ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশাসন সতর্ক হলে নুসরাতকে হত্যার ঘটনা ঘটত না

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

 প্রশাসন সতর্ক হলে নুসরাতকে হত্যার ঘটনা ঘটত না

ওসমান হারুন মাহমুদ, সোনাগাজী থেকে ফিরে ॥ নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনাস্থল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা শুক্রবার দুপুরে পরিদর্শন করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল মাহমুদ ফয়জুল কবির। তিনি ঘটনাস্থলের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। পরে সাংবাদিকদের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, গত ২৭ মার্চ রাফির সঙ্গে অধ্যক্ষের যে ঘটনা হয়েছে তার জের ধরে ৬ এপ্রিল নৃশংস ঘটনাটি ঘটে। ২৭ মার্চেও ঘটনাটির জন্য মাদ্রাসা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক হলে ৬ এপ্রিলে এ ঘটনা ঘটত না। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা সমাজের প্রভাশালী ব্যক্তিদের দিয়ে আড়াল করে রেখেছিল, প্রকাশ হতে দেয়নি। ২৭ মার্চ ঘটনার পর রাফির সঙ্গে সোনাগাজী থানার ওসির অশালীন আচরণের এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, থানায় ১ টি মেয়ে আশ্রয় নিতে এসে সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে কতটুকু কথা বলতে পারে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বোঝা উচিত ছিল। মানবাধিকার কমিশন পরিচালক বলেন, যেখানে জীবনের অধিকার নেই সেখানে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। সাক্ষীদের দেয় তথ্য থেকে তিনি নিশ্চিত যে রাফি হত্যার ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা। ইতোপূর্বেও এ অধ্যক্ষ ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে তার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। কিন্তু অন্যরা তা নীরবে সয়ে গেলেও রাফি নারী জাতির সম্মান-ইজ্জত রক্ষার জন্য সাহসী ভূমিকা রেখেছে। অধ্যক্ষের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ৬ এপ্রিলের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। ১৪৪ ধারার মধ্যে কিভাবে বহিরাগত ঘাতকরা প্রবেশ করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে আল মাহমুদ ফয়জুল কবির বলেন, একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪ জন প্রবেশ করে কোন ঘটনা ঘটিয়ে যাবে এটা সম্ভব নয়। তদন্ত প্রক্রিয়ায় এটা বের করা হবে। কারণ, যেখানে রাফির ভাই নোমানকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি সেখানে ৪টি বাইরের লোক কিভাবে প্রবেশ করেছে। মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটা বলতে পারেনি। খুবই পরিকল্পিতভাবে সকলের চোখের অন্তরালে এটা ঘটানো হয়েছে। যেহেতু পরীক্ষার সময় ১৪৪ ধারা ছিল এ সময়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাফিকে হত্যার জন্য এরা ছাদে ওঁৎ পেতেছিল। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার হাতে নাসরিন সুলতানা ফুর্তির শ্লীলতাহানির চেষ্টার বিচার না হওয়ায় নুসরাতকে মারা যেতে হয়েছে। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার হাতে নাসরিন সুলতানা ফুর্তির শ্লীলতাহানির চেষ্টর বিচার না হওয়ায় নুসরাত জাহান রাফিকে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টার প্রতিবাদ করায় নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ থাকায় অধ্যক্ষ বেপরোয়া হয়ে নারী কেলেঙ্কারি, ছাত্রীর শ্লীলতাহানি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকার পরও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে বহাল ছিল সিরাজউদদৌলা। গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষা কেন্দ্রে ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায় নুসরাতকে হলের ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকারী বোরকা পরা ৪টি মেয়ে কিভাব পুলিশ, মাদ্রাসার কর্মচারীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরাপদে পার হয়ে গেল, এ প্রশ্নটি এখন সামনে এসে গেছে। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে ছাত্রী নাসরিন সুলতানা ফুর্তিকে অশালীন কথার মধ্য দিয়ে জোরপূর্বক শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায়। নাসরিন জোর করে তার কক্ষ থেকে বের হয়ে বাসায় চলে এসে বিষয়টি তার বাবা-মাকে জানায়। তার বাবা সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সদস্য জামশেদকে জানলে তিনি বিচারের আশ্বাস দিয়েও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ায় বেপরোয়া অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়নি নুসরাত জাহান রাফি। গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগটি প্রত্যাহারের জন্য কোন চাপের কাছে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মাথা নত করেনি নুসরাত জাহান রাফি। জীবনের শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিবাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে তার জীবন দিয়ে তা রক্ষা করে গেছে। পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। হলের ৮নং কক্ষের রাফির বসার জায়গাটি খালি পড়ে আছে। পরীক্ষার হলে তার শূন্যতা সহপাঠিদের কাঁদাচ্ছে। সহপাঠীরা পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে নুসরাতের বসার স্থন (সিট) খালি দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে কাঁদতে থাকে। গত ৬ মার্চ পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকার মধ্যে দিয়ে বোরকা পরা ৪ মেয়ে রাফিকে হলের ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কারো চোখে পড়ল না তারা কারা। হলের একটি মাত্র সিঁড়ি দরজা। এ পথ দিয়ে কার মদদে সরে গেছে ঘাতকরা বিষয়টি তদন্তে স্থান পেয়েছে বলে জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল মাহমুদ ফয়জুল কবির ও সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল পারভেজ। ঘটনাটি নিয়ে জেলা প্রশাসনের গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত টিমকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা বলা হলেও তদন্ত কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে সময় আরও ৫ কর্মদিবস বাড়ানো হয়েছে। শুধু সোনাগাজী, ফেনী নয় সারা দেশের মানুষ শিক্ষকের মুখোশধারী লম্পটদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে। সকলের একটাই দাবি আর কারো সন্তন যেন এ ধরনের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অকালে প্রাণ না হারায়। সিরাজউদদৌলার খুঁটির জোর কোথায় ॥ জামায়াতের রোকন (পরবর্তীতে অপকর্মের জন্য জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত বলে জামায়াতের দাবি) অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার খুঁটির জোর সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিন। রুহুল আমিনের ছত্রছায়া থেকে অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাত, ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা শুধু নয় ধর্ষণের মতো অপরাধ করে পার পেয়ে আসছে বছরের পর বছর এমন অভিযোগ রয়েছে। এ রুহুল আমিন সোনাগাজী থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম ভুঞা ও জামায়াতের রোকন মাওলামা হোসেন আহম্মদের সঙ্গে গোপন আঁতাত রেখে এলাকায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে নিজের স্বার্থ হাসিল করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার কমিটি গঠনের সময় তার আশীর্বাদপুষ্টদের স্থান করে দিয়ে মাদ্রাসার মালিকীয় দোকারঘরসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোত লোপাট চালিয়ে আসছেন। এসব লোপাটে সহায়তা করে আসছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা। পৌরসভার কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মামুন মাদ্রাসার তহবিল থেকে ৩৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৭ সালে মাদ্রাসা সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ জমা দেয়। পরবর্তীতে রুহুল আমিন প্রভাব খাটিয়ে ভুয়া ভাউচার দিয়ে অভিযোগটি ধামাচাপা দিয়ে সিরাজউদদৌলাকে রক্ষা করে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা তার সঙ্গে আছেন এমন প্রচার করে উম্মুল কোরান নামের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কথা বলে প্রবাসীসহ বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা না করায় এবং যারা টাকা প্রদান করেছিল তাদের টাকা ফেরত না দেয়ায় ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট আবদুল কাইয়ুম বাদী হয়ে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪৫০৬ টাকা পাওনা দাবি করে ফেনীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। সিরাজউদদৌলা ইতোপূর্বে আরও মাদ্রাসা ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে মাদ্রাসার সহসভাপতি রুহুল আমীন ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে অধ্যক্ষকে সে যাত্রায়ও রক্ষা করে। একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা অপরাধ করতে দ্বিধা করছে না। তার লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়নি মাদ্রাসার ছাত্রী ছাড়াও প্রবাসীর স্ত্রী যারা তার কাছে দোয়া চাইতে আসত এমন গৃহবধূরা। বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে এলাকায় আলোচনায় থাকলেও সিরাজউদদৌলা আওয়ালী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের আশীর্বাদপুষ্ট বিধায় কেউ এর প্রতিবাদ বা মুখ খুলতে সাহস করেনি। গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা গ্রেফতার হলে গত ৩০ মার্চ রুহুল আমীনের অনুসারী সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুর রহমানের (আলু মাকসুদ) নেতৃত্বে সিরাজউদদৌলার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও থানা ঘেরাও করে। গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষার হলে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার পর একের পর এক সকল ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। বর্তমানেও রুহুল আমীনের অনুসারীরা প্রকাশ্যে এ ঘটনার বিচার চাইলেও গোপনে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা নুসরাত আত্মহত্যার করতে চেয়েছিল বলে প্রচার চালতে থাকে। প্রথমদিকে পুলিশও রুহুল আমীনের অনুসারীদের প্রচার করা বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে সরব হয়ে উঠলেও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশ চুপসে গেলেও রুহুল আমীন ও তার অনুসারীরা গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
×