ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অতিমাত্রায় কড়াকড়িতে উৎসবের স্বাভাবিক ছন্দ ম্লান

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১২ এপ্রিল ২০১৯

অতিমাত্রায় কড়াকড়িতে উৎসবের স্বাভাবিক ছন্দ ম্লান

মোরসালিন মিজান ॥ বৈশাখের বর্ণিল রূপটা এখন মোটামুটি দৃশ্যমান। উৎসবের আগেই উৎসবের আমেজ। বাংলা নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছে। এবারও সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতবে সব ধর্ম বর্ণের মানুষ। গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়বে মঙ্গল বারতা। অবশ্য বিকেল পাঁচটার মধ্যে পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান শেষ করে ঘরে ফেরার নির্দেশ এবারও বহাল রেখেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংস্কৃতিকর্মীরা এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। এমন কড়াকড়ি উৎসবের স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট করছে জানিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন তারা। রবিবার ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেয়া হবে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দিকে এখন কারও চোখ নেই। বাংলা বর্ষপঞ্জির দিকে সমস্ত মনোযোগ। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এবারও ঢাকায় শুরুটা হবে ছায়ানটের সঙ্গে। ভোর সোয়া ছয়টায় রমনার অশ্বত্থ তলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে ছায়ানট। আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অসিত কুমার দের রাগালাপে ঘুম ভাঙবে রমনার। পরে সম্মেলক ও একক গানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে অনুষ্ঠান। সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হবে ১২টি গান। একক শিল্পী তারও বেশি, ১৬ জন। এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত কম গাওয়া গানগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হবে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান না হলেই নয়। যথারীতি গাওয়া হবে। তবে নিয়মিত শোনা যায়Ñ এমন গান নয়। নজরুলের গানও অভিন্ন চিন্তা থেকে বেছে নেয়া। অনুষ্ঠানে থাকছে গণসঙ্গীত। সলিল চৌধুরীর লেখা প্রতিবাদী গান গাওয়া হবে। স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বহু জাগরণী গান লিখেছিলেন চারণ কবি মুকুন্দ দাস। সেইসব গান থেকেও গাইবেন ছায়ানটের শিল্পীরা। বাঙালীর প্রিয় লোক সঙ্গীতও বাদ যাবে না। এবার সুনামগঞ্জের লোকসাধক বহু জনপ্রিয় গানের গীতিকার সুরকার শাহ আবদুল করিমের গান গাওয়া হতে পারে বলেও জানা গেছে। অনুষ্ঠানে থাকবে পাঠ এবং আবৃত্তি। এ পর্বে অংশ নেবেন জহিরুল হক খান ও ত্রপা মজমুদার। অনুষ্ঠানের শেষপর্বে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে, সময়টিকে মূল্যায়ন করে দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দেবেন বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন। এর পর সকলে মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন। দেশের প্রতি এই প্রেমের কথা পুনর্ব্যক্ত করে শেষ হবে ১৪২৬ বঙ্গাব্দ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। বর্তমানে শিল্পীদের প্রায় সবাই ব্যস্ত রিহার্সালে। সন্ধ্যা হতেই বৈশাখের গান। উৎসবের আগে উৎসবমুখর ছায়ানট ভবন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একসঙ্গে বসে সম্মেলক গানের রিহার্সাল করছেন শিল্পীরা। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সামনের সারিতে। পেছনে বসে গাইছে শিক্ষার্থীরা। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের গান আরও শুদ্ধ সুন্দর করার এই চেষ্টা গত কয়েক মাস ধরে হচ্ছে বলে জানান ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা। তিনি বলেন, প্রায় ১০৫ শিল্পী সম্মেলক গান করবেন। নিয়মিত রিহার্সাল করছে তারা। মূল অনুষ্ঠানের আগে রমনায় চূড়ান্ত রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হবে। সব মিলিয়ে কাজ এগিয়ে চলেছে। এবারও সফল একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া যাবে বলে আশা করছে ছায়ানট। রমনার অনুষ্ঠান শেষ হতেই শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পহেলা বৈশাখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এই শোভাযাত্রা বের করা হবে। বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি ও লোক চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে চলবে আকর্ষণীয় র‌্যালি। সব বয়সী মানুষ এতে যোগ দেবেন। রাজধানী শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে চারুকলায় এসে শেষ হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্তমানে আয়োজনটি আরও বর্ণাঢ্য করতে কাজ করছেন আয়োজকরা। মূল দায়িত্ব পালন করছে চারুকলার ২১তম ব্যাচ। ব্যাচের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সাবেক ছাত্র ছাত্রীরা। সিনিয়র শিল্পীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন। কেউ ছবি আঁকছেন। কেউ আঁকছেন সরাচিত্র। মুখোশ পাখি ফুল ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। শিল্পকর্ম বিক্রির টাকায় আয়োজন করা হবে মূল শোভাযাত্রা। আকর্ষণীয় শোভাযাত্রায় ফুল পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর মোটিফ ব্যবহার করা হবে। সে লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পথিকৃৎ শিল্পীরা যে চেতনা থেকে চারুকলা অনুষদ গড়েছিলেন, যে চেতনা সামনে রেখে কাজ করে গিয়েছেন আমরা সেই চেতনা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক লোক চেতনাকে ধারণ করে আয়োজন করা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। তিনি বলেন, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। নানা সঙ্কট এসেছে। ষড়যন্ত্র হয়েছে। কোন কোন সময় অপশক্তি আমাদের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবে বর্তমানে ওই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসেছি আমরা। এখন সুন্দর সময়। তাই পজিটিভ বক্তব্য সামনে রাখা হচ্ছে। আশার কথা স্বপ্নের কথাই প্রধান হয়ে ওঠবে। জীবনের জয়গান করব আমরা। বৈশাখ সামনে রেখে চলছে কেনাকাটাও। গত কয়েকদিন ঢাকার মার্কেট ও শপিংমল ঘুরে দেখা যায়, দারুণ জমে উঠেছে কেনাকাটা। বৈশাখের পোশাকে এবারও প্রাধান্য পেয়েছে দেশীয় কাপড়। গরমের কারণে যতটা সম্ভব হালকা ও আরামদায়ক কাপড় বেছে নেয়া হয়েছে। রং যথারীতি সাদা ও লাল। মাত্র দু’টি রং। বহুবিধ ব্যবহার। কাপড়ের উপরে স্ক্রিনপ্রিন্ট, কাঁথা স্টিচ, এপ্লিকের কাজ করা হয়েছে। বসানো হয়েছে পুঁতি জরি ইত্যাদিও। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে নিপুণ, কে-ক্রাফট, অঞ্জনস, নগরদোলা, দেশাল, রঙ বাংলাদেশ, বাংলার মেলা, বিবিয়ানা, সাদাকালো, অন্যমেলাসহ কিছু প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্র আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। বৈশাখ সামনে রেখে বিশেষভাবে কাজ করেছেন তাদের ডিজাইনার। ফ্যাশন হাউসগুলোকে একসঙ্গে পাওয়া যায় বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে। ‘দেশী দশ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়েছেন উদ্যোক্তারা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বৈশাখের পোশাকে সুন্দর সাজানো দোকান। অন্যান্য রং একটু পেছনে ঠেলে দিয়ে সামনে রাখা হয়েছে সাদা ও লাল। রঙ বাংলাদেশের শোরুমের ইনচার্জ গৌতম জানান, বৈশাখ সামনে রেখে ২০ থেকে ২৫ ডিজাইনের পাঞ্জাবি করেছেন তারা। বিক্রিও হচ্ছে ভাল। দেশালের শোরুমের দায়িত্বে থাকা আশফাক জানান, বৈশাখের পোশাকে গ্রামীণ ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তারা। ইতোমধ্যে নতুন অনেক ডিজাইন শেষ হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি। দেশীয় পোশাকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট। এখানে জমজমাট কেনাকাটা। নামকরা ব্র্যান্ড নিত্য উপহারে গিয়ে দেখা যায়, অনেকগুলো নতুন শাড়ি তোলা হয়েছে। কোনটির জমিনে বাংলাদেশ। কোনটির আঁচলে গ্রামীণ গল্পগাথা। বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পভাষায় তুলে ধরা হয়েছে বৈশাখকে। কাপড়-ই- বাংলা’র শোরুমে মেয়েদের থ্রিপিস। ফতুয়া। বেশ রঙিন। দূর থেকে চোখে পড়ে। কাটিংয়েও কিছু ভিন্নতা আছে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বিথুন জানান, শেষ মুহূর্তে এসে বিক্রি বেড়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। এদিকে, বৈশাখের অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করার ঘোষণায় যারপরনাই অসন্তুষ্ট হয়েছেন বাঙালী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। সংস্কৃতিকর্মীরা হতাশা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। জাতীয় ভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সময় বেঁধে না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালীর সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই উৎসব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ভাল ফল বয়ে আনবে না। গত কয়েক বছর এটি করতে গিয়ে উৎসবের কিছু ক্ষতি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিকেল পাঁচটার পরও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময়ই তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। আমরাও সজাগ থাকব। এভাবেই সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে যেতে হবে।
×