ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জার করার সুপারিশ বিশ্বব্যাংকের

কর্মসংস্থানে বছরে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা দেবে আইএফসি

প্রকাশিত: ১০:০২, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

 কর্মসংস্থানে বছরে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা দেবে আইএফসি

এম শাহজাহান, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ॥ কনকনে ঠান্ডায় ওয়াশিংটনবাসীর গা হিম হয়ে আসলেও বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পাচ্ছেন ‘গরম’ খবর। আইএমএফের পর এবার সুখবর দিলো বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আইএফসি। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই বিনিয়োগের ফলে উৎপাদনশীল খাতগুলোতে বেকারদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারী খাতের দুর্বল ব্যাংক মার্জারসহ আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের সুপারিশ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। পুঁজিবাজার গতিশীল করার লক্ষ্যে বেশকিছু সুপারিশও দিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের চলমান বসন্তকালীন সভায় বাংলাদেশের অনুকূলে কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দেয় আইএফসি। সংস্থাটি মনে করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ্বের যেকোন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশের পেমেন্ট সবচেয়ে ভাল। এজন্য বাংলাদেশের উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে আইএফসি বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সভা শেষে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ কমাতে বলেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আরও কার্যকর করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশকে অবকাঠমো খাতে আরও সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এদিন বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপ, বিশ্ব ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক, আইএমএফের নির্বাহী পরিচালক, আইএফসি, ভি-২০ গ্রুপের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের। এসব বৈঠকে বাংলা দেশের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির, বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোশররফ হোসেন ভুঁইয়াসহ সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। এদিকে, বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর বিশ্ব ব্যাংক একটি স্টাডি পেপার তুলে ধরেছে। সেখানে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা ও করণীয় সম্পর্কে বলা হয়। বলা হয়, দেশের অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশে বেসরকারী ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করতে হবে। এ জন্য দুর্বল ও ছোট ব্যাংকগুলোকে বড় ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করতে হবে। বৈঠকে আরও বলা হয়, সরকারী ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেশি। এটি কমিয়ে আনতে হবে। তবে এটিও স্বীকার করা হয় যে, সরকারী ব্যাংক অনেক সেবা দিচ্ছে কোন ধরনের সার্ভিস চার্জ ছাড়া। পাবলিক সেবা দিতে গিয়েও খেলাপীর ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের আরও বলেন, বাংলাদেশে দুটি কৃষি ব্যাংক আছে। বর্তমান খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির পেছনে ওই দুটি ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কারণ কৃষকদের সহায়তা করতে গিয়ে তাদের অনেক খেলাপী হচ্ছে। কিন্তু এই খেলাপীর দিকে চিন্তা করে কৃষি খাতে সহায়তা বন্ধ, ঋণ ও বিদ্যুত এবং বীজ সময় মতো সরবরাহ না করলে ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়াবে। তখন এই পণ্য আমদানি করতে হবে। তবে বর্তমানে কৃষি খাতে যা দেয়া হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ফেরত পাচ্ছি। এ ধরনের সহায়তা না করলে বিপর্যয় দেখা দেবে। মন্ত্রী আরও বলেন, আমার মতে এই বিপর্যয়ের চেয়ে কৃষি ব্যাংকের খেলাপীই ভাল। কারণ এসব কাজ করতে হচ্ছে জনগণকে সামনে রেখে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বেসরকারী ব্যাংকগুলোর খেলাপীর পরিমাণ মোট ঋণের ৫ শতাংশের ওপরে যায়নি। তবে সার্বিকভাবে খেলাপীর হার ১০ শতাংশ থাকলেও সেটি পাবলিক খাতের ব্যাংকের হিসাব ধরা হচ্ছে। তিনি বলেন, বেসরকারী ব্যাংকের সংখ্যা বেশি বলে মার্জার করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জার করতে বলেছে। বৈঠকে আমি বলেছি ব্যাংকের সংখ্যা কতটা সেটি বড় বিষয় নয়। কারণ অনেক ব্যাংকের সাইজ খুবই ছোট। তাদের মূলধন বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোর মূলধনের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা থেকে ৪শ’ কোটি টাকা করা হয়েছে। সেখান থেকে ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হবে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করার সুপারিশ মেনে নেয়া হয়েছে। খেলাপী আদায়ে এস্টেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হবে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এই মুহূর্তে মার্জার করা হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপী ঋণ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমান খেলাপী ঋণের হিসাব পদ্ধতি ভুল। এটি সঠিকভাবে করা হয় না। খেলাপী ঋণের সঠিক হিসাবটি করতে ইতিমধ্যে কয়েকটি অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা অডিট করে খেলাপী ঋণের সত্যিকার চিত্রটি আমাদের কাছে দেবে। এতে খেলাপী ঋণের পজিশন জানা যাবে। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মার্জার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মার্জার করতে আইন আছে কিনা জানতে চাইলে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন ব্যাংক কোম্পানি আইন আছে। সেখানে এ ধরনের বিধান না থাকলে সংশোধন করা হবে এবং প্রয়োজনে আইন করে নেয়া হবে। এদিকে, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পুঁজি বাজার নিয়েও পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। এই বাজার আরও কার্যকর ও গতিশীল করতে বলা হয়। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, পুঁজিবাজার কার্যকর করতে যে কৌশল আছে তা হচ্ছে আর্থিক বছরের হিসাব। এটি করা হবে। তবে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। একটি ভাল হলে অন্যটিও ভাল হবে। তবে স্বল্প মেয়াদে অর্থায়ন নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়ন বন্ধ করা হবে। এ জন্য বন্ড মার্কেটে যাওয়া হবে। পর্যাপ্ত বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে কর অর্থায়ন করা হবে। এদিকে, বসন্তকালীন সম্মেলনে দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক অর্পনার সঙ্গে। বর্তমান তিনি ভুটান, ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার দায়িত্বে আছেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এরপর বৈঠকটি হয় আইএমএফের নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে। এই দাতা সংস্থার বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশকে বিশ্বের অনেক দেশ এখন চিনে। আগে বাংলাদেশকে পরিচয় করাতে কষ্ট হতো। আইএমএফ সক্ষমতা ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করবেন বলে আশ্বস্ত করে। এরপর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে একটি বৈঠক হয়। সেখানে ৩৫ জন অর্থমন্ত্রী অংশগ্রহণ করেছেন। প্রত্যেকে কথা বলেছেন। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী বলেন, এসডিজি অর্জন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অর্থায়ন। মোট অর্থের পরিকল্পনা নিরূপণ করেছে। বাংলাদেশ নিরূপণ করেছে এক ট্রিলিয়ন ডলার। অপর বৈঠক ভি-২০ আওতায় একটি ক্লাইমেট ফান্ড গঠন করতে সকলে একমত পোষণ করেছেন। জানা গেছে, বসন্তকালীন সভার পরবর্তী বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তা চাওয়া হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দাতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা মিয়ানমারে ফিরে না গেলে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা আরও জটিল ও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের নিজস্ব বাজেট থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। অথচ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। পরবর্তী সভাগুলোতে এসব বিষয় উপস্থাপনসহ দ্রুত বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তা চাবে বাংলাদেশ।
×