ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

ইতিহাসের আলোয় বাংলা কোচবিহার

প্রকাশিত: ১০:১২, ১২ এপ্রিল ২০১৯

ইতিহাসের আলোয় বাংলা কোচবিহার

মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার রচিত ‘বাংলা-কোচবিহার সামরিক ইতিহাস (১২০৪-১৫৭৬) বের হয় ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলায়’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর বই প্রকাশের যে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় আলোচ্য গ্রন্থটি তেমন কাক্সিক্ষত স্বপ্নের দিকনির্দেশনা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু সালেহ সেকেন্দার বইটিতে মধ্যযুগের সূচনাকাল থেকে বাংলা ও কোচবিহারের সামরিক অভিযাত্রার যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন তা যেমন ঐতিহাসিক একইভাবে সমকালীন ব্যবস্থারও অনন্য সামাজিক দলিল। প্রন্থটি প্রকাশ করেছে জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মশিউর রহমান। বাবা-মাকে উৎসর্গ করা বইটি মূলত। গ্রন্থকার শিক্ষকতা জীবনের এক অনিবার্য বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়বদ্ধতা থেকেই লিখেছেন। ভূমিকায় সে কথা বলতে গিয়ে লেখক এমন সমৃদ্ধ গ্রন্থের পূর্ব ধারণার ওপরও আলোকপাত করতে ভোলেননি। সময়ের গতিপ্রবাহে আধুনিকতা ও নতুনত্বকে যেভাবে স্বাগত জানাতে হয় সঙ্গে ঐতিহ্যিক বলয়কেও শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরী। ঐতিহাসিক ঘটনাকে নতুন সময়ের অনুষঙ্গ করে আরও উপযোগী করে তোলা যথার্থ শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়বদ্ধতায় শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের প্রয়োজনীয় পর্বে এই গ্রন্থটির পটভূমি তৈরি হয়। পাঠক্রমের আওতায় আনতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা বিষয়বস্তুর পরিধি শুধু সমৃদ্ধই হয়নি বরং বইটির কলেবর ও পাঠকনন্দিত হয়েছে। গ্রন্থটির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০৪ থেকে ১৫৭৬। স্মরণ করা যেতে পারে ১২০৪-এ ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি সেন বংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় মুসলিম আধিপত্যের ভিত্তি তৈরি করেন। শুধু তাই নয় ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট আকবরের বাংলা অধিকার পর্বটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাংলার সঙ্গে কোচবিহারের সামরিক অভিযানকে নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। এটি এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ যা বাংলার সমাজ, ঐতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক বলয়ই শুধু নয় রাজা-বাদশাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের সম্পর্ক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে উঠে এসেছে। তুর্কী যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিলাষে যখন বাংলাদেশের নদীয়াকে নিজের আয়ত্তে আনলেন সে সময় বাংলার অন্যত্র লক্ষণ সেনের আধিপত্যে শাসিত হচ্ছিল। কিন্তু বখতিয়ার খিলজির বিজয় অভিযান যখন আরও অগ্রসরমান সে সময় লক্ষণ সেন পালিয়ে বিক্রমপুরে চলে যান বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। সেই চরম সত্যকে মনন চেতনায় ধারণ করে এই প্রাজ্ঞ শিক্ষক উল্লেখ করেন ১২০৫ সালে নতুন এই মুসলিম অধিপতি লখনৌতি অধিকার করেন। সে সময় থেকেই বখতিয়ার খিলজির শাসনের এক অন্যতম যাত্রা কোচবিহারের সঙ্গে সামরিক অভিগমনের অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য। যা এই লেখক বিভিন্ন ইতিহাস নির্ভর আলোচনা থেকে সংগ্রহ করেছেন। সেখানে লেখক বিস্মিত হন এক সময় বখতিয়ার খিলজির সঙ্গে কামরূপের রাজার পৃথুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কেন সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়েছিল, শুধু তাই নয় পরাক্রমশীল সেনানি বখতিয়ার খিলজিও বা কেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজ পৃথুর কাছে পরাজিত হলেন? এর মধ্যে কোন অজ্ঞাত সামরিক ষড়যন্ত্র লুক্কায়িত ছিল কি না তার কোন ইতিহাস আজ অবধি কেউ জানে না। এভাবে লেখক কালের অপ্রতিহত গতিতে মুসলিম রাজবংশের আধিপত্যে বিভিন্ন সময় কোচবিহারে যে সামরিক অভিযান তারই একটি সুসংবদ্ধ ঐতিহাসিক চিত্র পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তুলে ধরেছেন। এসব আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় কখনও মুসলিম রাজাধিরাজরা সামরিক অভিযানে সফলকাম হলেও অনেক সময় কোচবিহারের কামরূপের অধিপতিরা সে সংঘর্ষকে মোকাবেলা করতে সমর্থও হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায় হাবশী সুলতানের শাসনামলে নতুন করে কোচবিহারে সামরিক অভিযানকে অন্য মাত্রায় বিধৃত করে শেরপুরসহ ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চল অধিকার করা হয় বলে উল্লেখ করেন। সে সময় কোচ রাজা ধর্ম নারায়ণের বাংলায় অভিযান চালানোর ঘটনাও উঠে আসে। পরবর্তীতে হোসেন শাহী সুলতানদের সঙ্গে কোচবিহারের শাসকদের সামরিক সংঘর্ষকে উল্লেখযোগ্য বিবেচনায় এনে এর ব্যাপকতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। বইটি অত্যন্ত মূল্যবান মধ্যযুগের বাংলা ও কোচবিহারে সামরিক অভিযাত্রার আলোকে। পাঠ্যক্রমের আওতায় থাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। গ্রন্থটির বহু প্রচার কামনা করছি।
×