশাসন ব্যবস্থা একান্তভাবে মুক্তি আন্দোলনকারীদের সমর্থন দিয়েছে। কয়েকটি শহরে মুক্তি সংগ্রামীরা এখনও প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছে। মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনূর প্যালেসের ৫ম তলার একটি ফ্ল্যাট তাঁদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। এইদিন ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত’ সিলেট এবং কুমিল্লার ওপর চাপ বজায় রাখছে পাকবাহিনী, ভেস্তে গেল রাজশাহী দখলের প্রচেষ্টা শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রথম তিন সপ্তাহের যুদ্ধের ফলাফল একত্রিত করলে মুক্তিবাহিনীর প্রাপ্তি প্রচুর বলে পরিলক্ষিত হলেও পাকবাহিনী এখন পর্যন্ত দেশের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে মুক্তিবাহিনী উৎখাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। পূর্বদিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সিলেট, চাঁদপুর এবং কুমিল্লার ওপর চাপ বজায় রাখছে এবং মনে হচ্ছে তারা ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী যোগাযোগ পুনর্স্থাপন করতে চাচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে আসা সংবাদমাধ্যম জানায়, মুক্তিবাহিনী আজ সারাদিনই রাজশাহীর দিকে পাকবাহিনীর এগিয়ে আসা ঠেকাতে ব্যাপক যুদ্ধাভিযান চালিয়েছে এবং এখনও শহরের বহির্ভাগে তারা পাহারা বজায় রেখেছে। তিতাস নদীর উজনেশ্বর ব্রিজের ওপর সংঘটিত এক যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছে এবং তাদের পালাতে বাধ্য করেছে। পাকবাহিনী নদী পার হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কব্জা করার সঙ্কল্প করেছিল, যা বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় ময়মনসিংহ শহরের ওপর চলা পাকিস্তানী বিমান হামলা বন্ধ আছে। পূর্বের মতোই পাকবাহিনী সিলেট শহরের উত্তরাংশে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করছে এবং মুক্তিবাহিনী সুরমা নদীর দক্ষিন ভাগ হতে নিজেদের অবস্থান সরিয়ে নিয়েছে। কুমারদহের কাটাখালী নদীর ওপর অবস্থিত ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী এবং এর মাধ্যমে বগুড়ায় তাদের দখল অক্ষত রাখছে। সীমান্তবর্তী শহর কসবায় পাকিস্তানী আর্মি অন্তর্বর্তী জলপথ ব্যবহার করে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে এবং তারা শহরে ভারি মর্টার শেল চার্জ করেছে। কুষ্টিয়া এখনও মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। যদিও আজ রংপুর থেকে দিনাজপুরের অবরুদ্ধ পাকবাহিনী অবমুক্ত করতে পাঠানো একটি সশস্ত্র দল আজ শহরটিতে পৌঁছায় এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে পাওয়া এক খবরে জানা যায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে ঈশ্বরদীতে প্রবল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কুমিল্লা সেক্টরের গঙ্গাসাগর এলাকাতেও চরম যুদ্ধ চলেছে। পাকিস্তানী আর্মি এই অঞ্চলে আক্রমনের সময় ভারী আর্টিলারি বন্দুক ব্যবহার করে, যার শব্দ আগরতলা থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল। আগরতলা থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, পাক আর্মি কুমিল্লা সেক্টরের আখাউড়া নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন দখল করতে বদ্ধপরিকর। এদিন ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুর্দশার চিত্র ফুটে ওঠে... যদি রক্ত হয়ে থাকে মানুষের স্বাধীনতার অধিকারের মূল্য, তবে বাংলাদেশ তা অতিরিক্তই দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যদি বা তাদের আন্দোলন কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস হয়েও যায়, তবে তা মুক্তিযুদ্ধের সাময়িক পরাজয় মাত্র, যা শেষ পর্যন্ত বাঙালীর রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে স্বীকৃত হবে এবং তা খ-ন করা কঠিন হতে পারে, কিন্তু সেটি সবার জন্য সুবিধাজনক নয়। আর এই মুহূর্তে বিবেচিত হতে পারে আমরা এবং অন্য দেশগুলো ‘জাতির আত্মসঙ্কল্পের অধিকার’ এই চমৎকার শব্দগুলো দিয়ে ঠিক কী বুঝি, যা জাতিসংঘের সনদের মধ্যে সমস্বরে উচ্চারিত হওয়া শব্দের মতো মনে হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান কখনোই একটি ‘বিচ্ছিন্নতাকামী রাষ্ট্র হতে পারে না যেমনটি আগে ছিল (বায়াফ্রার মত)। সাড়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানী মনে করে সাড়ে চার কোটি পশ্চিমার মতো তাদেরও জাতীয় সংসদে ‘প্রতিনিধিত্ব’ রয়েছে। এই সত্যটুকু মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত ঠিক কতটুকু মানবীয় দুর্দশা ভোগ করতে হবে? নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছে ‘এই যুদ্ধে নারকীয় অবস্থা কেবল এক পক্ষেরই। পাকিস্তানী সৈন্য ও প্রায় নিরস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানী যোদ্ধাদের মাঝের মাত্র তিন সপ্তাহের পুরনো এই যুদ্ধের এক মাত্র নরক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১০ হাজার সাধারণ মানুষের জীবন, যেটি পাকিস্তানী সেনারা সন্ত্রাস ও সীমাহীন নিপীড়নের মাধ্যমে ধ্বংস করেছিল এবং সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন। বেশিরভাগ বড় শহর নিজেদের আয়ত্তে এসে যাওয়ায়, পাকিস্তানী আর্মি- যার সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা দিয়ে গড়া, তাদের অনেকের ভেতরেই পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি জাতিগত ঘৃণা ধারণ করে আছে। এই সেনাবাহিনী এখন আক্রমণ চালাতে শুরু করছে গ্রামের দিকে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হবে প্রবল বর্ষা। এই ঘোর বর্ষায় নিয়মিত আর্মি চলাচল খুবই কঠিন। তার আগেই তারা চায় তাদের আয়ত্তের সীমানা আরও কিছু দূর এগিয়ে নিতে। ‘তারা এই হাঁটু পানিতে ভুল করবে ও মারা যাবে’, বললেন এক বাঙালী অফিসার। ‘গ্রামের নৌকা ব্যবহার করে আমরা তাদের জীবন অসহ্য বানিয়ে দিব।’ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের পথে এই যুদ্ধ এগুচ্ছে। বেশিরভাগ কূটনীতিক ও বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে বাঙালীরা তাদের থেকে হাজারের বেশি মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানীদের জীবন দুর্বিষহ বানিয়ে তুলবে। যদি না বিদেশী বাণিজ্যিক সাহায্যের কমতি না ঘটে। তবে যে শোষণের প্রতিবাদে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু; সেই যুদ্ধে, পশ্চিম পাকিস্তানের কবল হতে নিজের দেশকে উদ্ধার করতে বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে এই সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর, এটুকু স্বীকার করতেও বাধ্য হচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যা কিছু ঘটছে তা দেখার পর, পাকিস্তানী আর্মির এই সব কার্যক্রমের ন্যাযতা দাবি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্পষ্ট সব তথ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনীকে পাঠানোই হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সকল নেতা ও রাজনৈতিক মাথাদের মেরে ফেলা এবং দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। ‘তারা চায় আমাদের এত নিচে টেনে আনতে যেন আমরা ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হই’, বলছেন এক বাঙালী যোদ্ধা। ‘তাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার মতো যেন কেউই না থাকে, তারা সেটা নিশ্চিত করতে চায়’।’ পাকিস্তানী সেনারা তাদের হত্যা করছে ট্যাঙ্ক, জেট বিমান, ভারি কামান, গানবোট যার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট চায়না থেকে পাওয়া। তাই দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নির্বিচারে বাঙালীদের হত্যা করে চলেছে একের পর এক হামলায় ধ্বংস করছে খাদ্য গুদাম, চা-বাগান, পাট কারখানা, প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া য়ায়। ‘কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীর’ কাজ বলে এই মুক্তিযুদ্ধকে অভিহিত করে প্রতিদিন খবর জানাচ্ছে রেডিও পাকিস্তান ও নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম। ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে’, পাটের পুনরায় রফতানিও চালু হয়েছে এমন সংবাদও দিচ্ছে। যার সবটাই এক ঢাহা নোংরা জালিয়াতি ছাড়া কিছু নয়। পিস নিউজে রজার মুডি লেখেন, ‘সম্প্রতি পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান যা ঘটিয়েছে এবং যা অর্জনের জন্য ঘটিয়েছে তার জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ থাকতে পারে না। যদিও বা ইয়াহিয়া খান সংঘাতহীনভাবে পূর্ববঙ্গের জনগণকে ভারসাম্যহীন অঙ্গরাজ্যে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, এটা সর্বসম্মতভাবেই বিশ্বাসযোগ্য যে, করাচীর সামরিক সরকার পশ্চিমের খাদ্য যোগাতে পূর্বের জনগণের রক্ত ঝরানো অব্যাহত রাখবে এবং এমন এক কৃত্রিম অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করবে যা শীঘ্রই পূর্ববঙ্গের লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার নিজের মনে ধারণা করতে চেয়েছি, পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী এখন যা করছে তা ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ সময়কালীন হিটলারের নীল নকশার চেয়ে কম, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটা গণহত্যা। এই সময়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও লিখিতভাবে পাকিস্তানকে দেউলিয়া অবস্থার সম্মুখীন করবে। এখন এটা খুবই পরিষ্কার যে, পাকিস্তান সরকার বাঙালীর আত্মসমর্পণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। এখন উদ্দেশ্য একটাই হতে হবে, পূর্ববঙ্গের যেখানেই সম্ভব হবে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সকল কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা, যাতে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া কোন উপায় না থাকে।’ লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×