ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ তরুণীরা মেতেছে পানি খেলায়

প্রকাশিত: ১০:২৯, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

পাহাড়ে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ তরুণীরা মেতেছে  পানি খেলায়

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুক্রবার ভোরে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে শুরু হয়েছে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’। পাহাড়ীরা বৈসাবিকে তাদের প্রাণের উৎসব বলেও দাবি করেন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং নানা অনুষ্ঠানমালায় সমৃদ্ধ এই উৎসব শেষ হবে আগামিকাল রবিবার। মূলত বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার পাশাপাশি পুরনো বছরকে বিদায় জানায়। খাগড়াছড়ি থেকে জিতেন বড়ুয়া জানান, ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ফুল বিজুকে কেন্দ্র করে শুক্রবার সকাল থেকে নদীর পাড়গুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলনমেলায় পরিণত হয়। বৈসাবি উৎসব উপভোগ করতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক এখন খাগড়াছড়িতে। পাহাড়ী সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, কিশোরী, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে হল্লা করে ফুল তুলে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে নদী-খালে ভাসিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে। এছাড়া ফুল দিয়ে ঘরের প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়। ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায়ও এদিন ফুল বিজু পালন করে। রাতে উড়ায় হাজারো ফানুস বাতি। আজ শনিবার মূল বিজু আর এর পরের দিন পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু, বিযুমা, বিচিকাতাল। ফুল বিজু, মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যতায় এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। ত্রিপুরা ভাষায় এ উৎসবকে বৈসু ও চাকমা ভাষায় বিজু বলা হয়। এদিকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব বৈসু উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে শোভাযাত্রা বের করেছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় সদর উপজেলা পরিষদ মাঠে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা উদ্বোধন করেন শরনার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। শোভাযাত্রাটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে খাগড়াপুর মাঠে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ তাদের তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে সপ্তাহব্যাপী আয়োজিত বৈসু মেলার উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক। এ উপলক্ষে ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্যেরও আয়োজন করা হয়েছে। রবিবার শেষদিন মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা ও জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে বর্ষবরণের র‌্যালি। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের নাম একত্র করে বৈসাবি শব্দটির উৎপত্তি। পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩ ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও অবস্থানকে বৈচিত্র্যময় করে করে তুলতে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বেসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে। বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি ও ঐক্য আরো সুদৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা সকলের। বান্দরবান থেকে এস বাসু দাশ নানান, বান্দরবান শহরের সাঙ্গু নদীতে সকালে বিভিন্ন ফুল ভাসিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের নববর্ষবরণের তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বিষু উৎসব। বিষু উৎসবে ফুলবিষু, মূলবিষু ও নয়া বছর মোট তিন দিন পালন করে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী। শুক্রবার সকালে বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে পাহাড়ী তরুণ-তরুণীরা সবার মঙ্গল কামনায় কলাপাতায় করে ভক্তি-শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে ফ্রল ভাসিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরের শুভ কামনা করেন। এ সময় ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে সাঙ্গু নদীর তীরে ফুল ভাসাতে শত শত তঞ্চঙ্গ্যা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ভিড় জমায়। আয়োজক কমিটির সদস্যরা জানান, ফুল বিষুর দিন বনজ ফুল, লতাপাতা দিয়ে ঘরদোর সাজিয়ে ছিমছাম করে রাখে প্রত্যেক তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার। সকালে বিভিন্ন বয়সের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে নদীতে ফুল ভাসিয়ে দেয় মা গঙ্গার উদ্দেশে। সকলের বিশ্বাস, মা গঙ্গা নাকি এতে সন্তুষ্ট হন এবং সারা বছর আশীর্বাদ করে থাকেন। আর মূল বিষুতে পরিবারের রসমলাইয়ের ন্যায় বিন্নি চালের গুঁড়ি দিয়ে মু-পিঠা তৈরি করে পরিবেশন করে থাকে। শেষ দিন সমগ্র জাতির শান্তি সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামানোর লক্ষ্যে বৌদ্ধবিহারে প্রার্থনায় মিলিত হন তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী। সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসাতে আসা কেতি তঞ্চঙ্গ্যা জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ি সাজাই আর নদীতে ফুল ভাসানোর জন্য ফুল সংগ্রহ করি আর ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে আমরা পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে গ্রহণ করি । ঘিলা খেলায় আসা রোয়াংছড়ি উপজেলার ওয়াইগাই পাড়া থেকে প্রীতি তঞ্চঙ্গ্যা জানান, এক ধরনের লতার বীজ নিয়ে আমরা ঘিলা খেলা খেলে থাকি। পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীরা এই খেলা খেলতে আসে। এই খেলাকে আমরা মিলনমেলা বলে থাকি। এদিকে, বিকেলে ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটি। তারা আরও জানান, বিকেলে বালাঘাটা বিলকিছ বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আয়োজিত ঘিলা খেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর । বিষু উদ্যাপন কমিটির সদস্য সচিব উজ্জল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সকালে নদীতে ফুল ভাসানো হয়েছে। আর আয়োজন করা হয়েছে ঘিলা খেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এছাড়াও শনিবার সকালে নতুন বছরে পিঠা ও মিষ্টান্ন পরিবেশন এবং রবিবার সন্ধ্যায় সমগ্র জাতির শান্তি সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামানোর লক্ষ্যে বৌদ্ধ বিহারে প্রার্থনার মাধ্যমে ইতিটানা হবে বৈসাবি উৎসব। রাঙ্গামাটি থেকে মোঃ আলী জানান, কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসিয়ে শুক্রবার রাঙ্গামাটিতে ফুল বিজু শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকাল ভোরে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রান উদকমিটির আহ্বায়ক ইন্দ্র লাল চাকমার নেতৃত্বে এই ফুল ভাসানোর উৎসব পালন করেছে পাহাড়ী তরুণ-তরুণীরা। এ সময় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে হ্রদে ফুল ভাসাতে দেখা গেছে। অপরদিকে রাঙ্গামাটি শহরের গর্জনতলী এলাকায় ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে হ্রদে অনুরূপ ফুল ভাসানো হয়েছে। পুরনো বছরের সব দুঃখ, গ্লানি মুছে ফেলে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে তারা গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে এ ফুল ভাসায়। তরুণ-তরুণীদের সঙ্গী হয়ে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, রাঙ্গামাটি পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী ও রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সদস্য স্মৃতি বিকাশ ত্রিপুরা নেতৃত্বে এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে। ফুল ভাসানোর পরপরই শিশু-কিশোর, তরণ-তরুণীরা নিজেদের ঘরে ফিরে যায়। বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। শেষে বয়স্কদের স্নান করানো হয়। এছাড়াও পাড়ার বয়স্কদের শরীরে পানি ঢেলে তাদের আশীর্বাদ কামনা করেন তারা। পরিধান করা হয় নতুন পোশাক। তাদের বিশ্বাস মতে, পুরনো বছরের সব ময়লা, পাপ, আপদ, বিপদ, গ্লানি, ব্যর্থতা ধুয়ে-মুছে ফেলতে পানিতে ভাসানো হয় ফুল। এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানানো হয়, নতুন বছরে সবক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে সাফল্য অর্জন ও শুভ-মঙ্গলে বয়ে আসবে বলে মনে করেন তারা। তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী শুক্রবার ১২ এপ্রিল পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে তিন দিনের সার্বজনীন উৎসব শুরু হয়েছে। আজ শনিবার ১৩ এপ্রিল উদ্যাপিত হচ্ছে মূল বিজু। ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ গজ্যাপজ্যা (গড়াগড়ি) দিন ও বর্ষবরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। গোজ্যা পোজ্যে (গড়াগড়ি) দিন নানাবিধ পূজা, সকল প্রাণী সুখ-শান্তি প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী উৎসব শেষ হবে। পার্বত্য আদিবাসীদের মতে, বিজু মানে আনন্দ, নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আর চেতনার নতুন প্রেরণা। তাই এবার অভাব-অনটনের মধ্যেও যথারীতি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। উৎসবটির যথার্থে আনন্দমুখর করে তুলতে প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা ও বর্ষ বিদায় এবং বর্ষবরণ উপলক্ষে প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে আয়োজিত এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু এবং অহমিকারা বিহু ও ¤্রােরা সাংক্রান বলে আখ্যায়িত করে এই উৎসব পালন করে আসছে। রাঙ্গামাটিতে বর্ণাঢ্য নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিজু ,সাংগ্রাই বৈসুক ও বিষু শুরু হয়েছে ২ এপ্রিল থেকে। ওইদিন সাংগ্রাই বৈসুক ও বিষু সাংস্কৃতিক মেলা দিয়ে এই উৎবের আমেজ শুরু হয়েছে। ওই দিন রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে এই মেলার শুভ উদ্বোধন করেছেন রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এমপি। এছাড়া বৈসাবি উপলক্ষে বৈসাবি উদ্যাপন কমিটির উদ্যোগে শহরে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হয়েছে। চৈত্রমাসের শেষের আগের দিনকে বলে ফুল বিজু, এই দিনে পাহাড়ী মেয়েরা নদীতে ফুল ভাসায়। শেষ দিনে পাহাড়ীরা মূল বিজু পালন করে এদিন সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে কাটায় পাহাড়ী জনপদের তরুণ-তরুণীরা, ঘরে ঘরে নিমন্ত্রণ আর আতিথেয়েতা গ্রহণের। সে এক অনাবিল আনন্দ। ওইদিন প্রতিটা পাহাড়ীর ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী খাবার পাঁচন ভোজন হয়। একের ঘরে অন্যরা গিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। অতিথিদের মাঝে ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাঁচন’ পরিবেশন আর একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসব তার চিরায়ত ব্যঞ্জনায় রূপ লাভ করে। বহু প্রকার সবজি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই পাঁচন তৈরি করা হয়। যা অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পাহাড়ী বাঙালী সকলের জন্য অত্যন্ত প্রিয় থাবার। পাহাড়ীদের বিশ্বাস, এই পাঁচন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া একদিনে সাত পরিবারে এই পাঁচন খেলে সর্বরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। বিজুর দিনে পাহাড়ীদের বাসায় পাহাড়ী-বাঙালী সবাই যায়। এদিন ফুটে ওঠে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। শেষের দিন গজ্যাপজ্যা করে তাদের উৎসবের সমাপ্ত করে।
×