ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আলমগীর মাসুদ

কুসুম গরম কেরোসিন

প্রকাশিত: ১০:১৪, ১২ এপ্রিল ২০১৯

কুসুম গরম কেরোসিন

আপন ছোট মামার তিন শ’ টাকা চুরি করে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মামার মানিব্যাগটা তাঁতিদের পোড়াবাড়ির পুকুরে ফেলে দেয় রাহাত। বয়স অল্প হওয়ায় ফুলপ্যান্ট তখনও পরা শুরু করেনি সে। তাই বিশ্বব্যাংক ডাকাতি করে ডাকাতদলের দিব্যি পালিয়ে থাকার স্থান হলেও, মাত্র তিন শ’ টাকা চুরি করা রাহাত পালানোর জায়গাটা চিনতে পারেনি বলে মামার হাতে ধরা পড়ে যায় চুরির কয়েকঘণ্টা পর। আর ততক্ষণে পৌঁছে যায় রাহাতের এই চুরির খবর তার মায়ের গোষ্ঠীর সকল সদস্যের দরজায়। চোর ধরা পড়ছে। এই খুশিতে খলিফাবাড়িতে বেশ হৈচৈ। রাহাতের বড়মামি রেশমি পাগলী তো প্রায় নাচানাচি অবস্থায় সবার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলছে, কথা আমারটা একদম সত্য হয়েছে? বলছিলাম না, রাহাইত্যা চুরি করছে। রাহাইত্যার বাপ-মা, ভাইবোন সব চোর। চোরের বংশ। ওদের চুরির অভ্যাস আছে আমি জানি। রেশমি পাগলীর কথা কেউই আমলে নিত না, যদি রাহাত ধরা না পড়ত। তৃতীয় সন্তানটা জন্মের আগে কোন এক সন্ধ্যারাতে হুতুমপেঁচা ডাক দিলে রাহাতের এই মামি ভয় পেয়ে যায়। মুহূর্তে সে বেহুশ। বাড়িতে শ^শুরআব্বা ছাড়া কোন সাহসী পুরুষ নেই। বড় মেয়ে আর ছেলেটা ঘুমে। কি বাঁশের পাতা, কি তালগাছের শুকনো ডগা, দমদমার উপর ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ির শব্দ হলেই তো তারা দুই ভাইবোন গায়ের কাঁথাটি টানাটানি শুরু করে দেয়। নাক মাথা ঢেকে যে ঘুমায় পেশাব ধরলেও আর উঠে না সকাল পর্যন্ত। সাধে কি আর এলাকার মানুষ কয়, খলিফাবাড়ির সব সদস্য হয়েছে ভীতু...। পাড়াপ্রতিবেশী আর স্বজনরা রাহাতের মামির আচরণ দেখে সবাই পরামর্শ দেয়, তাকে গুনিন বৈদ্য দেখাতে। নাম ধরে দুজনে বলেও দিয়েছে নূরু হুজুরের কথা। শেপালির মা’র ছেলে, জব্বার মুন্সির প্রথম বউ, কালামের বোন নারগিস, পশ্চিম অলকার মাদকাসক্ত সেন্টুও তো এই নূরু হুজুরের তাবিজের কারণে আজ ভালা। শেপালির মায়ের ছেলে এখন ওমান থাকে। প্রতি মাসে দশ হাজার করে টাকা পাঠায়। বাড়িতে ব্লিডিং দিচ্ছে। মোবাইলে মা’কে মসজিদে শিরনি দিতেও বলে দিয়েছে ছেলে। মাঝে মাঝে নূরু হুজুরের কাছেও দোয়া চাইতে বলে। জব্বার মুন্সির বউটা এখন বেশ ভাল আছে। বড় হলেও, সতীনের কথায় উঠবস করে। কালামের বোন নার্গিসের তো গত বছরই বিয়ে হয়ে গেছে এক রং মিস্ত্রিপাত্রের সঙ্গে। আর সেন্টু তো এখন চিল্লার পর চিল্লা লাগায়। তাবলিগ ছাড়া তার মুখে কোন কথাই নেই। কখনও ৪০ দিন, কখনও চার মাসের চিল্লা শেষে বাড়িতে পা রাখলে, কি হিন্দু কি সাপুড়ে, সবাইকে সালাম দিতে দিতে পেটে খিদে লাগলেও সালাম যেন সেন্টুর মুখ থেকে পড়েই না মাটিতে। একদিন রাহাতের মামি রেশমি আক্তারকেও সালাম দিয়ে বসে পথে। ব্যস, হুলুস্থূল কা-। রেশমি আক্তারের যে মাথা ডিস্টার্ব সেন্টু তা জানে না। জানবে কেমন করে, সে তো আর তাবলিগটা এলাকায় বসে বসে পালন করে না। কখনও নাটোর। কখনও যশোর। কখনও চাঁদপুর। কখনও ফরিদপুর। নিজ এলাকা থেকে এত এত মাইল দূরে থাকলে সেন্টু কীভাবে জানবে, আজ রেশমি পাগল হয়েছে। কাল ওমুক চুরি করে ধরা খাইছে। তরশু তমুকের বউ আকামে লিপ্ত হয়েছে। রেশমির সামনে সেন্টু আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। রেশমির যা মনে আছে, সেন্টুর অতীতের সব কুকীর্তি গলা ফাটিয়ে বলা শুরু করে। সেন্টুও দু-একটা না বলে হাঁটে না। মাথা থেকে গোল টুপিটা হাতে নিয়ে তাবলিগের সুবচন ভুলে, রেশমিকে গালি দেয়া শুরু করে সেন্টুÑ খানকি মাগি। তুই কি কম ভালা। তুই-ই তো আমার সাদাসিধে ফেরেস্তার মতো জেঠিমাকে তাঁর নিজের বাড়িতে থাকতে দিলি না! তোর দু-লম্বরি চরিত্রের কথা কে না জানে। আর এখন পাগলী সাইজা গ্রামের মানুষের সামনে বেশ ধরছস চোদনামাগি। আমার জেঠিমার কসম, দেখবি আল্লাহ তোকে একদিন সত্যি সত্যিই পাগল বানিয়ে দেবে কইলাম। সেন্টুর কথা সত্য হোক কিংবা মিথ্যা, রাহাতের মামির চিকিৎসা কম হয়নি এই দুই বছরে। সব চিকিৎসা শেষে ঝারফুঁক দিতে দিতে একদিন গুনিনই বলে দেয়, রাহাতের মামি আগের মতো আর সুস্থ নেই। মাঝে মাঝে পাগলামু করবে গুনিন বাবু সেটাও বলে দিয়েছে বাড়ির সবাইকে। সে থেকে অবেহানদীর এলাকার মানুষ রাহাতের মামিকে রেশমি হাগলি বলেই চেনে এবং ডাকে। খুশি হয়েছে টুপি আর পাঞ্জাবি পরা রাহাতের দ্বিতীয় মামাটাও। রাহাতের এই মামাকে গ্রামের মানুষ হুজুর হিসেবে জানে এবং ডাকে। পরিচিত মাওলানা হিসেবেও। দেরি না করে-শাস্তি হিসেবে রাহাতকে তার দু-জন মামা একত্র হয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে খুব-খুব মারধর শুরু করে দেয়। বয়সটা ঠিক কয়বছর ছিল-মনে নেই তার। প্রায় বাচ্চা বাচ্চা ছিল বলে, অতিরিক্ত পিটুনি আর গোটাদিন দু-পায়ে ইট বেঁধে রাখায়-মুখে লালা চলে এসেছিল রাহাতের! ভাগ্যিস রাহাতের ছোটবোন রাশু তার নানার বাড়িতেই ছিল তখন। বোনের বারকয়েক চিৎকারে কে বা কারা রাহাতের হাত পায়ের রশি খুলে পুকুরে সাঁতার কাটতে বলে। বাবার মতো রাগী হওয়ায় সাঁতার না কেটে খালি গায়ে রাহাত চার কিলোমিটার পথ হেঁটে নিজ বাড়িতে আসতে বেশি সময় লাগেনি। আসার সময় পেছন ফিরে একবারও নানুর বাড়ির দিকে তাকায়নি সে! দীর্ঘ চার কিলোমিটারের পথে সঙ্গী ছিল দু-চোখের জল! সম্ভবত সেদিনই লাইফের সেরা কান্নার মালিক বনে গিয়েছিল রাহাত! মামাদের চেয়ে গরিব রাহাতের মা। দুই খালার চেয়ে একটু অগোছালো রাহাতের মা। আর নানা নানির কাছে তো রাহাতের মা একজন সহায়হীন হিসেবেই পরিচিত! রাহাতকে দরজায় ঢুকতে দেখে মা হাতথেকে কেরোসিনের বাতিটা মাটিতে রেখে বলে, কিরে বাপ-তোর মামা তোরে কিছু কইছে? বুঝ হওয়ার পর থেকে রাহাত তার মা’কে ভাল সংবাদ দেয়া ছাড়া দুঃসংবাদ কখনও ভুলেও শোনায়নি বলে, রাহাত আজও কিছু বলে না মা’কে। বলেনি আজকের এই ঘটনার কথাও। কারণ রাহাত জানে, তার মা জন্মের পর থেকে দুঃখ-কান্না, বেদনা আর কষ্টের মধ্যে জীবনকে পার করতে করতে আজ বৃদ্ধের কাতারে পা রেখেছে...! বাতিটা জ্বলছে। রাহাতের নীরবতা আর গোটাদিনের উপোসচেহারা দেখে ছেলের বামহাতের বাহু ধরে টান দিলে- দেখে যায় রাহাতের আহত শরীর! পৃথিবীরঘরে বাস করা গরিব মায়েদের প্রতিবাদের ভাষাটা সম্ভবত চোখের ফোঁটা ফোঁটা জলই হয়! তা না হলে কোথায় চেঁচিয়ে নানা-নানু-মামাদের বকবে- কিন্তু না, রাহাত দেখে উল্টোটা। তার মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে আওড়ায়, ছয় ছেলেমেয়ে আমার। জন্মের পর কখনও ভুলেও তাদের গায়ে একটা থাপ্পড় দেইনি। আর এই পাষাণরা কী করল আমার অবুঝ ছেলেকে! আঁচলে নাক-চোখ মুছতে মুছতে ছেলের আহত স্থানে মেখে দেয় সন্ধ্যা বাতির কুসুম গরম কেরোসিন। অনুষ্ঠান-দাওয়াত তো দূরের কথা, মাঝখানের এতটা বছর- অথচ একদিন, এক ঘণ্টা, এক মিনেটের জন্যও নানার বাড়ির কথা মনে আসেনি রাহাতের। হাতের আঙুলে গোনে ঠিক সময়টা আজ বের করলো সে- নানার মৃত্যু সংবাদে নানার জানাজার নামাজ পড়তে রাহাত নানার বাড়ি যায় প্রায় দশ বছর পর। অথচ তিন শ’ টাকা চুরি করার কারণে, রাহাতকে এত বছর লজ্জাটা দারুণভাবে কুরে কুরে খেয়েছে। ৪ এপ্রিল ২০১৯ [email protected]
×