ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টিউলিপের সংগ্রাম

রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সন্তান লালন

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ১২ এপ্রিল ২০১৯

রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সন্তান লালন

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নী টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের দৈনিক পত্রিকা দ্য গ্রাজিয়া ডেইলি’র গ্যাবি হিন্সলিফ-এর সঙ্গে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে তার ব্যক্তিগত এবং প্রতিদিনের রাজনৈতিক জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তার কঠিন মুহূর্তগুলো শেয়ার করেছেন। খবর বাসস’র। টিউলিপের সাক্ষাতকারটি নিচে দেয়া হল- টিউলিপ সিদ্দিক রান্নাঘরে রকিং চেয়ারে বসে তার দু’মাস বয়সী সন্তান রাফেলকে দেখভাল করছিলেন। এতে বোঝা যাবে যে, সবকিছু নিয়েই হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নের লেবার পার্টির এই সংসদ সদস্যকে ভাবতে হয়। তাকে পার্লামেন্টে একটি নাটকীয় সপ্তাহে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তাকে ভোট দিয়ে এমপি বানানোর জন্য তার ব্যক্তিগত সকল ব্যস্ততার মধ্যেও তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের নিয়ে ভাবেন। এরপর বিনা বিচারে আটক রাখার বিষয় নিয়ে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাবিদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন। একজন নারী হিসেবে আপনি বলতে পারেন না, আমি দুধ খাওয়াচ্ছি বলে আমি বৈঠক করতে পারি না। এটি একটি অদ্ভুত আইন, কাজের অর্ধেকে আছি, অর্ধেকে নেই। সম্ভবত এটি কোন নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটির ধারণা নয়। তবে একটি শিশু জন্মের পর সংসদ সদস্যদের সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। তিনি যখন মনে করলেন, লেবার দল সঙ্কটে পড়ার মাত্র ছয় সপ্তাহে তার কাছে মনে হয়েছে তার সংসদে যাওয়াটা জরুরী। পার্লামেন্টে প্রক্সি ভোট দেয়ার অস্থায়ী অধিকার নিশ্চিতের ৩৬ বছরের পুরনো ইতিহাস। এখন ভোট দিতে তাকে শারীরিকভাবে উপস্থিত হতে হবে। পরিস্থিতির কারণে হাসপাতাল ছাড়ার একদিন পরেই হুইল চেয়ারে করে সংসদে গিয়ে ব্রেক্সিট ভোটে অংশ নিতে হয়েছে। অস্ত্রোপচারের কারণে তাকে হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার, তারজন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব সহজ ছিল না। বিষয়টি নিয়ে তিনি তার চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করেন। চিকিৎসক তাকে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রসবের পরামর্শ দিয়েছিলেন। টিউলিপ বলেন, আমি সত্যি আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম, তিনি ভর্তি হলেন, তাকে দেখতে ভালই মনে হচ্ছিল, আমি ভেবেছিলাম আমার শিশুর স্বাস্থ্যের যদি কিছু হয়ে যায়, কিছু মেডিক্যাল সমস্যা নিয়েই তার জন্ম হয়। তবে আমি আমার স্বামী ও মার কাছ থেকে এ ব্যাপারে অনেক সাহস পেয়েছি। তিনি বলেন, আমি যা করেছি, ঠিকই করেছি। আমি এসেছি সরকারী চাকরিজীবী পরিবার থেকে। তার খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আমার মা বলতেন, যদি কখনও তোমার ডাক আসে তুমি সিদ্ধান্ত নিবে। আমার স্বামী আমাকে বলতেন, তোমার শরীর তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি খুব আতঙ্কিত থাকতাম। সৌভাগ্যবশত দু’দিন পরে নিরাপদেই রাফেলের জন্ম হয়। তবে টিউলিপ টেরেসা মে’র প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি তাকে বলেছিলেন, তাকে সহযোগিতা করতে পারবে কিনা। তার জীবনে এটি ছিল বড় ভোট। আমি তার সমস্যাটি বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি সমস্যাটি কটিয়ে উঠতে পেরেছেন এবং বলেছেন, আমি সত্যি দুঃখিত এই রাজ্যে তোমাকে দেখে। এক সপ্তাহ পরে সরকার প্রক্সি ভোট দিতে সম্মত হয়। শুধু নতুন মায়েদের জন্যই নয়, টোরি এমপি বিম এ্যাফোলামি পিতৃত্বকালীন ছুটির জন্য এ সুযোগ পেয়েছিলেন। টিউলিপের স্বামী ক্রিস একজন শিক্ষা বিষয়ক কনসালট্যান্ট। বাচ্চাদের দেখভালের বেশিরভাগ তিনিই করেন। এটি তাকে তার ওয়েস্টমিনস্টার ক্যারিয়ারে সহায়তা করেছে। তবে তা একেবারে বিনা চ্যালেঞ্জে যায়নি। টিউলিপ বলেন, ‘একদিন আমি বাসায় এলাম। আজালিয়া বললো সে তার বাবাকে চায়, আমাকে নয়। আসলে বাবার সঙ্গে এত বেশি সময় কাটিয়েছে যে, তার অগ্রাধিকার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। টিউলিপ বলেন, আমি না ভেবে পারলাম না যে, আমি যদি আরও বেশি কাছে থাকতাম তাহলে কি সে এমন বাবার নেওটা হতো? কিন্তু সে রাতেই আমি একটি ই-মেইল খুলে দেখতে পাই যে, বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কারণে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একটি পরিবারকে আমরা আবাসনের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। সমাজসেবার কাজে যখন সাফল্য আসে, কখন মানুষের জীবনে পরিবর্তন দেখা যায়, তখন মনে হয় আমার এ কাজ করার কারণ আছে। এটি করার যোগ্য। এছাড়া তিনি মনে করেন যে, অন্যান্য কর্মজীবী নারীর চেয়ে তিনি বেশি সুবিধাভোগী। তিনি বলেন, আমি কিলবার্নে অফিসে অভ্যর্থনার কাজ করা নারীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, অফিসে যেতে দেরি হলে তাদের কতটা মানসিক যন্ত্রণায় থাকতে হয়। যদি অফিসে যেতে পাঁচ মিনিট দেরি হয় তাহলে পাঁচ ইউরো কেটে নেন কর্মকর্তারা। কিংবা তাদের দুপুরের খাবার খাওয়ার বিরতি না পাওয়ার কথা। এসব শুনে আমার মনে হয়েছে আমি কিভাবে পেরে উঠব? আমি সবসময় পাঁচ মিনিট দেরিতে মিটিংয়ে যাচ্ছিলাম, কারণ কেউ আমাকে বমি করে দিয়েছে। তবু অধিকাংশ কর্মজীবী মা সম্পর্কে লোকে মাঝে-মধ্যে এটা-ওটা বললেও খুব অল্প সংখ্যককেই টিউিলিপের মতো অনেকটা প্রকাশ্যে এতটা সইতে হয়। টিউলিপ বলেন, আমার ভোটারদের ৯০ শতাংশই খুব সহায়ক, কিন্তু ১০ শতাংশ আছেন যারা স্থানীয় সংবাদপত্রে লিখে থাকেন, ও কেন যে আবার সন্তান নিচ্ছে? এক নারী একবার আমাকে বলেন, তুমি একই সঙ্গে মা ও এমপি হতে পারবে না। এমন চাপে নিজের ওপর সন্দেহ দানা বাঁধে। ব্রেক্সিটে ভোট দেবার জন্য গর্ভের সন্তানের সিজারের তারিখ পেছানোর জন্য অসম্মানজনক অভিহিত করা একটি ই-মেইলের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, সবসময় একজন খারাপ মা হবার একটি গোপন অপরাধবোধ কাজ করে। তিনি বলেন, অনেক চিন্তা-ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও লোকজন হুট করে বিরূপ মত দিয়ে বসে। দুঃখজনক হলো, এসব মত কখনওবা বাজে কথা বা তারচেয়েও খারাপ হয়। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে যেসব এমপি তাদের একজন এবং একজন মুসলমান এমপি হওয়ায় হত্যার হুমকিও পেয়েছেন। সম্প্রতি নতুন বাড়িতে আজালিয়ার খেলনা খোলার পর যে কাজটি তিনি প্রথম করেছেন তা হলো পেনিক বাটন সেট ও নিরাপত্তা ক্যামেরা সেট করা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় তিনি সহজে ভড়কে যান না। প্রক্সি ভোট দেয়ার সুযোগ থাকলেও ব্রেক্সিট প্রশ্নে কোন চূড়ান্ত ভোটে সশরীরে হাজির থাকতে চান টিউলিপ। তিনি একটি দ্বিতীয় গণভোট বা ব্রেক্সিট একেবারে বাতিলের পক্ষে। এ বিষয়ে প্রক্সি ভোট দিয়ে টিউলিপ ইতোমধ্যে তার দল লেবার পার্টিরও বিপক্ষে অবস্থান নেন। টিউলিপ মনে করেন প্রগতি সবসময় স্বস্তিকর হয় না। তিনি বলেন, আমি অনেক স্কুলে যাই, সেখানে মেয়েরা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, তরুণ নারীদের ক্ষেত্রে রাজনীতি করা কি খুব কঠিন? এ অবস্থায় কি জবাব দেব তা নিয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। এসব মেধাবী তরুণীদের আমি নিরুৎসাহিত করতে চাই না। তবে আমি এও চাই না যে তারা রাজনীতিতে এসে দেখুক যে আমি মিথ্যা বলেছিলাম। আমি শুধু মানুষকে বোঝাতে চাই যে, এমপি হওয়া মানেই এই নয় যে তার কোন সন্তান থাকতে পারবে না। অনেক ভাল নারী আছেন যারা পার্লামেন্টে আসেন না। আমাদের তাদের প্রয়োজন। আমরা তাদের অভাববোধ করছি।
×