ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

স্বাধীনতা ও মুজিব বাহিনী

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

স্বাধীনতা ও মুজিব বাহিনী

॥ তিন ॥ আমি নিজে মুজিব বাহিনীর অতি সাধারণ একজন কর্মী ছিলাম বলে স্মরণ করতে পারি যে, এই বাহিনী গঠনের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক যুদ্ধ করা, যার রণকৌশল হতো গেরিলা কায়দার। জেনারেল উবান গেরিলা যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলেই তাঁকে এই বাহিনী সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একাত্তরে আমার তো আর দিল্লীর খবর জানার ক্ষমতা ছিল না। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের চাইতে দিল্লীর দূরত্ব যেমন বেশি ছিল তেমনি ছিল অতি নিচু পর্যায়ের একজন ক্ষুদ্র দেশপ্রেমিক তরুণের দিল্লীর লাড্ডুর খবর পাবার ক্ষুদ্রতা। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে বন্ধুরা ছিল তাদের সঙ্গেও থাকতে পারতাম তবে হয়ত এখন ব্যাখ্যা করতে পারতাম ওবান কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলেছেন। এটিও জানতাম মুজিব বাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপটটা কি ছিল। কিন্তু গারো পাহাড়ের ইয়ুথ ক্যাম্পে বসে মুজিব বাহিনীর থানার দায়িত্ব পাওয়া ছাড়া পশ্চাতের কাহিনী আমি জানতে পারিনি। যে ইতিহাস বলছি তা অন্য সূত্রে পাওয়া। আমি পাহাড়ে বসে এমন কথাই শুনেছিলাম যে, আমাদের যুদ্ধটি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং ভারতে থেকে নয়, নিজের দেশে থেকেই যুদ্ধ করতে হবে। আমাকে এটিও বলা হয়েছিল যে, ভারতের অস্ত্র নিয়েও যুদ্ধ করা যাবে নাÑ আমাদের দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তানীদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এমনকি দেশের ভেতরেই প্রশিক্ষণ এবং দেশের ভেতর থেকেই যোদ্ধা সংগ্রহ করার লক্ষ্য নিয়েই আমাদের দেশের ভেতরে আসতে বলা হয়েছিল। আমার বন্ধুরা ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ঢাকা পৌঁছে গিয়েছিল এবং ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অপারেশন করেছিল। মুজিব বাহিনীতে দশ থেকে ষাট হাজার পর্যন্ত মানুষ যুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। এদের অনেকেই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করলেও বস্তুত যুদ্ধটা ব্যাপকভাবে করার সময়টা যখন ডিসেম্বর মাসে এসে যায়, তখন তো ভারত সরাসরি যুদ্ধেই জড়িয়ে পড়ে। যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা অনেকটা প্রলম্বিত হতোÑ যেমনটি হয়েছিল ইন্দোচীনে, তবে তার গতিপ্রকৃতি এবং প্রকৃত রাজনৈতিক মেরুকরণ ভিন্নরকম হতো। ভিয়েতনামের বিভক্তি থেকে তাদের জাতীয় যুদ্ধের চরিত্র পরিবর্তন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা ছেলের হাতের মোয়া নয় যে চাহিবামাত্র পাওয়া যায়। বরং চিত্রটা বিপরীত। বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে সেটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়, ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গঠিত মুক্তিবাহিনীতে একদিকে বাঙালী সশস্ত্রবাহিনী তাদের বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে অংশ নিয়েছে, অন্যদিকে সাধারণ ছাত্র-কৃষক অংশ নিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী শক্তিতে পুরো জাতিকে স্বাধীনতামুখী করতে পেরেছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম গণহত্যা ও অত্যাচার পুরো বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাঙালীকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এর মধ্য থেকে যদি মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তিকে চিহ্নিত করতে যাই তবে সেটির সবচেয়ে বড় উপাদান ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের এমএনএ বা এমপিএ বা দলীয় নেতারা জাতির পিতার নির্দেশে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা তৈরি করেছে ছাত্রলীগ। জয় বাংলা স্লোগান, জয় বাংলা বাহিনী, স্বাধীন বাংলার পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ইশতেহার সবই জাতির পিতার নির্দেশে ছাত্রলীগ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বব্যাপী আন্দোলন ছয় দফা এবং ছয় দফা সংবলিত ১১ দফা নিয়ে আন্দোলনটাও করেছে ছাত্রলীগ। বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাকে বাংলাদেশ আন্দোলনে রূপান্তর করার পুরো কাজটাই ছিল ছাত্রদের। কিন্তু ছাত্রলীগ ছাড়া প্রধান ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও তার দুটি ধারা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ে তোলার রাজনৈতিক দর্শনে যোগ দেয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ, একটি উগ্রবাদী টুকরো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে এই বাহিনীর সকল সদস্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সোনার বাংলার রাজনৈতিক রূপটা উপলব্ধি করতেন না। করার কথাও না। ইপিআর, পুলিশ বা সেনাবাহিনীতেতো রাজনীতি চর্চা হতোনা। তারা কেমন করে জানবেন বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে কিভাবে এক দফার প্রেক্ষিত হিসেবে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ৭০ সালে নৌকায় ভোট দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য। ২৫ মার্চের পর পাক হানাদাররা দেশজুড়ে নির্মম গণহত্যা করার প্রেক্ষিতে অনেককেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র হতে হয়েছে। তাদের রাজনীতির পাঠটাও তো অপূর্ণ ছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের একটি রাজনৈতিক বাহিনী গড়ে তুলতে হলে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোন উৎস থেকে সেই বাহিনীটি গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। মুজিব বাহিনী সেই বাহিনীই ছিল। নয় মাসে দেশ স্বাধীন না হলে মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনীর অনন্য অংশগ্রহণ বহুগুণ বেশি দৃশ্যমান হতো। মুক্তিবাহিনী একটি নিখাদ রাজনৈতিক বাহিনী না হওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরে এই বাহিনী তার রাজনৈতিক লড়াইটা শেষ করতে পারেনি। মনে করা হয়ে থাকে যে, নয় মাসের জন্য খ-কালীন একটি কাজে আমরা যোগ দিয়েছিলাম এবং নয় মাস পর সেই কাজটি শেষ হয়ে গেল; যেন একটি প্রকল্প শেষ হলো। মনে করা হয়ে থাকে যে, নানা স্থান থেকে আসা মানুষেরা একটি কাজ সম্পন্ন করে আবার তাদের স্ব স্ব কাজে ফিরে গেল। আমি মনে করি, আমাদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটা ঘটেছিল। স্বাধীনতার পর জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে এই মানুষদের একটি সংগঠিত বাহিনীতে একত্রিত করার চেষ্টা ছিল বটে। কিন্তু একদিকে রক্ষীবাহিনীতে অতি সামান্যসংখ্যক যোদ্ধাকে ঠাঁই দেয়া সম্ভব হয়েছিল এবং অন্যদিকে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সেই প্রচেষ্টা একবারেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান রক্ষীবাহিনীকে ধ্বংস করেছিল এমন বিচারে যে, সেটি সেনাবাহিনীর বিকল্প ছিল। বাস্তবে একটি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনীকে অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। অন্যদিকে ছাত্রলীগের যে অংশটি মুজিববাহিনীতে ছিল সেটি আলাদা একটি সংগঠন গড়ে তুলে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে পরবর্তীতে জাসদ গঠন করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রায় ৫০ বছর পূর্ণ হতে চললেও জাসদ গঠন, ছাত্রলীগ বিভাজন এবং সেই সময়কার রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়গুলো এখনও তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। আমার নিজের মনে হয়েছে যে, একাত্তরে মুজিববাহিনী গঠন করে যে উদ্দেশ্য সাধনের প্রচেষ্টা ছিল, তা ’৭২ সালে এসে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। মুজিববাহিনীর আদর্শ স্বাধীনতার পর সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ থাকলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ত ভিন্নভাবে প্রবাহিত হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুজিববাহিনী স্বাধীনতাত্তোরকালে একটি বিভক্ত শক্তিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে পঁচাত্তর পরবর্তী পশ্চাদপদতার প্রধান কারণ এই বিভক্তি। বঙ্গবন্ধু আজীবন বলে গেছেন তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। সংবিধানে সমাজতন্ত্র স্পষ্টভাবে এখনও উল্লিখিত আছে। সেই সমাজতন্ত্র বৈজ্ঞানিক হবে- সেই স্লোগান নিয়ে জাসদ তৈরি করার যৌক্তিকতা এখন তো আমি আর পাই না। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুং, চে গুয়েভারা, রেজিস দেবরেসহ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের বইপত্র পড়ে আমি সমাজতন্ত্রের বৈজ্ঞানিক সংস্করণ খুঁজে পাইনি। কিন্তু সংবিধানে সমাজতন্ত্র সন্নিবেশিত করার পর সেই সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টার বিপরীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ঘোষণা দিয়ে মুজিববাহিনীকে বিভক্ত করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। এছাড়াও মুত্তিযুদ্ধের পরপরই এদের সংগঠিত করে রাখার তেমন জোরালো কোন প্রচেষ্টা ছিল না। কেবল মুজিববাহিনীর একটি অংশ রাজনৈতিকভাবে জাসদ হিসেবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। জাসদ গঠন সঠিক ছিল কিনা সেটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে এর বাইরে বিশেষ করে আওয়ামী লীগে মুজিববাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে একত্রিত করার কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এক সময়ে মুজিববাদ অনেক আলোচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ঘোষণা ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু এর মাঝেই লুকায়িত ছিল বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একে একদলীয় শাসন হিসেবে প্রচার করে অপপ্রচার করা হতে থাকে। কেবল ১৯ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশালের কথা বলতে শুরু করেছেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনীতির জন্য একটি বড় মুষ্ঠাঘাত ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি সচেতন এই মুজিববাহিনীর প্রায় পুরোটাই জাসদ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং যে মুজিবের নামে এই বাহিনীর জন্ম হয়েছিল সেই মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। অন্যথায় মুজিববাহিনী স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতির একটি কেন্দ্রবিন্দুই থেকে যেতে পারত, যেমনটা তারা স্বাধীনতার আগে ছিল। জাসদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি তাঁর বইতে মুজিববাহিনী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মনি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল- এই চার যুবনেতা বসে ছিলেন না। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় ব্যানার্জি নামের এক ভারতীয় সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়। তাঁর মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের দেখা হয়। তিনি ছিলেন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল। তাঁকে অপ্রচলিত (গেরিলা) যুদ্ধের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা হতো। তাঁকে বাংলাদেশের তরুণদের বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনারেল উবান স্বাধীনভাবেই তাঁর দায়িত্ব পালন করার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। তাঁকে জবাবদিহি করতে হতো ভারত সরকারের সচিব রামেশ^র নাথ কাওয়ের কাছে। কাও ছিলেন একই সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এরও (রিসার্চ এ্যান্ড এ্যানালিসিস উইং) পরিচালক। সংস্থাটি ১৯৬৮ সালে সিআইএ (যুক্তরাষ্ট্র) এবং এমআই সিক্স (যুক্তরাজ্য)-এর আদলে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এর প্রথম প্রকল্পটির নাম ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে অসামান্য সাফল্য, তার পেছনে ‘র’ এর অবদান ছিল অনেকখানি।’ নানা সমীকরণে ভারতের সেনাবাহিনীর এমন একটি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল, যেটি রাজনীতি সচেতন, মুজিবের অনুগত, সাহসী ও প্রজ্ঞাবান। অন্যদিকে ২৬ মার্চের আগে যারা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে চাননি। তারা খুব ভাল করে জানতেন যে, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সশস্ত্র হয়েছেন, তারা সকলেই মুজিবের আদর্শের অনুসারী নন। একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী অনেকেই মুজিবের আদর্শের, স্বায়ত্তশাসনের, ছয় দফার বিরোধিতা করেছেন। বস্তুত তৎকালে সমাজতন্ত্রের ধারাটি উচ্চকিত থাকায় শেখ মুজিবের স্বাধীনতার লড়াই অনেকটাই পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীনতার লড়াইটা পাকিস্তানী পুঁজির সঙ্গে বাঙালী পুঁজির বিরোধের ফল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। বিশেষ করে পিকিংপন্থী বাম এবং উগ্র বামেরা এই ধারণা পোষণ করতেন। অনেকেই পরিস্থিতির চাপে পড়েও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হন। ॥ চার ॥ মুজিব বাহিনী গঠন প্রসঙ্গে ভারতীয় সংগঠক জেনারেল উবানের বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে-‘গোলযোগের অশান্ত দিনগুলোতে আমরা একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতার কথা জানতে পারলাম, যাঁরা বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। তাঁরা হলেনÑ শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তাঁদের মনে হলো অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করতে অথবা মরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তাঁদের নেতৃত্বে গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, অস্থায়ী সরকার এঁদের তেমন মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাঁরা চাইছিলেন, এঁরা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে ও যুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু এই যুবনেতাদের তাতে দৃঢ় আপত্তি ছিল। (মুজিবের প্রতি তাঁদের গভীর আনুগত্যর ও নৈকট্যের কারণে তাঁরা সবাই পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেল খেটেছেন মুজিবের সঙ্গে) তাঁরা মুজিববাহিনী নামে অভিহিত হতে পছন্দ করলেন। তাঁরা তাঁদের পুরনো সহকর্মীদের ক্যাডার হিসেবে বেছে বেছে সত্যায়িত করলেন। ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি শ্রী আর এন কাও এ সময় আমার উর্ধতন সিভিলিয়ান কর্মকর্তা ছিলেন। আওয়ামী লীগের যুব উইংয়ের নেতৃত্বে এবং খোদ সংগঠনটি সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য জানার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। তাঁর গভীর উপলব্ধি ছিল যে, তিনি আমার তত্ত্বাবধানে যে যুবনেতাদের দিয়েছিলেন, কেবল তাঁদের দ্বারাই আসল কাজটি হবে এবং তাঁদের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক অঞ্চলে কাজ করার জন্য বিশেষ মর্যাদা দেয়া দরকার। তিনি তাঁদের প্রতি অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের ঈর্ষার কথা জানতেন তাঁদের আপোসহীন মনোভাবের জন্য এবং মন্ত্রীদের উচ্চাকাক্সক্ষা ও অভিসন্ধির জন্য।’ ভারতীয় সংগঠকরা যেভাবেই মুজিববাহিনীর গঠনকে ব্যাখ্যা করুন না কেন, বাংলাদেশের তারুণ্যের নিজস্ব ও আদর্শগত একটি সংগঠন দরকার ছিল বলেই মুজিববাহিনী গঠিত হয়। মুজিবের নামে বাহিনী গঠন করার চাইতে শ্রেষ্ঠতম কোন অর্জন আমাদের কাছে মনে হয়নি। এর সবচেয়ে সঙ্গত কারণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যোগদানের ঐকান্তিক প্রেরণাই ছিলেন শেখ মুজিব। বিশেষ করে ’৬৮ থেকে ’৭১ সময়কালে মুজিবকে সারা দেশের একমাত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হই আমরা। তাঁর সমসাময়িক নেতা মওলানা ভাসানী বা মোজাফফর আহমদ বা কমরেড মনি সিংহ আর যাই হোন তাঁদের অনুসারীদের কাছেও অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন না, দেশের মানুষের কাছে তো ছিলেনই না। তার ওপরে ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিজয় সবকিছুকে ছাপিয়ে তাঁকেই সবার ওপরে স্থাপন করেছিল। আমরা শেখ মুজিবের কথাকে বাণী এবং প্রশ্নাতীত মনে করতাম এবং তিনি আমাদের সামনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ঢাকা, ২৬ মার্চ ১৯, আপডেট, জেনেভা, ১০ এপ্রিল ১৯ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সম্পাদক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×