ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অন্যতম প্রধান আসামি শাহাদত হোসেন শামীমও গ্রেফতার

কারাগারে বসেই নুসরাত হত্যার নীলনক্সা তৈরি করে সিরাজ উদদৌলা

প্রকাশিত: ১০:০০, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

 কারাগারে বসেই নুসরাত হত্যার নীলনক্সা তৈরি করে সিরাজ উদদৌলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার আদ্যোপান্ত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কারাগারে বসেই মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার পরিকল্পনা হয়। হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের নীলনক্সা তৈরি করে কারাবন্দী মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। এই মাস্টারমাইন্ডসহ মোট তেরোজন রাফি হত্যায় জড়িত। যার মধ্যে আটজন পুলিশ হেফাজতে আছে। আটজনের মধ্যে সাতজনকে রাফি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। একজনকে নিয়ে পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলছে। আসামিদের মধ্যে এক নারী ও তিন পুরুষসহ মোট চারজন রাফিকে তার বান্ধবীকে মারধর করার মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাইক্লোন সেন্টারে ডেকে নেয়। সেখানেই আগ থেকেই বোরকা পরিধান করে লুকিয়ে থাকা তিন পুরুষ রাফির হাত বেঁধে ফেলে। এরপর তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় শাহাদত হোসেন শামীম নামে একজন। আসামি নুর উদ্দিন গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে রাফি হত্যার আদ্যোপান্ত রহস্য। অধ্যক্ষকে মুক্তির দাবিতে যারা আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারা নজরদারিতে রয়েছেন। শনিবার বহুল আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার ধানমন্ডি পিবিআই সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, রাফি হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নুর উদ্দিন গ্রেফতার হওয়ার পর হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নুর উদ্দিনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা রাফির শ্লীলতাহানি করে। ঘটনাটি রাফি তার সহপাঠী ও পরিবারকে অবহিত করে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতে সমাজে দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। একটি পক্ষ অধ্যক্ষের দিকে, অন্যটি রাফির পক্ষে অবস্থান নেয়। তারই জেরে ওইদিনই অধ্যক্ষ গ্রেফতার হয়। সূত্র বলছে, অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে কমিটি গঠিত হয়। ২০ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক গ্রেফতারকৃত নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদত হোসেন শামীম। তাদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে গত ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়। তারাই নুসরাতের সমর্থকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, অধ্যক্ষ মুক্তি পরিষদের তরফ থেকে গত ৪ এপ্রিল কারাবন্দী অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে দেখা করে নুর উদ্দিন। কারাগারে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনায় অধ্যক্ষ সম্পর্কে দেশের সার্বিক মানুষের ভাবমূর্তি ও পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তাও গুরুত্ব পায়। আলাপের এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ নুর উদ্দিনকে আবেগতাড়িত হয়ে বলে, তোরা আমার জন্য কি করলি? অধ্যক্ষ নুর উদ্দিনকে এমনভাবে কথাগুলো বলে, যাতে ঘটনাটি বিশ্বাস হয়। অধ্যক্ষ নিজে নির্দোষ বলে নুর উদ্দিনকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নির্দোষ ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়ার কারণে নুসরাতকে দোজকের আগুনে যেভাবে পাপিরা পুড়ে মরবে, সেইভাবে পুড়িয়ে মারা উচিত বলে মত দেয় অধ্যক্ষ। এমন আলোচনার প্রেক্ষিতেই রাফিকে পুড়িয়ে মারারই পরিকল্পনা হয়। তারই প্রেক্ষিতে পরদিন ৫ এপ্রিল মাদ্রাসাটির পশ্চিম হোস্টেলে রাফিকে হত্যার বিষয়ে একটি পরিকল্পনা বৈঠক হয়। বৈঠকে পাঁচজন উপস্থিত ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক নুসরাতকে ডেকে নিয়ে হাত বাঁধা হবে। এরপর মুখ বেঁধে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে। হত্যার পর পুরুষরা যাতে নিজেদের আড়াল করে পালিয়ে যেতে পারে এজন্য বোরকা পরিধান করে পুরো অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনায় থাকা পাঁচজনের মধ্যে তিনজন ছাত্র আর বাকি দুইজন ছাত্রী বলে জানা গেছে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক শম্পা বা চম্পা নামের এক ছাত্রীকে কেরোসিন ও তিনটি বোরকা প্রস্তুত রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়। একটি পলিথিনের ব্যাগে করে কেরোসিন ও বোরকা নিয়ে ওই মেয়ে পরদিন ৬ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যায়। সে সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ক্লাস করে। এরপর সেই কেরোসিন ও বোরকা শামীমের কাছে সাইক্লোন সেন্টারে হস্তান্তর করে ওই ছাত্রী। সাইক্লোন সেন্টারের বাথরুমে বোরকা পরিধান করে ওই তিন ছাত্র লুকিয়ে থাকে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নুসরাত পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করলে আরেক ছাত্রী ক্লাসে ঢুকে নুসরাতকে জানায়, তার বান্ধবী নিশাতকে কারা যেন সাইক্লোন সেন্টারে মারছে। এই কথা শুনে নুসরাত সাইক্লোন সেন্টারে যায়। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোরকা পরিহিত অবস্থায় বাথরুম থেকে বের হয়ে নুসরাতকে জাপটে ধরে ওই তিনজন। শাহাদত হোসেন শামীম ওড়না দিয়ে নুসরাতের হাত বেঁধে ফেলে। তারপর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেয়ার পর তারা পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় যে ছাত্রী নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায়, সে আশপাশেই ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বিষয়টি শতভাগ স্পষ্ট নয়। সাইক্লোন সেন্টারের ছাদ চারিদিকে প্রায় ছয় ফুট উঁচু দেয়াল ঘেরা। এজন্য শরীরে আগুন লাগার পরও নুসরাতের পক্ষে আর লাফিয়ে ছাদ থেকে পড়ার সুযোগ ছিল না। সে সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে যায়। আগুন দেয়ার পর হত্যাকারীরা প্রথমে মাদ্রাসাতেই লুকিয়ে ছিল। পরে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় শাহাদত হোসেন শামীমকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ঘটনার সময় নুর উদ্দিন নিচে সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য পাহারায় ছিল। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, নুর উদ্দিন, কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, জোবায়ের আহমেদ, জাভেদ হোসেন, শামীম ও মাদ্রাসার প্রভাষক আফসার উদ্দিনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ওই ছাত্রীকেও আটক করা হয়েছে। এ মামলার এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি আবদুল কাদের পলাতক আছে। ডিআইজি বলেন, নুর উদ্দিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিশ্বস্ত সহযোগী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। সে নিজেও নুসরাতের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সে একাধিকবার নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রতিবারই নুসরাত প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে। বার বার প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় কিছু দিন আগে নুসরাতের চোখে চুন ছুড়ে মারা হয়েছিল। ওই সময় নুসরাত অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। সে ঘটনাটি তারা রীতিমতো ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল অধ্যক্ষের ঘটনাটি এবং তার শরীরে আগুন দেয়ার ঘটনাটিও ধামাচাপা দিতে পারবে। এছাড়া শাহাদত হোসেন শামীমও বহুবার নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। তার প্রেমও প্রত্যাখ্যান করেছে নুসরাত। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শামীম বিষয়টি নিয়ে নুর উদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে। নানা ঘটনার জেরে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তারা। প্রসঙ্গত, গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা চলাকালে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে মাদ্রাসাটির ছাত্রী নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বোরকা পরিহিত তিনজন। মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নুসরাতের শ্লীলতাহানি করার জেরে ঘটনাটি ঘটে। ওই ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হলে মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের পক্ষের লোকজন চাপ দিচ্ছিল নুসরাতের পরিবারকে। দগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসায় গঠিত হয় ৯ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। ততদিনে ঘটনাটি সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছিলেন নুসরাতের। উন্নত চিকিৎসার জন্য নুসরাতকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোরও পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু সবার প্রার্থনা আর চেষ্টাকে বিফল করে গত ১০ এপ্রিল রাতে না ফেরার দেশে চলে যান নুসরাত। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান (২৩) বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নুসরাতের পিতার নাম একেএম মুসা। মায়ের নাম শিরিনা আক্তার। বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজী থানাধীন সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামে। মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয় এসএম সিরাজ উদদৌলা (৫৫), পিতা-মৃত কলিমুল্ল্যাহ, সাং-চরকৃষ্ণজয়। নুর উদ্দিন (২০), পিতা-আহসান উল্লাহ, সাং-উত্তর চরচান্দিয়া। শাহাদত হোসেন শামীম (২০), সাং-চরচান্দিয়া (ভূইয়া বাজার), মাকসুদ আলম কাউন্সিলর (৪৫) ৪নং ওয়ার্ড, সোনাগাজী পৌরসভা, জোবায়ের আহম্মেদ (২০) পিতা-আবুল বাশার, সাং-তুলাতলী (হাসপাতাল এলাকা), জাবেদ হোসেন (১৯) পিতা- রহমত উল্লাহ, সাং-উত্তর চরচান্দিয়া (চরচান্দিয়া বোর্ড অফিস সংলগ্ন) ও আফছার উদ্দিন (৩৫), প্রভাষক, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, সর্বথানা সোনাগাজী, সর্বজেলা- ফেনীকে। আর সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আটক করা হয়েছে মোঃ আলাউদ্দিন, কেফায়েত উল্লাহ ওরফে জনি, সাইদুল ইসলাম, আরিফুল ইসলাম, উম্মে সুলতানা ও নূর হোসেন ওরফে হোনা মিয়াকে। আর এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদত হোসেন শামীম, মাকসুদ আলম কাউন্সিলর, জোবায়েদ আহাম্মদ, জাবেদ হোসেন ও আছফার উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নয়জনকে পাঁচদিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একজনের রিমান্ড শুনানি মুলতবি রয়েছে।
×