ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা আইএমএফের ॥ ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে উন্নয়ন

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

 সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা  আইএমএফের  ॥ ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে উন্নয়ন

এম শাহজাহান, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ॥ বসন্তকালীন সভা-শিরোনামের মধ্যেই যেন প্রাপ্তির আভাস। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন সভা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী শুক্রবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ওই বৈঠকে আইএমএফ বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও আর্থিকখাত উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সুনাম ফিরিয়ে আনবে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। দারিদ্র্য বিমোচন এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সদস্য রাষ্ট্র ১৮৯ দেশে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ। পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যে তিক্ততা তৈরি হয়েছিল তা দূর হয়েছে। বাংলাদেশ যে তাদের পরীক্ষিত ক্লায়েন্ট ও বন্ধু তা আজ প্রমাণিত। এখন আস্থার সম্পর্ক বেড়েছে। আর এ কারণেই দেশের ব্যাংকিংখাত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা নিতে চায় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী পর্যায়ের প্রথম বৈঠকেই আইএমএফ জানিয়ে দিল বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও আর্থিকখাত উন্নয়নে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোর সাড়ে ৪টায় ওয়াশিংটন ডিসিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাত উন্নয়নে আইএমএফ সব ধরনের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এ কারণে ব্যাংকিংখাতের সমস্যা দূর করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের টুলসকে কাজে লাগানো হবে। খুব শীঘ্রই আইএমএফ কাজ শুরু করবে। অর্থমন্ত্রী বলেন,ব্যাংকিং খাতে একক ব্যক্তি ঋণ সীমা (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজারস) থাকবে না। ভাল ঋণ গ্রহীতারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ নিতে পারবেন। কিন্তু খারাপ ঋণ গ্রহীতাদের জন্য বহাল রাখা হবে একক ব্যক্তি ঋণ সীমা। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ সম্মেলনের তৃতীয় দিনে অর্থমন্ত্রী বৈঠক করেছেন আইএমএফের সঙ্গে। এ সময় আলোচনায় ওঠে আসে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ও আগামী পহেলা জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ। এ সময় ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, সমস্যা নিয়ে অর্থমন্ত্রী খোলা মেলা আলোচনা করেন এই সংস্থার উর্ধতনদের সঙ্গে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ সময় বলেন, আগে ব্যাংকিং খাতে এক ব্যক্তির ঋণ সীমা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হতো। এ নিয়ে শঙ্কায় পড়তে হতো যে, টাকা নিয়ে তা ফেরত দিবে কিনা। কিন্তু আমরা চাই একজনই ব্যাংকের সব টাকা গ্রহণ করুক। তাতে আপত্তি থাকবে না। তবে তাকে হতে হবে ভাল ঋণ পরিশোধকারী। আর ভাল ভাবে ঋণ পরিশোধ করে দেশের অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে গেলে তাকে ঋণ দেবো না কেন পাল্টা এমন প্রশ্ন রাখেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী একক ব্যক্তি ঋণ সীমা সংশোধনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, এটি এমন কোন বাইবেল না যে তা পরিবর্তন করা যাবে না। ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্তসহ আরও অনেক কিছু আছে। যা ধীরে ধীরে ঠিক করা হবে। এ সময় তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে একক ব্যক্তির ঋণগ্রহণ সীমা থাকবে না। একক ব্যক্তি ঋণ সীমা তাদের জন্য রাখা হবে যারা খারাপ ঋণ গ্রহীতা। যারা ভাল ব্যবসায়ী, সৎ উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করবে, দেশের ব্যবসা বান্ধব পরিবেশে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে। তাদের জন্য একক ব্যক্তি ঋণ সীমার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর কোন দেশে এটি নেই। জানা গেছে, আইএমএফের কাছে দেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। একদিকে প্রতিষ্ঠান অপর দিকে মানব সম্পদ দু’টির সক্ষমতা বাড়াতে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত বিভিন্ন ভাবে দুর্বল আছে। কিছু কিছু স্থানে সমস্যা আছে। এসব সমস্যা দূর করতে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়। কারণ এসব সমস্যা দূর করতে তাদের কাছে কার্যকর টুলস আছে। এই টুলস ব্যবহার করে ব্যাংকিং খাতকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসবে। ব্যাংকিং খাতে কাজ করতে সংস্থাটি রাজি হয়েছে। খুব শীঘ্রই তারা স্টাডি করে কিভাবে সুন্দর ও সফলভাবে ব্যাংকিং খাত পরিচালনা করা যায় সে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকিং খাতের কোন বিষয়ে সহযোগিতা নেয়া হবে আইএমএফের এ প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, অটোমেশন করা হবে। ব্যাংকিং খাতে এই অটোমেশন করতে সব ধরনের প্রযুক্তি তারা দিবে। ব্যাংকিং খাতে সারা বিশ্বে সফল হয়েছে ব্লক চেন প্রযুক্তি। এটি তাদের কাছে আছে। তারা এই প্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, প্রযুক্তি কোন দেশ থেকে আনতে হবে এসব বিষয়ে পরামর্শ দিবে। এটি কার্যকর করতে জনবল তৈরি করতে হবে। এ কাজটিও আইএমএফ করবে। কারণ তারা এ বিষয়ে অনেক শক্তিশালী। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর হবে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, অনলাইন ও অটোমেশনে গেলে ব্যাংকিং খাতে অনেকাংশেই অনিয়ম অন্যায় কমে যাবে। বর্তমানে এক ব্যক্তি ১০টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এরমধ্যে ৫টি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আরও ৫টি ব্যাংকে যাচ্ছেন। এভাবে টাকা পয়সা নিয়ে অপরাধ বাড়ান। কিন্তু অটোমেশন হলে এক স্থান থেকে বসে ধরা যাবে এক ব্যক্তি কয়টি ব্যাংকে যাচ্ছেন। নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ আইন বাস্তবায়নের পেছনে অনেক উদ্যোগ ছিল আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইএমএফের। আইনটি প্রণয়নে আর্থিক ও জনবলের দিক থেকে সহায়তা করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছে। সংস্থাটির সুপারিশ ছিল নতুন ভ্যাট আইনে সিঙ্গেল রেট। এটি তারা চেয়েছে। অনেক আলোচনার মাধ্যমে সংস্থাটি রাজি হয়েছে ভ্যাটের তিনটি স্তর থাকবে। আগামী বাজেটে নতুন ভ্যাট হার হবে ৫, ৭.৫ ও ১০ শতাংশ। আগে ছিল ১৫ শতাংশ, সেটি ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। সংস্থাটি তা মেনে নিয়েছে। কাস্টমসের ক্ষেত্রে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ থাকবে। তবে ভোগের দিক থেকে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ থাকবে না। সেটি হবে ১০ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, সব তুলে দিলে বাজেট বাস্তবায়ন হবে না। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের সুখবর হচ্ছে আইএমএফের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করতে রাজি হয়েছেন। আশা করছি এই সফরের সময় দেশের উপকার হবে এমন নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাব। এর আগে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেছেন। আইএমএফ প্রেসিডেন্ট সফর করলে বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো পূরণের সুযোগ পাব। প্রবৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক একমত হয় না। কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের ক্যালেন্ডার ইয়ার আমাদের ফিসকেল ইয়ার এখানে গরমিল হচ্ছে। বিশ্বব্যাংককে ধন্যবাদ দিচ্ছি এ বছরই তারা বলেছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কারণ তারা কখনই ৬ শতাংশের ওপরে বলে না। এবার ৭ শতাংশের ওপরে বলেছে সংস্থাটি। আর প্রকৃতভাবে এটি আট শতাংশ অতিক্রম করবে। এদিকে, আইএমএফের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষে স্থানীয় সময় আজ শনিবার বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তিনি দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা কামনা করবেন। শুধু তাই নয়, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও চিকিৎসার মতো সেবা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি চাইবেন। এছাড়া বাংলাদেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান তৈরি করছে একরম প্রকল্পে অর্থায়ন করার আহবান জানাবেন অর্থমন্ত্রী। আগামী ১৪ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠক শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
×