ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ বুদ্ধিজীবী নূতন চন্দ্র সিংহ

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

শহীদ বুদ্ধিজীবী নূতন চন্দ্র সিংহ

সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সঙ্কটকালে বৌদ্ধিক পরামর্শদানের মাধ্যমে যথার্থ দিকনির্দেশকারী পন্ডিতকে বলা হয় বুদ্ধিজীবী। Oxford English Dictionary-তে বুদ্ধিজীবীকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এমন একটি সম্প্রদায় যা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশ দ্বারা গঠিত এবং যারা জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা নীল নকশার অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী নিধনে অংশ নেয়। এটি শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মধ্য দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ এপ্রিল ১৯৭১, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে হত্যা করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী নূতন চন্দ্র সিংহকে। নূতন চন্দ্র সিংহকে নিয়ে গত পাঁচ দশকে নানা আলোচনা হয়েছে। নানামাত্রিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে দেশের প্রতি ঈশ্বরের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস, নারী শিক্ষায় অপার আগ্রহ কিংবা একজন পরোপকারী মানুষের মন। এর বাইরে গিয়ে আমি তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী বলছি। কারণ জীবনকে তিনি পরিচালনা করেছিলেন বুদ্ধি দিয়ে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে নূতন চন্দ্র রাউজানের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে নারী শিক্ষার আলো জে¦লেছিলেন। এই স্কুল নিয়ে আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে ড. রশিদুল হক লিখেছিলেন, ‘আমাদের ধারণাই ছিল না যে গ্রাম-দেশে এরকম সুন্দর, সুপরিচালিত একটি স্কুল বিশেষ করে মেয়েদের স্কুল থাকতে পারে।’ আজকে কুন্ডেশ্বরী গ্রামের অবস্থা অনেক বদলেছে, নগরায়নের ফলে বদলেছে রাউজানের পুরো চিত্র। এরপরও একটি মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবা দুষ্কর। সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আজ থেকে পাঁচ দশক আগে নূতন বাবু বলা যায় মোটামুটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে একটি বিপ্লব করেছেন। সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমাজ বদলানোর ব্রত নিয়ে নূতন বাবুর এই উদ্যোগ বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তার প্রতিফলন। তাই শিরোনামে তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছি। অনেকে বলতে পারেন নূতন বাবু তো পড়াশোনা করেননি, স্থানীয় পাঠশালায় নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত বিদ্যার দৌড়, তাকে কিভাবে বুদ্ধিজীবী বলছি? এই জিজ্ঞাসার মধ্যেই নূতন বাবু অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই সত্যি। কিন্তু সমাজের নারীদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে সেই অশিক্ষিত লোকটি গড়ে তুললেন পাঠশালা। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির, ১৯৭০ সালে কুন্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয়। আর এই জ্ঞান অনুরাগের পেছনে মূলত কাজ করেছে তাঁর স্বশিক্ষা। নূতন বাবু পাঠশালায় না গেলেও এই স্বশিক্ষার আলোয় তিনি আলোকিত হয়েছেন। সেই জ্ঞানের শক্তি, কিংবা আলোর দেবতাকে মোকাবেলার শক্তি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কিংবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের, সালাউদ্দীন কাদেরের ছিল না। ফলে তাকে, তাঁর বুদ্ধিভিত্তিক চর্চাকে থামাতে বেঁছে নেয় হত্যার পরিকল্পনা। একাত্তরে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ২৮টি শিক্ষক পরিবার নূতন বাবুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই আশ্রয় প্রার্থীদের একজন ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক জনাব মোকাদ্দেসুর রহমান। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ. আর. মল্লিক তাঁর আত্মজীবনীতে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন। ‘আমার জীবনকালও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, এর কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাড়তে হলো। কারণ তখন যুদ্ধ বেশ ভালভাবে আরম্ভ হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছিল। আমাদের দুই ছাত্র আবদুর রব (ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক) এবং ফরহাদ ২৯ মার্চ কাপ্তাই রোডের ওপর সন্মুখ সমরে শাহাদাত বরণ করে। ক্যাম্পাসে যেসব শিক্ষক পরিবার ছিল তাদের পাঠিয়ে দিলাম কুন্ডেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলে। ওখানে সব পরিবার জমা হলেন। নূতন সিংহ সবার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। উপাচার্য ড. এ. আর. মল্লিকের আরেক সহকর্মী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পরিবার ছিল আশ্রিত ২৮টি পরিবারের একটি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার একাত্তরে’ লিখেছেন, ২৯ তারিখে পাকিস্তানীরা আরও সাফল্য লাভ করে, চট্টগ্রামের অনেকখানি তাদের দখলে চলে আসে। তখনই ক্যাম্পাসবাসীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা যায়। শেষে স্থির হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে রাউজান ও নাজিরহাট- এই দুই পথে সবাইকে সরিয়ে নেয়া হবে। যাদের নিজেদের আশ্রয় আছে, তারা সেখানে চলে যাবে। যাঁদের নেই, তাদের থাকবার ব্যবস্থা হলো কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের হোস্টেলে। নূতন সিংহ (শহীদ) স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রফুল্লরঞ্জন সিংহকে দিয়ে এই আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। একাত্তরে নূতন চন্দ্র সিংহ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষদের আশ্রয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। বড়ই পরোপকারী আর নির্লোভ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নূতন বাবু বুঝতে পারেননি এটি তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। আমি উনসত্তর পাড়া, জগতমল্লপাড়া গণহত্যা নিয়ে কাজ করেছি, এই বিষয়ে আমার দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখেছি সালাউদ্দীন কাদের ও তার পিতার পরামর্শে একাত্তরের এই দিনে রাউজানে কি নির্মমতা, বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে। নূতন বাবুসহ জগতমল্লপাড়ার হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর পরিকল্পিত হত্যা-নির্যাতন চালানো হয়েছে। নূতন বাবুর আত্মা স্বর্গে আজ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কারণ তার হত্যাকারীদের হয়েছে উপযুক্ত সাজা। অথচ নূতন বাবুর হত্যার পর স্বাধীন দেশে এই হত্যাকারীর নামও উচ্চারণ করতে কেউ সাহস করেননি। এমনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও নয়, ‘আমার একাত্তরে’ আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগের এক নেতার পুত্রের ইঙ্গিতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ফিরে আসে, এবং তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ১৩ এপ্রিল।’ ১৩ এপ্রিলের সেই ঘাতকের নাম সাকা চৌধুরী। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকবার খুব কাছ থেকে নূতন বাবুর হত্যাকারীকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। শুনেছিলাম এপ্রিলের সেই সব কালো দিনের কথা, একজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার ইতিহাস। বয়োবৃদ্ধ হলেও, স্বাধীনতার ওপর নূতন বাবুর অধিকার জন্মাল, স্বাধীনতার সঞ্জীবনী মন্ত্রে তাঁর অশক্ত শরীরও জেগে উঠলো। নূতন চন্দ্রকে দেশের প্রতি আবেগপ্রবণ করেছিল বঙ্গবন্ধু, যখন তিনি ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কুন্ডেশ্বরীর মাটিকে ধন্য করেছিলেন। নূতন বাবুর মধ্যে স্বদেশানুরাগ সুপ্তভাবেই ছিল, বঙ্গবন্ধু তাকে উস্কে দিলেন। এখন জাতি যখন মাতৃমুক্তির পণ করে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তখন মহান দেশব্রতী নূতন বাবুর কি পিছিয়ে থাকা চলে? তাঁর কুন্ডেশ্বরীর বিশাল বিস্তৃত প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে দিলেন মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য। গোলার ধান, পুকুরের মাছ, ক্ষেতখামারের ফসল মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সাধারণের জন্য বিলিয়ে দেন নূতন চন্দ্র। কুন্ডেশ্বরী ছিল মুক্তাঞ্চল। যেসব এলাকা পাক বাহিনীর দখলে চলে যাচ্ছে, সেসব এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃত্ববৃন্দসহ মুক্তি সংগ্রামী ‘জয় বাংলা’ বাহিনী, রণক্লান্ত সৈনিক, হানাদার বাহিনীর হামলার ভয়ে পলায়নপর নারী-পুরুষ-আবালবৃদ্ধবনিতা খাদ্য ও সাময়িক বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতিস্থল হিসেবে কুন্ডেশ্বরীকেই বেছে নিচ্ছিল। রাউজানের প্রধান সড়কের পার্শ্বস্থিত কুন্ডেশ্বরী সত্যিই এক ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিল সেই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ড. আনিসুজ্জামান নূতন বাবুকে ক্রমাগত তিনদিন অনুরোধ করেও তাকে ভারতে নেওয়ার প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে নূতন বাবুর একই জবাব- ‘আমি তো কারো ক্ষতি করিনি। জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এই শেষ বয়সে নিজের দেশ মাটি আর আরাধ্য দেবী কুন্ডেশ্বরীকে ছেড়ে কোথাও যাব না। যদি মরতে হয় এখানেই মরব। এখানে যদি মৃত্যু হয় তাহলে জানব এই-ই আমার নিয়তি, এই-ই মায়ের ইচ্ছা।’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমি বেদ, উপনিষদ, কোরান ও বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি দেশ ছেড়ে কিছুদিনের জন্য হলেও সীমান্তের ওপারে চলে যেতে। যুগে যুগে আসুরিক শক্তির কাছে দেবতারাও সাময়িক পরাভব মেনেছেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! মা আর দেশের মাটির টানে তাকে কিছুতেই একচুলও নড়াতে পারিনি।’ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি তাঁর অবস্থানে অনড় রইলেন। সে এক বিস্ময়। পাকিস্তানীরা যে কোন সময় আসতে পারে এই অনুমানে তিনি আগেভাগেই বাড়ির আঙ্গিনায় চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রেখেছিলেন। আর মৃত্যু অবধারিত জ্ঞান করে স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। নূতন চন্দ্র সিংহ, একজন স্বশিক্ষিত বুদ্বিজীবী। যিনি নারী শিক্ষার মধ্য দিয়ে সূর্যসেনের স্মৃতি বিজড়িত রাউজানে নতুন প্রভাত আনার চেষ্টা করেছিলেন। সমাজটাকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন জ্ঞানের আলোয়। আলোর এই যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের ও তাঁর ছেলে সালাউদ্দিন। সত্তরের নির্বাচনে পরাজয় শত্রুকে আরো হিং¯্র করে। একাত্তরের আজকের এই দিনে সেই হিংসা আর প্রতিশোধের আগুনে পুড়েছিল নূতন বাবুর কুন্ডেশ্বরী, জগতমল্লপাড়া, ঊনসত্তরপাড়া, পাহাড়তলী, পাশের পালিত পাড়া, বণিক পাড়া। হিংস্রতা আর বর্বরতা দিয়ে আলোর মিছিল ঠেকানো যায় না। নূতন বাবুর বিপ্লবও কেউ থামাতে পারেনি। আজকের আলোকিত রাউজান, আলোকিত কুন্ডেশ্বরী নূতন বাবুর স্বপ্নের প্রতিফলন। যে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরীরা। নূতন বাবুর কর্ম, দেশের জন্য তাঁর ত্যাগ যুগে যুগে তরুণদের অনুপ্রেরণার উৎস হবে। লেখক : শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়
×