ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবু সাইদ কামাল

দু’টি গল্প ॥ বসন্তের এক পসলা বৃষ্টি

প্রকাশিত: ১০:১৩, ১২ এপ্রিল ২০১৯

দু’টি গল্প ॥ বসন্তের এক পসলা বৃষ্টি

ঢাকার একটি সরকারী অফিসে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে অনন্ত বুঝতে পারে, সেই সবশেষ ব্যক্তি। যারা নিয়োগপত্র পেয়েছে, তাদের সবাই আগে যোগদান করে ফেলেছে। এ চাকরি সম্পর্কে অনন্ত বন্ধুবান্ধব কাউকে কিছু জানায়নি। লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল ক’মাস আগে। হল ভর্তি ছিল প্রার্থী। অনন্তের ধারণা মেধার ভিত্তিতেই চাকরিটা হয়েছে। নিয়োগ শাখায় যোগদানপত্র দাখিল করে নবনিযুক্ত যারা, তাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল অনন্ত। সাত-আটজন লোক এ পদে নিয়োগ পেয়েছে। তাদের মাঝে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। পরিচয়পর্বে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার পর মেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল অনন্ত। লতিকাদেহী একটি দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে, বেশ রুচিশীল। ব্যক্তিত্ব সম্পন্নও। সেই প্রথম অনন্তকে জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম! -অনন্ত। -পড়াশোনা কোথায় এবং কিসে করেছেন? -সরকারী আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহে। ইংলিশে। -আপনি তাহলে এখানে কেন? বেটার চান্সও তো নিতে পারতেন! -অন্যকিছু হলে চলে যাব। আপাতত কিছুদিন। আপনার নামটা প্লিজ! -মিসেস কাজী নাজনীন। -সাহেব কি করেন! -সাহেব ডাক্তার। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গেছেন। -আপনি কোন সাবজেক্টে...? -আমি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলায়। -তাহলে আপনিও তো আমার মতো সাময়িক। তবে এখানে আপনিও বেমানান। -অভিভাবকদের অমতে বিয়ে তো। তাই চাকরিটা দুঃসময়ের অবলম্বন মাত্র। নাজনীনের পাশে বসা মেয়েটিও ক্ষিণাঙ্গী। আকর্ষণীয় চেহারা। তবে শ্যামলা। তার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বয়সের তুলনায় বেশ গম্ভীর। সিলেটের মেয়ে। নিয়োগ শাখায় সবাই পরবর্তী পোস্টিংয়ের অপেক্ষায়। অনন্ত নাজনীনের মাঝে কথোপকথনের সময় অবনত মুখে বসে আছে মেয়েটি। ততক্ষণে গম্ভীর মুখ ছাপিয়ে মাত্র দুয়েকটি হাসির ঝিলিক দেখা গেল ঠোঁটে। অনন্ত বরাবরই চটপটে। আর তার এই চটপটে স্বভাববশেই গম্ভীর এই শ্যামলা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, আপনার নামটা প্লিজ...? -শিখা ঘোষ। -পড়াশোনা কোথায় এবং কোন সাবজেক্টে...? -ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে, মনোবিজ্ঞানে। মেয়েদের পরিণত বয়সে বিয়ে না হলে সবার মাঝেই একটা জিজ্ঞাসা থেকে যায়। অনন্তও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই আবার জিজ্ঞেস করে, সিঁথিতে সিঁদুর পরেননি বুঝি? -পরেছিলাম, মুছে ফেলেছি। শ্যামলা মেয়েটির কোমল কণ্ঠ থেকে কষ্টদায়ক একটি জবাব এমন সাবলীভাবে প্রকাশ পাবে তা ভাবতেই পারেনি অনন্ত। তাই উত্তরটা শুনে স্থির-নিশ্চুপ পাথরের মতো চুপসে যায়। আর কোন কথাই বলতে পারেনি অনন্ত। মুহূর্তে সে- অনুভূতি দিয়ে শিখা ঘোষের মনের গুমোট দুঃখগুলো বুঝে নিতে সচেষ্ট হয়। শিখার দেহাবয়বে ফুটন্ত গোলাপের ঐশ^র্য দেখে অনন্তের মনে হয়, বসন্ত আসার আগেই বুঝি সে ফাগুনের বিদায়ের কথা শুনছে। সহকর্মী কাজী নাজনীন তখন ওদের দু’জনের কথোপকথন শুনে বলে উঠে, বাহ! কত চমৎকার কথাবার্তা। অনন্তকে লক্ষ্য করে নাজনীন বলে, বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পারেন আপনি। জবাবে অনন্ত বলে, না তেমন কিছু না। উনাকে জানতে চেয়েছিলাম-এই আর কি! ততক্ষণে শিখা ঘোষের গুমোট বিষণ্ণতায় অনন্তও কিছুটা আক্রান্ত হয়। দু’তিন দিনের মাঝে একই ফ্লোরের বিভিন্ন শাখায় তাদের পোস্টিং হয়ে যায়। কাজী নাজনীনের চেহারা যেমন কমনীয়, তেমনই আকর্ষণীয় তার হাতের লেখা। কদিনের মাঝেই নাজনীন নিয়োগকর্তার নজরে পড়ে। শাখা কর্মকর্তা একদিন তাকে ডেকে বলে, কাজী নাজনীন! আপনার হাতের লেখার প্রশংসা করেছেন স্বয়ং পরিচালক সাহেব। -তাই নাকি! -হ্যাঁ। -তাহলে আমার পক্ষ থেকে উনাকে ধন্যবাদ। -স্যার আপনাকে একদিন দেখা করতে বলেছেন। -কোন জরুরী প্রয়োজন? -না। এমনি। সৌজন্য সাক্ষাৎ আর কি। -ও আচ্ছা। নাজনীন ভাবে, হয়তো বা হাতের লেখাটা একটু ভালো বলেই পরিচালক সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। অনন্ত ও শিখা পাশাপাশি কক্ষে বসে। অনন্তের টেবিলের পাশে বসের টেবিলে দুটি টেলিফোন সেট। একটি পিবিএক্স বা অফিস-অভ্যন্তরের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে যোগাযোগের টেলিফোন। অন্যটি বাইরের জন্য। শিখা প্রায়ই টেলিফোন করার জন্য পাশের কক্ষ থেকে অনন্তের কক্ষে আসে। তার পাশে বসেই প্রয়োজনীয় স্থানে কথা বলে। শিখার শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে যায় অনন্তের বাহু। অনন্ত নারীদের এত কাছাকাছি কখনো আসেনি। তাই শিখার শাড়ির আঁচলের ছোঁয়ায় তার দেহের ¯œায়ুর আকাশে হালকা বিদ্যুত চমকায়। দাঁড়িয়ে টেলিফোনে কথা বলা শেষ করে শিখা অনন্তের পাশের চেয়ারে বসে। কথা হয় অনেকক্ষণ। এভাবে পাশাপাশি বসলে অনন্তের শরীর আর মনে রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। শিখারও এমন হয় কিনা অনন্ত জানে না। তাই শিখাকে জানতে চায় অনন্ত। জানতে চায় শিখার অকাল ট্রাজিক জীবনের গূঢ় কথামালা। অফিসের কাজের ফাঁকে অনন্তও কখনো গিয়ে শিখার পাশের চেয়ারে বসে। উভয়ের কথা হয় অনেকক্ষণ। কাজের ব্যস্ততায় দুপুর গড়ায়। কেউ যায় নামাজে, কেউ যায় লাঞ্চে। কেউ বা টিফিন বক্সে করে আনা খাবার আড়ালে আবডালে খেয়ে নেয়। এ অবসরে পাশাপাশি বসে থাকে শিখা ও অনন্ত। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে অপেক্ষার পর যখন দেখে অনন্তের নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই, তখন শিখাও আলমারি থেকে বের করে আনে টিফিন বক্স। এবার উঠে অনন্ত। সেও কেন্টিনে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেয়। এভাবেই চলতে থাকে তাদের প্রাত্যহিক অফিস-জীবন। সেদিন নাজনীন অফিসে আসেনি। তবে শিখা এসেছে। অনন্ত অফিসে এসেই একটা জরুরী ফাইলের কাজ নিয়ে বসেছে। ক্রিং ক্রিং, হঠাৎ একটা টেলিফোন। অনন্ত রিসিভার তুলে। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে বলে, স্লামালেকুম! -ওয়ালাইকুম সালাম। -আমি কাজী নাজনীন বলছি। -কোত্থেকে বলছেন! -রোকেয়া হল থেকে। -অফিসে আসলেন না যে? -আর আসব না অফিসে। -আসবেন না মানে? -এ চাকরিটা আর করব না বলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। বাকি সব শিখার কাছে জানতে পারবেন। আমার বিশ^াস, এ চাকরিতে আপনিও বেশিদিন থাকবেন না। যাকগে, শিখাকে একটু ডেকে দেবেন প্লিজ! -লাইনে থাকুন, ডেকে দিচ্ছি। এই বলে অনন্ত পাশের কক্ষে শিখাকে ডাকতে যায়। কথা শেষ হলে শিখা রিসিভার রাখে। অমনি অনন্ত বলে, কী ব্যাপার! নাজনীন নাকি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে বলল। -হ্যাঁ। -কেন? -এমনিতেই তো নাজনীনের এ চাকরি পছন্দের না। তার উপর কেউ ডিসটার্ব করলে কী করবে? -ডিসটার্ব মানে! -লাঞ্চের সময় আসবেন, সব খুলে বলব। এই বলে শিখা চলে যায়। অনন্ত তো এ-ই চায়। সে চায় শিখার কাছে যেতে, পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ কথা বলতে। অনন্তের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর লাঞ্চের সময় আসে। তখন অফিসের কেউ নামাজে, কেউ বা লাঞ্চে চলে গেছে। অনেকটা নিরিবিলি পাশাপাশি বসে আছে অনন্ত ও শিখা। অনন্তই কথাটা তুলে। বলে, এখন বলুন নাজনীনের পদত্যাগপত্র পাঠানোর নেপথ্য কাহিনী। জবাবে শিখা বলে, দীর্ঘ কোন গল্প নয়। অল্প কথাতেই বলা যায়। আমাদের ডিরেক্টর এডমিন, নাজনীনকে তার চেম্বারে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যাবার জন্য প্রায়ই আমাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ অফিসারকে দিয়ে সালাম পাঠাতেন। -নাজনীন কি সাক্ষাৎকার দিয়েছে...? -কেন দেবে! একজন তন্বী-তরুণী, তবু অঘোষিত কর্মচারী; অফিসের জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেন একজন বড় অফিসারের কক্ষে যাবে? তাঁর কাছে যাবেন অফিসারগণ এবং তাঁর সরাসরি অধঃস্তন কর্মচারী যারা। ভিন্ন শাখার কর্র্মচারী হয়ে নাজনীন যাবে কেনো? তাতে কি ভিন্ন অর্থ বা তাৎপর্য বহন করে না! নাজনীন এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে অন্যরকম বুঝেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। -বলেন কি! এ পর্যায়ের পদধারী একজন মানুষও কি এত জঘন্য হতে পারে? -ভালোই করেছে নাজনীন। তার যে যোগ্যতা, এ শহরে অনায়াসে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিতে পারবে। কিন্তু মেয়েদের তো অনেক সমস্যা। এবার একটু রসিকতা করে অনন্ত বলে, কে জানে ডিরেক্টরের এ ধরনের সালাম আবার অন্য কোথাও এসে ঠেকে কিনা! জবাবে মুচকি হেসে শিখা বলে, একেবারে বারোটা বাজিয়ে দেব। পত্রিকায় তুলে দেব। তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়। ক্ষুধার দহনে শিখা প্রতিদিনের মতো আলমারি থেকে টিফিন বক্স বের করে আনে। অনন্ত তখন ওঠার উদ্যোগ নেয়। শিখা বাধা দিয়ে বলে, বসুন না! চলুন, আজ না হয় এক সঙ্গে নাস্তা করি। -আপনার একার জন্য এনেছেন তো। ওখানে ভাগ বসালে উদর বিদ্রোহ করবে না! -না-না। নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি। -ঠিক আছে, অন্যদিন একসঙ্গে খাব না হয়। -না। আজই। বসুন। বাড়া খাবার রেখে যেতে নেই। অনেকটা ইতস্তত করে বসে অনন্ত। ঐ কক্ষে তখন আর কেউ নেই। দু’জনে ভাগ করে খায় দুপুরের নাস্তা। যেনো বেশ তৃপ্তি পায়। একজন অবিবাহিত পুরুষ। আর একজন স্বামী পরিত্যক্তা নারী। অনুকূল পরিবেশে নিকট-সান্নিধ্য একটা নির্দিষ্ট বয়সের মানুষকে হৃদয়ের কাছাকাছি টানে। এ দুটি মানব-মানবীও ধীরে ধীরে নিজেদের অজান্তেই পরস্পরের আকর্ষণে এক বিন্দুমুখী এগোচ্ছে যেন। ওদিকে দুপুরের পর বৈকালিক অফিস জমতে শুরু করেছে। অনন্ত এবার উঠে নিজের কক্ষে যায়। শিখাও নিজের কাজে মন দেয়। অফিস শেষ হবার আধঘণ্টা আগেই অনন্ত সেদিনের মতো তার দাপ্তরিক কাজ গুছিয়ে নেয়। অতঃপর চটপটে স্বভাব বশে পাশের কক্ষে আসে। শিখার টেবিলটা সামনে থেকে দু’হাতে ধরে রসিকতা করে নিচু স্বরে বলে, আমার যাবার সময় হলো...। অনন্তের মাঝে যেনো কবি কবি একটা ভাব। তাই ছন্দে আন্দোলিত কথা বলতে চায় সে। তার ওপর রমণীয় পরিবেশ হলে তো ছন্দ যেন উছলে উঠতে চায়। শিখার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অনন্তের মনোজগত এমনিতেই উৎফুল্ল। তাই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সেই কথাগুলো বলেই অনন্ত তার আসনে গিয়ে বসে। শিখাও তারচেয়ে কম যায় না। সেও তার অফিসের কাজগুলো পনের মিনিটের মাঝে গুছিয়ে নেয়। অতঃপর পার্সটা কাঁধে নিয়ে প্রস্ফুটিত ফুলের মতো একটা রসিকতাপূর্ণ হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে অনন্তের কক্ষে ঢুকে। তারপর চপল এক পাখির মতই শিখা অনন্তকে লক্ষ্য করে সেই গানের পঙক্তির অসমাপ্ত কথার জবাবে ছন্দায়িত কল্লোল তুলে বলে... দাও বিদায়। তারপর ত্বরিত গতিতে শিখা চলে যায়। অনন্ত হতভম্ব। সে ভাবে, এ তো যেনতেন শিখা নয়। এ শিখা যেনো অনন্তের ভেতরে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সযতেœ রক্ষিত যতুগৃহের সন্ধান করে সেই প্রকোষ্ঠেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সামনের দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি। এ দু’দিন শিখার সঙ্গে অনন্তের দেখা হবার কথা না। অনন্ত খোলার দিনের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে। এভাবে ক’দিনের মাঝেই অনন্ত শিখার আরও কাছাকাছি আসে। বলতে গেলে একেবারে শিখার মনের আঙিনায় পা রাখে। আর তখনই গল্পচ্ছলে সে জেনে নেয় অকালে শিখার সিঁদুর মুছে যাওয়ার করুণ কাহিনী। যদিও এ ব্যাপারে আরও আগেই জানার আগ্রহ ছিল। কিন্তু সে চায়নি প্রসঙ্গটি তুলে শিখার মনে কষ্ট দিতে। শিখা এ বিষয়ে যা জানায়, তার সারমর্ম হল এই, শিখার বিয়ের আগেই স্বামীর সঙ্গে অন্য একটি মেয়ের জানাশোনা ছিল। বেশ গোপনে বিয়ে করেছে এমন একটি মেয়েকে, যাকে তার বাবা-মা কোনদিন মেনে নিবে না। আর তাই মা-বাবাকে খুশি করার জন্যই শেষে শিখাকে বিয়ে করে লোকটি। শিখা যখন বিষয়টা জানতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ, ততদিনে সে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তারপরও বিষয়টা নিশ্চিত জানতে পেরে শিখা কোনভাবেই তা মেনে নিতে পারেনি। গর্ভাবস্থায়ই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। মুছে ফেলে বহুলাকাক্সিক্ষত সিঁথির সিঁদুর। এখন তার কন্যা সন্তানটির বয়স চার বছর। সেদিন শীতের দুপুর। প্রতিদিনের মতই তখন অফিস প্রায় ফাঁকা। পাশাপাশি বসে আছে অনন্ত আর শিখা। শিখা তখন বেশ দুঃখ করে বলে, জানেন! আমাদের মতো স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে- সমাজে বড়ই হতভাগিনী। বলতে গেলে সমাজের অপাঙক্তেয় মানুষ। - কেনো! -কিছু কিছু স্খলিত চরিত্রের লোক আমাদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। -যেমন! -এই ধরুন না, এই অফিসের রঞ্জিত। আমার ওপর তার কুনজর। বলে কিনা, আমাকে বিয়ে করবে। আমাকে নাকি তার খুব ভালো লাগে। -ভালো কথা। -কী বললেন, ভালো কথা? একজন বিবাহিত লোক, যার ঘর ভর্তি সন্তান-সন্তুতি। সে কি করে এমন ভাবতে সাহস পায়, বলতে পারেন? -জবাবে আপনি কী বললেন? -বললাম, যদি আমাকে আপনার এতই ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমার অনুরোধ; আপনার স্ত্রীকে আরও অধিক ভালোবাসুন। তার সর্বনাশের চিন্তা করবেন না দয়া করে। -তারপর! -আর কোনো কথা বলল না সেই বাবু। একদম চুপসে গেলো লোকটা। -দুর্মুখদের স্তব্ধ করতে ভালোই তো জানেন দেখছি। তা আরও কাউকে কি এমন স্তব্ধ করে দেবার পরিকল্পনা আছে? -যাহ্! বলেছি নাকি? আর সবাই তো তার মতো ভ্রষ্ট চরিত্রের লোক না। শিখা তখন টেবিলের দিকে নুয়ে কথা বলছিল আর একটা আলপিন দিয়ে অনাবশ্যক গুঁতোগুঁতি করছিল। এক পর্যায়ে হঠাৎ পিনের আঁচড় লেগে শিখার আঙ্গুলের ডগা থেকে সামান্য রক্তকণা বের হয়। অমনি সে অনুচ্চ স্বরে আর্তনাদ করে বলে, উহ্, মরে গেছি রে! -কী হয়েছে? -দেখছেন না পিনটা আঙ্গুলে বিঁধে গেছে। (চলবে)
×