ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ ॥ বানেশ্বর ও সারদার পতন

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

 ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ ॥ বানেশ্বর ও সারদার পতন

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না। ভারতের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য বৃদ্ধি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই’ সেই ভয়াবহ বিভীষিকাময় পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচতে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। তিনি সহজ সরল আর নিরস্ত্র বাঙালীকে সাহস যোগাতে লাগলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। ঘুরে দাঁড়াল বাঙালী। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ পেয়ে সেই সব বাঙালী সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাক বাহিনীর ওপর। সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস মার্কিন সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক খুন ও বেসামরিক লোকদের যথেচ্ছ হত্যার খবরে আমি আতঙ্কিত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশী সংবাদ দাতাদের বহিষ্কারের যে নীতি পাকিস্তান সরকার অনুসরণ করছে তার ফলে কংগ্রেসের সদস্যবর্গ ও বহির্বিশ্বের পক্ষে সেখানে কি ঘটছে তা জানা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক লোকদের পাইকারি হত্যা ও নির্বিচারে খুন-খারাপির খবরগুলো যতদিন পর্যন্ত না অসত্য প্রমাণিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি ও কন্ট্রোল রুম ঠাকুরগাঁও মহকুমার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত ২০টি প্রতিরক্ষা ক্যাম্প তুলে নিয়ে সীমান্তে অবস্থান নেয় এবং নেতৃবৃন্দ শহর ছেড়ে চলে যায়। গোয়ালন্দ ঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর একটি জলযান ডুবিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনী পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। সিলেট শহর সংলগ্ন লাক্কাতুরা চা বাগানের অসংখ্য চা শ্রমিককে পাক হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। নড়াইল শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। সকালে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে তিস্তা ব্রিজের অবস্থান ছেড়ে দেয় এবং পিছু হটে শিঙ্গের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাট নামক স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়। পাক বাহিনী টাঙ্গাইল দখলের পর ময়মনসিংহ শহর দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে এলে মধুপুর গড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পথ রোধ করে । দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। শত্রুপক্ষের প্রবল গুলিবর্ষণ সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের একজনও নিহত বা আহত হয়নি। অপরদিকে পাক বাহিনীর দু’জন ড্রাইভার ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই ছিলেন অস্ত্র চালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র। এদিন বগুড়া পাক বাহিনীর দখলে চলে যায়। বদরগঞ্জে পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে। পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে না এসে খানসামার পথ ধরে পেছন হতে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক পাকসেনারা খানসামার কাছে একটি নদী পার হতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায় এবং পাকবাহিনীর বালুচ ডি কোম্পানিকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে। বানেশ্বরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অনেক মুক্তিসেনা শাহাদাতবরণ করেন। বানেশ্বর ও সেই সঙ্গে সারদারও পতন হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ঘটনা ‘বানেশ্বরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সারদায় পাকসেনা চলে আসায় বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় দুই হাজার লোক নদীর ধারে আশ্রয় নেয়। পাক বাহিনী সবাইকে ঘিরে ফেলে এবং গুলি করে ও পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে প্রায় ৮০০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ বেদনাদায়ক ঘটনাটি মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সারদার গণহত্যা’ নামে খ্যাত। রাজশাহী সেনানিবাস এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকবাহিনী আর্টিলারি, পদাতিক ও বিমান হামলা চালায়। পাকসেনাদের এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সমবেত হয় এবং গোদাগাড়ীতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। বিকেল ৪টায় গঙ্গাসাগর ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাক বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করে। এ সংঘর্ষে পাক বাহিনীর ৩ জন অফিসারসহ অনেক সৈন্য মারা যায়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল শহীদ হন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার তেরোটি স্থানে সকাল সাতটা থেকে নির্মম ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। রাউজানের ইতিহাসের সেই নারকীয় গণহত্যায় কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহসহ ১৫৬ জন হিন্দু ও ১০ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের শপথ নেয়ার কথা ছিল না। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক সভায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত কুষ্টিয়া জেলার মহকুমা চুয়াডাঙ্গাকে বেছে নেয়া হয় এবং ১৪ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণের তারিখ চূড়ান্ত হয়। কিন্তু শপথ গ্রহণের তারিখ সে সময় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে প্রচার হলে বিদেশী সাংবাদিকসহ পাক হানাদার বাহিনী ঘটনা জেনে যায়। চুয়াডাঙ্গার ওপর পাক বাহিনী আক্রোশে ফেটে পড়ে। ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়ে পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। হার্ডিঞ্জ সেতু উড়িয়ে দেয়ার জন্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। চুয়াডাঙ্গা দখল ও পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আক্রান্ত হলে শপথ অনুষ্ঠানের সময় ও জায়গা পাল্টে যায়। পরে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য ভারত সীমান্তবর্তী বৈদনাথতলা বা মুজিবনগরকে বেছে নেয়া হয়। পাক বাহিনী পুনরায় রাজশাহী দখল করে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসররত পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য পুলিশ, বিডিআর, ছাত্র-জনতা মধুপুর ব্রিজের পূর্ব পাশে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাতে থাকে। এদিন মধুপুর যুদ্ধের পর পাকসেনাদের মুহুর্মুহু স্বয়ংক্রিয় ভারি অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকে। ঢাকায় শান্তি কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শান্তি কমিটি গঠনের পর এটিই ছিল তাদের বড় কর্মসূচি। এ মিছিলের সম্মুখভাগে ছিলেন- খান এ সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আযম, এএসএম সোলায়মান, একেএম শফিকুল ইসলাম, এটি সাদী, আবুল কাশেম, সৈয়দ আজিজুল হক, আতাউল হক, মেজর আফসার উদ্দিন, কবি বেনজির আহম্মদ, পীর মোহসেন উদ্দিন, অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ। কলকাতার দৈনিক যুগান্তর শেখ মুজিবুর রহমানের বরাত দিয়ে শিরোনাম করেছে ‘বাংলাদেশ সার্বভৌম ও স্বাধীন।’ কিন্তু হিংস্র নেকড়ের পাল ওই বাংলার ওপর হঠাৎ ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। একটি জাতির স্বাধীনতার বাসনাকে তারা দলিত করিয়ে ছিঁড়িয়ে ফেলিবে এই তাহাদের আকাক্সক্ষা, এই তাহাদের নির্লজ্জ হুঙ্কার। আগরতলা থেকে পিটিআইএর খবরে বলা হয় আজ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সাধারণতন্ত্র গঠিত হয়েছে। মুক্ত বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে এই রাষ্ট্র গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের নামও ঘোষিত হয়েছে। বর্তমানে এই মন্ত্রিসভাই সমরকালীন মন্ত্রিসভারূপে কাজ করবেন। বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে একজন বিশিষ্ট আওয়ামী নেতা এই খবর ঘোষণা করেন। এই নবগঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ মিশন নয়াদিল্লী থেকে বিশ্বের অন্যান্য রাজধানী এবং জাতিসংঘের কাছে যোগাযোগ করবে। মিশন আজ সকালে তার সদর দফতর শুরু করে। স্বাধীন বাংলার রেডিও সম্প্রচারে সরকার ভারত, সিলোন এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ও এর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার আহ্বান জানায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে সম্প্রচারের একটি আপীলও ছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্ত এলাকাগুলোতে জনগণের জন্য একটি নির্দেশনা জারি করেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×