ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাকিদ হায়দার

আত্মজৈবনিক ॥ কি যেন হারিয়ে এলাম

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১২ এপ্রিল ২০১৯

আত্মজৈবনিক ॥ কি যেন হারিয়ে এলাম

পূর্ব প্রকাশের পর আমীর হামজার প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে গেলাম, যেহেতু আমি ফুলবল দলের ক্যাপ্টেন, যেহেতু আমার হাতেই নতুন ফুটবল তুলে দেবেন আমাদের স্কুলের হেড স্যার, আর আমারই নাম ডাকবেন ড্রিল স্যার আফজাল হোসেন। সারারাত উত্তেজনায় ঘুমই হলো না। অন্য দিনের তুলনায় প্রায় আধ ঘণ্টা আগেই স্কুলে গিয়ে উপস্থিত হতেই দেখি আশীষ, হারু। আর শামু হারু আমাকে দেখেই এক গাল হেসে বলল, শুনলাম তুই নাকি ফুটবল প্লেয়ার হয়েছিস। বললাম ঠিকই শুনেছিস এবং একটু পরেই দেখবি আমার হাতে হেড স্যার মথুর স্যার ফুটবল, ব্ল্যাডার, পাম্প তুলে দেবেন, আর আমার নাম ধরে ডাকবেন ড্রিল স্যার। স্কুল শেষ হবার প্রায় আধ ঘণ্টা আগে, পাড়াভিত্তিক ফুটবল বিতরণে আমাদের দোহাপাড়া, আরিফপুর এবং ব্রজনাথপুর স্কুল ছাত্রকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ড্রিল স্যার বেশ উচ্চৈঃস্বরেই অন্যান্য পাড়ার ছেলেদের এমনকি হেড স্যারকেও শুনিয়ে বললেন, মাকিদের দলেই ছাত্র সবচাইতে বেশি। ড্রিল স্যারের কথানুসারে আমাদের দলকেই সবার আগে ফুটবল তুলে দিলেন ক্যাপ্টেন হিসেবে আমার হাতে, আমাদের পরে পেল কৃষ্টপুরের ছাত্ররা। তার পরে চকছাতিয়ানী, সবশেষে দ্বীপচরের ও চর কোষাখালির ছেলেরা সকলেই খুব খুশি মনে ৩-৪ মাইলের পথ প্রায় দৌড়েই নিজেদের বাড়িতে না গিয়ে, সরাসরি চলে গেলাম আরিফপুরের হাজীর মাঠে ফুটবল হাতে নিয়ে। রেফারি হিসেবে প্রায় তখনই পাওয়া গেল পাবনা সদর পোস্ট অফিসের পিয়ন, আমাদের আরিফপুর নিবাসী, সুন্দর টকটকে, মুখভর্তি দাড়িওয়ালা জয়নাল আবেদীন চাচাকে, তিনি নিজে ১ আনা পয়সা দিয়ে মোক্তার হোসেনকে দিয়ে একটি টিনের বাঁশি কিনে আনিয়ে, আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন রোকন (আমার ডাক নাম রোক পাড়াতে এই নামেই সকলেই চেনে) তুই ক্যাপ্টেন হিসেবে বাঁশিতে প্রথম ফুঁ দিয়ে দে। জয়নাল চাচার নির্দেশ অনুসারে প্রথম ফুঁ দিলাম বাঁশিতে আর তখনই মনে হলো, আমি একদিন পাবনা শহরের সবচাইতে বড় ফুটবল খেলোয়াড় অজিত কচা হব। আর তা যদি না হতে পারি তাহলে হব কাদের শফি অথবা চুন্নু নান্নুদের মতো একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড়। পরদিন স্কুলে এসেই শুনলাম, আগামীকালকে আমাদের স্কুলে, স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব আসবেন আমরা যেন দাঁত মেজে, চুলে তেল দিয়ে সুন্দর সিঁথি করে জুতায় কালি মাখিয়ে এবং ঝকমকে তকতকে ইস্ত্রিকরা জামাকাপড়ে যেন স্কুলে আসি। খবরটা হারুই আমাকে প্রথম জানাল। তার পরে হাদী, ইয়াকুব দ্বীপচরের দলিল, আরিফপুরের মোক্তার এবং আশীষ, গোপাল, সকলেই বলতে লাগল, গত কালকে যারা যারা ফুটবল ক্যাপ্টেন হিসেবে হেড স্যারের কাছ থেকে ফুটবল নিয়েছে তাদেরই নাকি স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব পড়া ধরবে। পড়া পারলে ঢাকায় নিয়ে যাবে আর না পারলে রাজটিকেট দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। কথাটি শুনলাম আরও ভালো করে স্কুলের দফতরি ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে একখানা নোটিস সকল ছাত্রকে পড়ে শোনালেন এবং বললেন, হেড স্যার বলেছেন, আমরা যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আগামীকাল স্কুলে আসি। স্কুল ছুটির পর দলবেঁধে আমরা যখন, জজকোর্টের সামনে রশিদ ডাক্তারের দাঁত তোলা এবং সেই গফুর সাপুড়ের সাপ খেলা দেখা শেষ করে প্রতিদিনের মতো আজকেও যখন ঐ দিকেই যাচ্ছিলাম, তখন দেখি আশীষ, হারু, দীপক, হাদী, স্বপন সাহা, গোপালঘোষ, ওরা হঠাৎ আমার নিকট থেকে জানতে চাইলো। স্কুল ইন্সপেক্টর কি কোন ইংরেজ সাহেব? গোপালের প্রশ্নের উত্তর আমি দেবার আগেই আশীষ রাখাল রায়ই বললো, বোধ হয় সাহেবই হবেন। বাবার নিকট থেকে শুনেছি, ইংরেজরাই নাকি স্কুল ইন্সপেক্টর আগেকার দিনে হতেন। পাবনার বিখ্যাত উকিল প্রভাত কুমার রায়ের ছেলে আশীষ রাখাল রায় যখন, ঐ কথা রায় দিল তখনি গোপাল ঘোষ, শেখ আব্দুল হাদী প্রায় একই সাথে বলে উঠলো, তাই-ই হবে, নয়তো হেড স্যার কেন দাঁত পরিষ্কার, জুতা পরিষ্কার, জামা পরিষ্কার করে কেন স্কুলে আসতে বললেন। নিশ্চয়ই ইংরেজ স্কুল ইন্সপেক্টর হবেন। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি ক্লাস টেনের কালাচাঁদ পাড়ার ফনিদত্তের বড়ো ভাই, প্রদীপদত্ত। তিনি আমাদের পেছন পেছন আসছিলেন, আর বোধকরি শুনছিলেন, আমাদের আলাপ আলোচনা। আশীষ আর হাদীকে থামিয়ে দিয়ে প্রদীপ বললেন, বছর কয়েক আগে সম্ভবত ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে হবে। সেই সময় আমেরিকান সরকার আমাদের এই জি.সি.আই স্কুলে গুঁড়াদুধের টিন, টিন ভর্তি ঘি, বিস্কুট, চকলেট এবং অনেক পুরাতন শীতের জামা-কাপড় দিয়েছিলো। আমরা সব ক্লাসের ছেলেরাই পেয়েছিলাম, তোমরাও তো পেয়েছিলে তাই না? প্রদীপ প্রশ্নের উত্তর আমিই দিয়ে বললাম আমরা অনেকেই সেই গুঁড়াদুধের টিন, টিন ভর্তি ঘি, বিস্কুট, পুরাতন জামা-কাপড় আমি ও হারু স্বপন পেলেও পায়নি। শামসুল, কেননা ঐ দিন শামু, হাদী এরা আসেইনি। আমাকে থামিয়ে দিয়ে ফনিদত্তর বড় ভাই প্রদীপ বললেন, সেই সব টিন ভর্তি দুধ, ঘি, লজেন্স, পুরাতন জামা-কাপড় দেবার আগে পাবনারই মুছওয়ালা এস.ডি. ও সাহেবের সাথে এক আমেরিকান সাহেব আমাদের স্কুলে এসেছিলেন। তিনি নাকি স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব ছিলেন, সেই ইংরেজ স্কুলে আসবার একদিন আগে আমাদের সব ক্লাসেই ঐ রকম নোটিস দিয়েছিল, হেড মাস্টার স্যার। এবারও বোধ হয় ঐ রকম আমেরিকান কোন স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব যদি স্কুল পরিদর্শনে আসেন, তাহলে সেই আগের মতো, আমরা সকল ছাত্র, মাস্টার, দফতরি সকলেই আমেরিকানদের ফেলে দেয়া জামা-কাপড়, টিন ভর্তি ঘি, বাটার ওয়েল, বিস্কুট, সব কিছু পাওয়া যাবে। তাই আমাদের সকলকে দাঁত পরিষ্কার, জুতা পরিষ্কার, জামা পরিষ্কার করে স্কুলে আসতে বলেছেন। তাই তোমরা আগামী কালকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্কুলে আসবে, হাজার হলেও তো আমেরিকান সাহেব। ঐ সাহেবেরাইতো গরিব দেশের লোকদেরকে বাড়ির চাকরদের মতো ভাবে, সাম্রাজ্যবাদের প্রধান ঐ আমেরিকানরা। ৫০ দশকের শেষে এবং ৬০ দশকের প্রথমদিকে পাবনায় একজন এস.ডি.ও ছিলেন, যার মুখ ভর্তি বিশাল গোঁফের জন্য পাবনাবাসীর নিকট থেকে তিনি উপাধি পেয়েছিলেন ‘মুচওয়ালা‘ এস.ডি.ও সাহেব। এস.ডি.ও সাহেবের নাম ছিল রজব আলী মজুমদার। আদি বাড়ি ভারতের কুচবিহার। তাঁর সততা এবং ন্যায় নিষ্ঠার জন্য পাবনাবাসীর নিকট এখনো তিনি প্রবাদতুল্য। জনাব রজব আলী মজুমদার পাবনাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় পাবনা সদর গোরস্থানে। গতকালের নোটিস অনুসারে এবং ঐ কথানুসারেই মাথা ভর্তি সর্ষের তেল দিয়ে আঁচড়িয়ে, জুতা যথারীতি কেরোসিন তেল দিয়ে পরিষ্কার করে এবং আমাদের প্রিয় আকাশী রং-এর তিন পকেটওলা জামা গায়ে দিয়ে কাঠ কয়লার মতোটা সম্ভব দাঁতগুলোকে পরিষ্কার করে অন্যদিনের তুলনায় প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই আমি দলবল নিয়ে যখন স্কুলে এসে পৌঁছলাম তখনই দেখি হারুর নেতৃত্বে আশীষ, হাদী এবং শামসুলের সাথেই দেখলাম তাদেরই লাহিড়ীপাড়ার আরো একজন ছেলেকে। পরে হারুর নিকট জানতে পারলাম ছেলেটির দুলাভাই ভালোদা অর্থাৎ আমাদের বিমল স্যার। আর ছেলেটির নাম স্বপন চক্রবর্তী। ওর বাবাও পাবনা শহরের নাম করা উকিল জ্ঞান চক্রবর্তী, স্বপনের বড় ভাই শংকরদা খুব ভালো বাঁশী বাজান। স্বপন চক্রবর্তীদের বাড়িটি রায়বাহুদুরের বাড়ির পূর্বদিকের যে দোতলা তার নিকেতন আছে তারই উত্তরদিকের হলুদ একতলা বাড়ির ছেলে। আমরা এই বন্ধু স্বপন, স্বপনও এসেছে স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেবকে দেখতে, ভালোদা অর্থাৎ ওর জামাইবাবু বিমল স্যার যেন না জানেন কথাটি। স্বপন চক্রবর্তী এমনভাবে বললো তাতে আমার মনে হলো, জামাই বাবুকে খুব ভয় পায়, আমাদের হারুর বন্ধু স্বপন চক্রবর্তী।............. দুপুরের কিছু আগে, আমাদের আরেকজন অংকের স্যার তার প্রিয় ছাত্র মাহতাব বিশ্বাসকে ডেকে নিয়ে বলে দিলেন যে, আজকে স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব যাবেন রাধানগরের আর.এম.একাডেমী পরিদর্শন করতে। রাধানগর মজুমদার একাডেমী গৌরি প্রসন্ন মজুমদার, বারীন মজুমদারদের বাপ-দাদাদের দেয়া নিজস্ব জমিদারীর ভেতরে ঐ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। তাই এই স্কুলে পরিদর্শন করবেন আগামীকালকে। আমি আর আমীর হামজা যখন জোর দিয়ে বললাম মাহতাব বিশ্বাসকে, তোকে বলতেই হবে কোন স্যার বলেছেন যে আজ স্কুল পরিদর্শনের স্কুল ইন্সপেক্টর আসবেন না? তখনি মুখ কাচুমাচু করে, মাহতাব বললো আমাদেরই অংক স্যার মাজাহার স্যারই তো বললেন। ঐ ব্যাটা আজকে আসবে না, তাই তো তোদেরকে বললাম। আমার পাশে হাদী আর হারু কিছু দূরে আশীষ, আর আজকেই যে নতুন এসেছে সেই স্বপন চক্রবর্তীর সামনেই, হারু-মাহতাবকে বললো, দেখেছিস কাকীমা শামসুলকে কি সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে, নিজ হাতে বাটার জুতার ফিতা, কি সুন্দর করে ফুল বানিয়ে, সেই জুতা শামসুলকে পরিয়ে দিয়ে, স্কুলে পাঠিয়েছে। পাতলা আকাশী রং-এর শার্ট, আর কালো জুতার উপর সাদা মোজায়, মোটা শামুকে দেখে সত্যিই হিংসে হলো আমার। এদিক সেদিক তাকিয়ে বললাম, শামু তোমার জামা, জুতা, খুবই সুন্দর হয়েছে, তবে দাঁত যদি দেখতে চায় ঐ স্কুল ইন্সপেক্টর। মনে হলো, শামু একটু ঘাবড়ে গিয়েই বললো, দিন কয়েক আগে একটি দাঁত পড়ে গিয়েছে। মা বলেছেন, স্যাররা যদি দাঁত দেখতে চান দেখিয়ে দেবে, আর সত্যি কথা বলবে, প্রতিদিনই আমি দাঁত ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করি। মাত্র দিন কয়েক আগে একটি দাঁত পড়ে গিয়েছে। শামুর সারল্যে ভরা কথা শুনেই, আমরা হা হা হেসে উঠতেই সেই মাহতাব বিশ্বাস বললো, স্কুল ইন্সপেক্টর যখন আসছে না, তখন আর কিসের ভয়। চল যাই জর্জকোর্টের সামনে গফুর সাপুড়ের খেলা দেখে আসি। সেই সুন্দর সকালের সুন্দর জামা কাপড় পরিহিত আমরা সেই কাক্সিক্ষত স্কুল ইন্সপেক্টরকে সেদিন দেখতে না পেলেও দেখতে পেলাম, স্কুলের দক্ষিণ দিকের ইছামতী নদী, তারই দক্ষিণে সাধুপাড়া। সেই সাধুপাড়া থেকে আরো দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের শানিক দুয়ার চর থেকে একলোক ঘোড়ায় চড়ে ডান হাতে বন্দুক নিয়ে, আমাদের স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চিনেবাদাম বিক্রেতার নিকট জানতে চাইলেম, আমাদের সহপাঠি মুনতাজ বিশ্বাসকে সে দেখেছে কিনা? চিনেবাদাম বিক্রেতা শাজাহান উত্তর দিয়েছিলো আমি যদিও জানি না, তবে ঘোড়ার উপর বসে থাকা হাতে বন্দুক দেখে আমরা অনেকেই উৎসুক হয়ে শাজাহানকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘোড়ায় বসে থেকে লোকটি কাকে খুঁজছিলেন? লোকটি তোমাদের ক্লাসের মুনতাজ বিশ্বাসকে খুঁজছিলো। উনি বিখ্যাত ‘শুটকা বিশ্বাস’ মুনতাজের বাপ নাকি, চাচা জানিনে, তবে খুব ডাকসাইটে মানুষ। ডি.সি, এস.পি, দারোগা, পুলিশ, চরের ঐ বিশ্বাসদের নাকি খুবই মানসম্মান করে কথা বলেন। শুটকা বিশ্বাসরা চরের সব জমির মালিক। উনি বোধ হয় এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র নেতা টিপু বিশ্বাসের ভাই। সেই আমার প্রথম দেখা ঘোড়ার উপর বসে থেকে ডান হাতে নিজের বন্দুকটাকে সুন্দর করে ধরে ঘোড়ার সাথে বন্দুকের বেল্টটিকে সযতেœ এটি সেঁটে দিয়ে সেই শুটকা বিশ্বাস এগিয়ে গেলেন, উত্তরের জর্জকোর্টের দিকে। যে জর্জকোর্টের সামনে একটু আগেই আমরা যেতে চেয়েছিলাম, গফুর সাপুড়ের সাপের খেলা দেখতে অথচ রশিদ ডাক্তারের গ্রামের লোকদের দাঁত তোলা এবং দাঁতের মাজন বিক্রির সময় যে সব গল্প বলে তাই শুনতে যেতে, যাওয়া হলো না। এমন সময় আমাদের তিন-চার ক্লাস উপরের প্রদীপ দত্ত, শ্যামল ঘোষ প্রায় দৌড়ে এসেই জানালেন, ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়েছে চীনের। মনজুর চায়ের দোকানের রেডিওতে এইমাত্র খবর দিয়েছে ‘আকাশবাণী’ থেকে। আমি অর হারু ছুটে গেলাম, গিয়ে খবর শোনা হলো না তবে মুহূর্তের ভেতরেই সমস্ত স্কুল, এমনকি সারা দেশে, বোধকরি সমগ্র পৃথিবী জেনে গিয়েছিলো, সেই ১৯৬২ সালে ভারত এবং চীনের যুদ্ধের খবর। আর সেই ১৯৬২ সালেই আমি দ্বিতীয় বারের মতো ঢাকায় বেড়াতে এলাম আমার ভাগনি শিউলিকে নিয়ে। আনোয়ারা খাতুন শিউলি, প্রধান শিক্ষয়ত্রী পাবনা সরকারী গার্লস হাই স্কুল। পাবনা থেকে আব্বা কি কাজে যেন ঢাকায় আসবেন। বড়ো বোন জোসনা আপা থাকতেন আজিমপুরে সরকারী বাসভবনে অর্থাৎ কলোনিতে। আমি আর শিউলি অনেক কেঁদে আব্বার সাথে ঢাকায় এলাম। জীবনে প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম আব্বার সাথেই সেই ১৯৫৯ সালে, জুলাই মাসে। দিন কয়েক ধরে নিউমার্কেট দেখলাম, দেখলাম জাদুঘর, দেখলাম রেসকোর্সের মাঠ। ঘোড়ার দৌড় এবং লালবাগ কেল্লা, একদিন অগ্রজ জিয়া ভাই এসে বললেন, তুই আর শিউলি পরশুদিন পাবনায় চলে যাবি। আব্বার যেতে আরো অনেক দেরি হবে, হাইকোর্টে কাজ আছে। জিয়া ভাইয়ের কথা শুনে জোসনা আপা বললেন, শিউলি আর রোকন, পরশুদিন পাবনা যাবে কি ভাবে, ট্রেনে? জোসনা আপার প্রশ্নের উত্তরে জিয়া ভাই বললেন, শিউলি আর রোকন দু’জনেই ঢাকা থেকে পি.আই.এ উঠে ঈশ্বরদী গিয়ে নামবে, সেখান থেকে ঈশ্বরদী বাস স্টেশনে যাবে। সেখান থেকে পাবনা শহরের দিলাপুরে বড়ো দুলাভাই অর্থাৎ শিউলির বাবার বাড়ি ফায়ার ব্রিগেড বা দমকল অফিসের উত্তর দিকের বাড়িটাই ছিলো আমার বড়ো দুলাভাই সিরাজ উদ্দিন ম-লের। জিয়া ভাইয়ের কথা শুনে আমার আর শিউলির কিছুতেই বিস্ময় কাটে না, কেমন করে আমরা সেই পি.আই.এ প্লেনে চড়ে ঈশ্বরদী যাবো কেমন করে নামবো, এমন সময় জিয়া ভাই জোসনা আপাকে বললেন, ওদের দু’জনের বিমানের ভাড়া ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ৪৪ টাকা আর কিসে যেন লাগবে ৪ টাকা, যেতে হবে পরশুদিন সকাল বেলা, সেই তেজগাঁ এয়ারপোর্টে। দেখতে দেখতে পরশুদিন এসে গেলো সেই সাথে এসে গেলো সেই সকাল বেলা। সেই সাথে জীবনে প্রথম বিমানে চড়বার অভিজ্ঞতা যখন পাবনায় ফিরে এসে হারু, মাহতাব, আশীষ আর হাদীকে শোনাচ্ছিলাম, তখন হারু বললো, তুই যে পি.আই.এ ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী এসেছিস, তার প্রমাণ স্বরূপ টিকিট দেখাতে হবে। হারুর কথা শুনে হাদী বললো একি বাণী সিনেমা হলের টিকিট ৮ আনা দাম। পি.আই.এ’র টিকিটের দাম ২২ টাকা। মাহতাব হাদীকে জিজ্ঞেস করলো তুই জানলি কি করে? হাদী বললো, আমাদের ৪ তলার মতলেব মোল্লা সাহেব দিন কয়েক আগে ঢাকা থেকে পি.আই.এ বিমানে চড়ে ঈশ্বরদী হয়ে বাড়িতে আসতেই বাড়ির গেটের সামনে আমার সাথে দেখা হতেই, আমি মোল্লা চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম ঢাকা দেখতে কেমন? তিনি বললেন, বড়ো হও, দেখতে সুন্দর, ঢাকা শহর, আর আমি প্লেনে চড়েই ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী এলাম। তখন আমি জিজ্ঞাস করলাম। চাচা প্লেনের টিকিটের দাম কত? মতলেব মোল্লা চাচা বললেন, ২২ টাকা একনাগাড়ে কথা শেষ করতেই, হারু পুনরায় বললো বিশ্বাস করলাম তোর কথা, তবে মাকিদকে টিকিট দেখাতে হবে আগামীকাল, যদি টিকিট দেখাতে পারে তবে ওর প্লেনে চড়ার গল্প শুনবো এবং শাজহানের দোকান থেকে তোদের সবাইকে চিনেবাদাম খাওয়াবো। পরের দিন সত্যিই হারু তার কথা রেখেছিলো, তবে অমার পি.আই.এর টিকিট দেখার পরে এবং আমার প্লেনে ছাড়ার গল্প শুনে শামসুল বললো মাত্র ৩০ মিঃ লাগলো ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী আসতে, সত্যি নাকি, বিস্ময় শামুর কিছুতেই কাটতে চায় না, বিস্ময় আমাদের সকলেই ভাঙ্গলো, টিফিন আওয়ারের ঘণ্টা যখনি জানিয়ে দিলো যার যার ক্লাসে সেই যাও। ১৯৬২ সালে ভারত এবং চীনের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিলো সেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কার কতটা হয়েছিলো সেটা উভয়পক্ষের নেতারাই জানেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ. এন. লাই এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু যতোটা না যুদ্ধের জয়-পরাজয় নিয়ে শংকিত হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি শংকিত হয়েছিলেন আমাদের হিন্দু বন্ধুদের পিতারা, কাকারা ও মামারা।
×