ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

ঢাকার দিনরাত

পহেলা বৈশাখ সংবাদপত্রের ছুটি হলেও সংবাদকর্মীদের একাংশের কোন ফুরসত নেই, যেমন আমার। এই কলাম লেখার দিন রবিবার, সুতরাং বসে গেছি কম্পিউটারের সামনে। অবশ্য এমনিতেও উৎসব করার মতো মনের অবস্থা নেই। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার বিষয়টি থেকে কিছুতেই মন সরাতে পারছি না। এমন অবস্থা নিশ্চয়ই আমার একার নয়। তবে অনেকেই মনের দিক থেকে শক্তিশালী বলেই হয়ত সাময়িকভাবে নুসরাতকে ভুলে বর্ষবরণের উৎসবে মেতে উঠতে পারছেন। যা হোক, আমরা যারা একটু লেখালেখি করে থাকি, তারা হয়ত নির্বোধের মতোই ভাবি যে লিখলেই হালকা হওয়া যায়, মানসিক পীড়ন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। নুসরাতের জীবন দিয়ে প্রতিবাদ এবং সেই প্রতিবাদ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখি। সেটি নিচে শেয়ার করছি। কিন্তু লিখে মুক্তি মেলেনি। লিখেছি- আগুনে পোড়ালে ভস্ম বিনা কিছু থাকে না- এ সত্য তুচ্ছ করে দিয়ে জেগে থাকে মৃত্যুঞ্জয়ী অগ্নিকন্যা আগুনে পোড়ে না কিছুতেই দৃঢ় নীতি ও সম্ভ্রম আগুনে পুড়েছে কোনোকালে ঋজু-প্রতিজ্ঞা, সাহস? নয় অশ্রুবিসর্জন, চাই আজ মহাঅগ্নিবাণ বিনষ্টির বীজ শাখা মহীরুহ হোক খানখান দিকহারা বিহ্বলতা, ঝরা ফুল, ছড়ানো স্বপ্নেরা পীড়নের নৃশংস শিকার অগ্নিশিখা, একা চাঁদ, বিশুষ্ক নদীর মতো শীর্ণ রেখা- হোক অগ্নিশুদ্ধ ফিরে পাক তীব্র তীক্ষ্ন অগ্নিঝরা প্রাণ, অফুরান। অগ্নিকন্যা, তোমার বিশুদ্ধ অন্তরের অগ্নি আজ দাবানল হয়ে এ-বাংলার দশদিকে ধাবমান... নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে দেশের অন্যান্য এলাকার মতো রাজধানীতেও মানববন্ধন হয়েছে। গণভবন এলাকা থেকে বঙ্গভবন এলাকা পর্যন্ত মানববন্ধন পালিত হয় শনিবার। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বাম ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নারী অধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন এনজিও’র উদ্যোগে এই কর্মসূচী পালিত হয়েছে। এলো বৈশাখ বাঙালীর কবি রবীন্দ্রনাথ বৈশাখ নিয়ে এমন কিছু গান রচনা করেছিলেন যেগুলোর প্রথম পঙ্ক্তি অনিবার্যভাবে যোগ হয়ে চলেছে বৈশাখী শুভেচ্ছাপত্র ও আমন্ত্রণপত্রে। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’- এ চরণটি বুঝি বহুল মুদ্রিত ও উচ্চারিত। নববর্ষ উপলক্ষে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এমনকি শপিংমলেও সাজ সাজ রব পড়ে যায়। পুষ্পিত এই সজ্জায় বাণিজ্য ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে প্রাণে প্রাণে সংযোগ ও আত্মপরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে মধুর মেলবন্ধন। আমরা জানি, রাত বারোটা এক মিনিটে নয়, বাংলা নববর্ষ শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে (আহা ওই সময়ে অনুভব করা যায় ‘বৈশাখের ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ’)। রাজধানীবাসীর আয়েশি অংশটিও প্রভাতনিদ্রার সুখটুকু ঝেড়ে ফেলে বৃহৎ আনন্দের সন্ধানে নববর্ষ উৎসবে যোগ দেয়। সকলেই যে সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়েন রমনার উদ্দেশে এমন নয়। টেলিভিশনের কল্যাণে এখন কেবল ছায়ানট কেন, ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরসহ কয়েকটি স্থানে আয়োজিত বেশকিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের বর্ষবরণ উৎসব প্রত্যক্ষ করা যায় সরাসরি। এ উদ্যোগের ফলে দূর পরবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশের অগণিত মানুষের সঙ্গে মাতৃভূমির ভৌগোলিক দূরত্ব মুহূর্তে ঘুচে যায়। তবে হ্যাঁ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় কোন না কোন আয়োজন চলছেই বর্ষবরণের (আমি থাকি উত্তরায়। এখানে একাধিক বড়সড়ো উৎসব চলে)। নগরবাসীর নিরানন্দময় নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রবাহে বৈশাখ সত্যিকারার্থেই নিয়ে আসে আনন্দের উপলক্ষ। ভোজ আর উপভোগের পহেলা বৈশাখে বাঙালী আপনা থেকেই আত্মপরিচয় খুঁজে পায় এবং আর দশজন স্বজাতির সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে। ধর্মীয় পরিচয় সেখানে সামান্যতম প্রতিবন্ধক নয়। বছরের প্রথম দিনে এটি এক অনন্য অর্জন। আমাদের জাতীয় জীবনে পহেলা বৈশাখ এমন একটি মুহূর্ত যখন বাঙালী হিসেবে আমাদের মনে এক অনিঃশেষ গৌরব এসে বাঁশি বাজায়; জেগে ওঠে ভ্রাতৃত্ববোধ, মুমূর্ষুরে উড়ায়ে প্রাণে বেজে ওঠে নব আনন্দ গান। ভুলে যাচ্ছি না যে দেশের পাহাড়ী জনপদে অবাঙালী আদিবাসীরা বৈসাবি উৎসবে মাতে পহেলা বৈশাখের ঠিক আগে-আগে। ঢাকার বাইরে দেশজুড়েই শহরে শহরে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব চলে। যদিও জীবনাচারে বাংলা যাদের চিরসখা সেসব পল্লীবাসীর পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। হালখাতা আর গ্রামীণ মেলার ভেতর দিয়ে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেও নতুন বছরের সূচনালগ্নের প্রাণোচ্ছল হাওয়া এসে আছড়ে পড়ে। নগর কিছুটা প্রভাবিতও করে চলেছে এখন পল্লীকে। মানুষ চায় বাধাবিঘ্নহীন নিরঙ্কুশ উৎসব। পুলিশের চাপিয়ে দেয়া সীমাবদ্ধতায় মন সায় দেয় না। যদি উৎসবকে সীমিত ও সঙ্কুচিত করে ফেলতে হয় অল্প ক’জন বখাটের কারণে, কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে উৎসববিরোধী বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী জামায়াত-শিবির-হেফাজতী চক্রের হুমকিকে যদি আমলে নেয়া লাগে, তাহলে আফসোসের সীমা পরিসীমা থাকে না। এ যেন অনেকটা সে রকম- সড়কে সড়কে ট্রাক-বাস বেসামাল হয়ে পরিণত হতে পারে যন্ত্রদানবে। তাই হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলাম। বলা যায়, বিষয়টা এমন- ঘরের দরজা-জানালাও বন্ধ রাখলাম, পরে ওই পথ দিয়ে রোগব্যাধি ঢুকে পড়ে। উৎসব হওয়া উচিত আরও প্রাণবন্ত ও প্রসারিত। ক’বছর আগের রমনা উদ্যানের গ্লানিটুকু উড়িয়ে দিতে চাই বেশি বেশি করে নারীর অংশগ্রহণ। এবং অবশ্যই তাদের পাশে থাকবে সচেতন নাগরিকরা। যাতে ছোটখাটো ঝামেলা বাধাতেও কারও দুঃসাহস না হয়। উৎসবের দিন কোথায় সব উন্মুক্ত থাকবে, তা নয়। তার বদলে নিষেধাজ্ঞা আর প্রতিবন্ধকতা! পহেলা বৈশাখে ঢাকার রাস্তায়, বৈশাখী মেলায়, চারুকলায় আর শাহবাগে ঢল নামবে আনন্দসন্ধানী মানুষের, এ তো জানা কথাই। খোলা প্রাঙ্গণে ও সড়কে মানুষের এই মহাসমাবেশ কেবল একুশে ফেব্রুয়ারির জনসমাগমের সঙ্গেই তুলনীয়। তবে একুশের অভ্যন্তরে শোকবিধুরতা থাকে, আনুষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা থাকে যা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত পহেলা বৈশাখে। এই দিন কেবলই যেন আনন্দে ডানা মেলার। সমগ্র রাজধানীই যেন হয়ে ওঠে সংস্কৃতিমেলা- যার অংশ বৈশাখী মেলা, আবৃত্তি আর গানের আসর। একসময় জাতীয় কবিতা পরিষদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠের আয়োজন করত। এখন আর দেখি না। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বৈশাখ বিষয়ক স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে একবার অংশ নিতে গিয়ে মনে হয়েছিল কবিরাও উন্মুখ হয়ে থাকেন নববর্ষে তার পাঠককে নতুন কবিতার স্বাদ দিতে। ভেবে পাই না প্রতি বৈশাখে কেন নয় একটি নির্দিষ্ট স্থানে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠের আয়োজন? রমনার বটমূলের উৎসবের মতো সেটিও হতে পারে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবদীপ্ত অংশ। তবে বৈশাখ কেবল আনন্দের নয়, প্রতিবাদেরও। ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী আয়োজনে প্রতিবাদের সুরটিই ছিল এবার প্রধান। এমনকি ড. সনজীদা খাতুনের বক্তব্যে উচ্চারিত হেেছ নুসরাতসহ পীড়নের শিকার সব নারীর জন্যে প্রতিবাদ এবং বিচার দাবি। সংবাদপত্রে বৈশাখী ক্রোড়পত্র ধারণ করে বৈশাখের চালচিত্র। উৎসবের শাখা-প্রশাখার আলোকপাত আর বৈশাখ-বন্দনা থাকে তার বড় জায়গা নিয়ে। ফি-বছর পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরে অগ্রযাত্রা এবং আত্মশুদ্ধির শপথ নেয়া হয়। আমাদের চিন্তাবিদরা বিশ্বসভায় বাঙালীর অবস্থান শনাক্ত করেও লেখেন। তবে তা যৎসামান্যই। প্রতিবাদের জায়গাটি প্রতুল নয়। এর প্রকাশ্য রূপ দেখতে পাই চারুকলা থেকে বেরুনো শোভাযাত্রায়। লোক ঐতিহ্যের মোটিফের সমান্তরালে এতে থাকে প্রতীকী মোটিফ। স্বৈরাচার, জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদবিরোধিতা তাতে প্রত্যক্ষ করা যায়। দেশের সংস্কৃতিকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির বার্তা থাকে তাতে, থাকে আন্দোলনের সঙ্কেত। আনন্দ প্রকাশের সহযোগে কখনও কখনও শাসক মহলের অন্যায্য কাজের সমালোচনার এই ভঙ্গিটি ব্যতিক্রমী। বিশ্বের অন্যান্য দেশে নানা জাতির বর্ষবরণের উৎসব থেকে বাঙালীর এই অসামান্য উৎসব এভাবেই পৃথক ব্যঞ্জনা লাভ করে। বাঙালীর এই প্রতিবাদী সত্তাটি বাস্তবিকই অসাধারণ। বৈশাখের শক্তিটিকে ঠিকই চিনেছে অপশক্তি, তাই পহেলা বৈশাখেই তারা আত্মঘাতী হামলার উদ্বোধন ঘটিয়েছিল। বৈশাখ তাই আমাদের নতুন করে সতর্ক হতে শিখিয়েছে। একাত্তরের পরাস্ত শক্তির প্রতিশোধস্পৃহা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে। হঠাৎ হৈমন্তী শুক্লা বাংলাদেশের গানপ্রিয় মানুষের কাছে বিশেষ প্রিয় ভারতের সঙ্গীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। শুক্রবার আকস্মিকভাবেই তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করলেন ধানম-ির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। ঢাকায় এসেছেন গজলশিল্পী মনজুরুল ইসলাম খানের আধুনিক গানের সিডির ( জোছনায় বেসামাল) মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে। সিডির গানগুলো লিখেছেন শহীদুল্লাহ ফারায়জি ও সুলতানা শাহরিয়া পিউ। সিডির শিল্পীর পরিবেশনার পর শুরু হয় প্রধান আকর্ষণ হৈমন্তী শুক্লার গান। শ্রোতাপ্রিয় বেশকিছু গান শোনান শিল্পী। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বহু মানুষ অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে দাঁড়িয়ে গান উপভোগ করেন। চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন বৈশাখ আসার আগে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে বৈশাখকে আহ্বানই যৌক্তিক মনে হয়। বৈশাখের জন্য প্রস্তুতি, বর্ষ শেষের চৈত্র সংক্রান্তি আর বসন্তযাপন- এসব মিলিয়ে নিকট বন্ধুজনদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গুরুত্বই অন্যরকম। যত দিন যাচ্ছে রাজধানীতে চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজনের সংখ্যা বাড়ছে। সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলা ছোট্ট একটি সংগঠন আকাশ প্রদীপ। বিদায়ী বাংলা বছরের শেষ সন্ধ্যার এই আয়োজনে যাঁরা পরিবেশন করলেন গান ও কবিতা তাঁদের সবাই পেশাজীবীÑ কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, কেউ বা শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক। কিন্তু সকলেই সুদূরের পিয়াসী, শিল্পমনা, সুন্দরের পূজারী। রাজধানীতে বড় বড় আয়োজনের পাশে এমন কতই না ছোটখাটো আয়োজন হয়, যাতে প্রাণের পরশের সামান্যতম ঘাটতি থাকে না। এর সাংস্কৃতিক-সামাজিক গুরুত্বও বিরাট। বাঙালী এভাবেই তার শেকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, নিজ সাহিত্য-সঙ্গীতের গুণীজনদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আকাশ প্রদীপের এ আয়োজনটি হয়েছিল মহাখালীতে, ব্যবসায়ী সুলতানুল আলমের বাড়িতে। গোটা পঞ্চাশেক সুধীজনের এ সমাবেশে কেউ কেউ তাঁর কাছের বন্ধুটিকে নিয়ে এসেছিলেন। আয়োজক ফারুক মাহমুদ, গোলাম মোরশেদ, মাহবুবা বিনু প্রমুখের ধন্যবাদ প্রাপ্য। ১৪ এপ্রিল ২০১৯ [email protected]
×