ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরা হাসপাতালে ১২ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয়ে অনিয়ম, জালিয়াতি

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

 সাতক্ষীরা হাসপাতালে ১২  কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয়ে অনিয়ম, জালিয়াতি

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের ১২ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ কেনা হলেও সব মালামাল সরবরাহ করার আগেই ঠিকাদারকে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যন্ত্রাংশগুলো চলমান বা ভাল আছে কিনা বিষয়টি তদারকি না করেই সার্ভে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরে মালামাল বুঝে পাওয়ার রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। তবে ভারি এসব যন্ত্রাংশ সদর হাসপাতালের সার্ভে কমিটির যেসব কর্মকর্তা গ্রহণ করেছেন তারাও বিষয়টি জানেন না বলে বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সার্ভে কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব যন্ত্রাংশ চলমান অবস্থায় বুঝে পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই বিপুল পরিমাণ টাকার বিল সাতক্ষীরা থেকে পরিশোধ হয়ে গেছে। সেবার মান উন্নত করতে সরকারী বরাদ্দের ১২ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ কেনা হলেও বাক্সবন্দী এসব মালামালের মধ্যে কি ধরনের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয়েছে তা গত এক বছরেও খুলে দেখা হয়নি। মঙ্গলবার সকালে উপ-সচিব হাছান মাহমুদসহ ৩ সদস্যের একটি টিম আকস্মিক ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় এসে ১২ কোটি টাকায় ক্রয় করা ভারি যন্ত্রাংশ দেখতে চাইলে এই অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিস থেকে গত ১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দের ওপর ভারি যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডার অনুযায়ী ঢাকার মার্কেন্টাইল ট্রেড কো: এসব মালামাল সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। যথারীতি তারা ১২ কোটি টাকার স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করেছেন বলে সার্ভে কমিটির রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। অথচ সরেজমিন তদন্তে এসে এসব মালামাল ক্রয়ের সত্যতা কাগজে-কলমে মিললেও বাস্তবে মালামালগুলো কি ধরনের সরবরাহ করা হয়েছে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে তা স্পষ্ট নয়। অথচ এই মালামাল ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সার্ভে কমিটির রিপোর্টে চলমান অবস্থায় মালামাল বুঝে পাওয়ার কথা বলা হলেও এখনও কয়েকটি মেশিন সরবরাহ হয়নি। সরকারের বরাদ্দ এই ১২ কোটি টাকার মালামাল ক্রয়ের বাস্তবতা দেখতে মঙ্গলবার ঢাকা থেকে আকস্মিক তদন্তে আসেন একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে একজন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও একজন প্রকৌশলী। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডাঃ রফিকুল ইসলাম শুক্রবার এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই তদন্ত টিম মালামাল ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ তৌহিদুর রহমান, সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, স্টোর কিপার এ কে ফজলুল হকসহ এসব পণ্য বুঝে নেয়া সার্ভে কমিটির সদস্য ডাঃ ফরহাদ জামিল, ডাঃ আসাদুজ্জামান ও ডাঃ শরিফুল ইসলামকে ডেকে কথা বলেন। এ সময় সার্ভে কমিটির সদস্যরা মালামাল চলমান অবস্থায় বুঝে পাওয়ার বিষয়ে তাদের দেয়া রিপোর্ট জাল বলে দাবি করেন। সিভিল সার্জন ডাঃ রফিকুল ইসলাম জানান, মালামাল ক্রয়ের প্রক্রিয়ার সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। ওই সময়ে সিভিল সার্জনের দায়িত্বে ছিলেন ডাঃ তৌহিদুর রহমান। ১৭ সালের ১৩ মার্চ থেকে থেকে ১৮ সালের ১১ নবেম্বর পর্যন্ত ডাঃ তৌহিদুর রহমান সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জনের দায়িত্ব পালন করেছেন। মালামাল বুঝে নেয়ার দায়িত্বে থাকা সার্ভে কমিটির সদস্য ডাঃ আসাদুজ্জামান, ডাঃ ফরহাদ জামিল ও ডাঃ শরিফুল ইসলাম মালামাল চলমান অবস্থায় বুঝে পাওয়ার বিষয়ে তাদের দেয়া রিপোর্ট জাল দাবি করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তাদের দাবি সার্ভে কমিটির রিপোর্টে তাদের স্বাক্ষর জাল বা স্ক্যান করে বসানো হয়েছে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর অফিসার ডাঃ জয়ন্ত সরকার জানান, স্টোর অফিসার হিসাবে তিনি এ ধরনের কোন মালামাল বা কোন যন্ত্রাংশ গ্রহণ করেননি। তিনি আরও বলেন, সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ তৌহিদুর রহমান ও স্টোর কিপার ফজলুল হক এসব যন্ত্রাংশ গ্রহন করেছেন মর্মে অডিট টিম তাদের জানিয়েছেন। তবে এখন কিছু কার্টন এসেছে তার মধ্যে কি ধরনের মালামাল রয়েছে তা তার জানা নেই। যেটি তারা কেউ রিসিভ করেননি বলে দাবি করেন। সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন শুক্রবার জনকণ্ঠকে বলেন, ১৭-১৮ অর্থবছরে সিভিল সার্জন ডাঃ তৌহিদুর রহমানের সময়ে এই টেন্ডার আহ্বান করা হয়। চুক্তিবদ্ধ ঢাকার মার্কেন্টাইল ট্রেড কোঃ এ পর্যন্ত সরবরাহ করেছে পোর্ট এ্যাবল এক্স-রে মেশিন চারটি যার প্রতিটির মূল্য ২৩ লাখ টাকা। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন চারটি, সিলিং ওটি যন্ত্রাংশ এক সেট, নেবুলাইজার মেশিন ১৮, স্টিল ল্যাম্প ১, চোখ পরীক্ষার মেশিন ১ যা প্রায় ৮৫ হাজার টাকা দাম, রেটিনোস্কপ ১, ডেন্টাল যন্ত্রাংশ এক সেট, সাকশান ইউনিট ১ ও ওয়াটার বাথ রয়েছে। এসব পণ্য চলতি অর্থবছরের বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে এসেছে। এখনও একটি এনেসথেশিয়া মেশিন, ওটি লাইটসহ আরও একটি মেশিন সরবরাহ করা হয়নি। অথচ গত নবেম্বরেই এই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে স্টোর কিপার ফজলুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় সব মাল সরবরাহ হয়েছে। তিনটি মালামাল এখনও সরবরাহ হয়নি বলে তিনি স্বীকার করেন। সার্ভে কমিটির সদস্য সাবেক আরএমও ডাঃ ফরহাদ জামিলকে রিং করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। এ বিষয়ে সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ তৌহিদুর রহমান শুক্রবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, চুক্তির ৮০ ভাগ মালামাল সরবরাহ হলে বিল পরিশোধের নিয়ম রয়েছে বলে তিনি ঠিকাদারকে বিল দিয়েছেন। সার্ভে কমিটির সদস্যদের সই জাল বিষয়ে তিনি বলেন, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ও স্টোর কিপার ফজলুর রহমান বিলের সঙ্গে এই সার্ভে কমিটির রিপোর্ট জমার দেয়ায় তিনি বিল পরিশোধ করেছেন। রিপোর্টে সদস্যদের স্বাক্ষর জাল হলে এর দায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও স্টোর কিপারের বলে তিনি জানান। নবেম্বরে অবসরের মুহূর্তে ঠিকাদারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চ মহলের চাপে তিনি বিল পরিশোধ করেছেন দাবি করে তিনি বলেন, সার্ভে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর জাল কিনা সেটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পরেই জানা যাবে।
×