ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্কিম চন্দ্র, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি রেনেসাঁ

প্রকাশিত: ১০:১১, ১২ এপ্রিল ২০১৯

বঙ্কিম চন্দ্র, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি রেনেসাঁ

উনিশ শতকীয় রেনেসাঁস তথা বাংলার নব জাগরণের সুবর্ণ সময়ে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। জন্মসূত্রেই কবি পান সমৃদ্ধ বাঙালী সমাজ, ইউরোপীয় সংস্কৃতির অবাধ বিস্তার সর্বোপরি বংশানুক্রমিকভাবে অর্পিত ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য আর পর্বতপ্রমাণ সাংস্কৃতিক বলয়। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের একচেটিয়া দাবিদার না হলেও ঠাকুরবাড়ির যুগান্তকারী ভূমিকা সমকালীন অঙ্গনের এক পরিশুদ্ধ আবহ। কট্টর ব্রাহ্মণ্য সমাজচ্যুত পীরালি ব্রাহ্মণ পরিবারের উত্তরসূরি দ্বারকানাথ ঠাকুর শুধু বিত্ত-বৈভবে নয়, আধুনিক বাংলার নব্য শিল্পোদ্যোক্তাদেরও উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন। তাই নতুন ভাব পরিসরে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথের সৃজন ও মনন দ্যোতনায় সময়ের প্রতিনিধিদের প্রভাব পড়া ছিল এক অনিবার্য জীবন প্রবাহ। ঠাকুরবাড়ির প্রাণপুুরুষ আধুনিক দ্বারকানাথ রবীন্দ্রনাথকে কতখানি বিমুগ্ধ করেছিলেন তার কোন স্পষ্ট অভিব্যক্তি কবির মধ্যে সেভাবে আলোড়িত হয়নি। বরং জীবনিকার প্রভাত কুমার কবির পর্বতপ্রমাণ প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পিতামহ দ্বারকানাথকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করলে রবীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। তাঁর মতে ‘পিতামহের সাথে তার দূরত্ব শুধু সময়ের দিক থেকে নয়, গ্রুণের বিচারেও। তবে প্রভাত কুমার কবির এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, বস্তুচারী ঐতিহাসিকদের নিকট কবির বহুমুখী প্রতিভার অভিব্যক্তির জন্য তাঁহার পূর্বপুরুষের দোষ ও গুণ সমানভাবে দায়ী।’ পিতামহ দ্বারকানাথ সম্পর্কে কবির এই নীরবতা বিজ্ঞজনদেরও ভাবিতে করে। সনৎকুমার সাহার মতে, ‘কবি ইতিহাসে পা রেখেছেন আবার ইতিহাসকে তিনি অস্বীকারও করেছেন। দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথের জীবন একই ধারায় প্রবাহিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছেন দেবেন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে, পেছনে দ্বারকানাথের ছায়া শূন্যে মিলিয়েছে। তিনি ফিরে তাকাননি।’ বোঝাই যায় কবি পিতামহকে পাশ কাটিয়েছেন। ভাল-মন্দ কোনটাই বলেননি। তার পরেও ধারণা করতে অসুবিধা নেই আধুনিক সৃষ্টিশীলতা, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি বিশেষ অনুরাগ, প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের মেলবন্ধন, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মানবতাবাদ পিতামহের এসব গুণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে উজ্জ্বলভাবে উদ্ভাবিত হতে দেখা যায়। তবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনব্যাপী কবির সামগ্রিক মননে, দর্শনে, সৃজনশীলতায় এবং আচার অনুষ্ঠানে এক অচলায়তন দেবমূর্তি। যাকে তিনি কখনও ভেদ করতে পারেননি অথবা চানইনি। ‘জীবন স্মৃতি’তে এর মুগ্ধতা আছে। অনেক স্মৃতিচারণে পরম আবিষ্টতাও লক্ষণীয়। সর্বোপরি সশ্রদ্ধ চিত্তে পিতার প্রতি অনমনীয় ভক্তির প্রমাণ আছে। মহর্ষি তার এইা কনিষ্ঠতম পুত্রটির সামগ্রিক ব্যক্তিত্বে পর্বতপ্রমাণ উপস্থিতি নিয়ে সর্বদাই বিরাজ করতেন। নিরাকার ব্রহ্মের একনিষ্ঠ সাধক, পূজারী, ভক্ত পিতা মহর্ষি জীবনভর পুত্রের কাছে নমস্য ছিলেন। বিষয় বিমুখ, বিত্ত-বৈভবের প্রতি নিরাসক্ত, আধ্যাত্মচেতনায় নিবেদিত প্রাণ পিতা কবির কাছে এক অভিনব, দুর্লঙ্ঘ্য, তেজোদীপ্ত দেবতা পুরুষের মর্যাদায় আসীন ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির দুই বিদগ্ধ পুরুষ দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ ছাড়াও সমকালীন উনিশ শতকীয় সমাজ ছিল জ্ঞানী, গুণী আর বিজ্ঞজনদের মহাসম্মিলন। যাঁরা কবির সচেতন মনন আর সৃষ্টিশীল নান্দনিকতায় দীর্ঘস্থায়ী আবেদন রাখতে প্রভাবকের ভূমিকায় দ্যুতি ছড়ায়। তাঁরা হলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উনিশ শতকের নব নিগন্তের যথার্থ নায়কের ভূমিকায় যিনি নামেন তিনি রাজা রামমোহন রায়। আধুনিক এই প্রাণপুরুষ সমকালীন অঙ্গনের অনেক অভিশাপকে পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর যে বার্তা সর্বসমক্ষে হাজির করলেন সেই রামমোহন কবির কাছে ছিলেন ভারত পথিক এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বেদ উপনিষদের প্রথম বাংলা অনুবাদকই নন নতুন ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন সমকালীন সময়ের ¯্রােতকে যে নতুন চেতনায় প্রবাহিত করেছিলেন তাতে কবি রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস আর আবিষ্টতা ছিল এক আরাধ্য দেবতার প্রতি পরম নিবেদন। পুরো ঠাকুর পরিবার ছিল রামমোহন কর্তৃক প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। পৌত্তলিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিরাকার ব্রহ্মের যে ধারণা ব্যক্ত করলেন বেদ-উপনিষদ থেকে তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামমোহন রায়ের নতুন ধর্মীয় দর্শন দেবেন্দ্রনাথকে যেভাবে অবিভূত করে সে প্রবাহেই তিনি পৌত্তলিকতার শুদ্ধ আচার-নিষ্ঠতাকে পরিহার করতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, অপৌত্তলিকভাবে পিতা দ্বারকানাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেমন করে সম্পাদন করেছিলেন তাও সমকালীন ধর্মীয় বলয়ের এক আলোড়নকারী নতুন আচার নিষ্ঠতা। তৎকালীন বিজ্ঞ সমাজের মতে এটা শুধু মহর্ষির ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ছিল না এমন দুঃসাহস ছিল একেবারে সামাজিক বিপ্লব। আর পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেন আধুনিক সময়ের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায়ের একনিষ্ঠ অনুগামী। ‘চারিত্র পূজা’ প্রবন্ধে কবি তিনজন বিখ্যাত মনীষীকে যে অর্ঘ্য নিবেদন করেন তন্মধ্যে রাজা রামমোহন রায় বিশিষ্টতম। নবযুগের এই বলিষ্ঠ অগ্রনায়ক রাজা রামমোহনের প্রতি কবির উচ্ছ্বাস, মুগ্ধতা, ভক্তি, ভালবাসার যে অফুরন্ত প্রকাশ তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না এই সময়ের দৃঢ়পথিক কিভাবে তাকে অনুপ্রাণিত করেন। বাংলার নিজস্ব কৃষ্টি আর ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে বাঙালী সমাজকে নতুন পথের সন্ধান দেয়ার এই বলিষ্ঠ পথিকৃৎকে কবি মনে করতেন আবহমান বঙ্গসমাজের এক চিরায়ত প্রতিনিধি। যিনি আধুনিক সময়ের গতি প্রবাহে সমৃদ্ধ বাঙালিত্বকে এক অপূর্ব মেল বন্ধনে বেঁধে দিয়ে নতুন করে গোড়াপত্তন করলেন। যার বাঙালিয়ানার সঙ্গে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে যায় আধুনিকতার নবযাত্রা পথ। ‘চারিত্রপূজা’ প্রবন্ধে রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত কবিÑ ‘বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রাজা রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি। তিনি আমাদের জন্য যে কত করিয়াছেন, কত করিতে পারিয়াছেন তাহা ভাল করিয়া আলোচনা করিয়া তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও স্বজাতির প্রতি বিশ্বাস জন্মিবে। আমাদিগকে কেহ যদি বাঙালী বলিয়া অবহেলা করেন, আমরা বলিব রামমোহন রায় বাঙালী ছিলেন।’ শুধু বাঙালী বলে নয় পাশ্চাত্য সভ্যতার ভাব সম্পদকে এদেশে উপযোগী করার উদ্যোগকেও রামমোহনের অপরূপ কীর্তি বলে কবি মনে করতেন। ‘জাপান যাত্রী’ প্রবন্ধে বলেন নবযুগের প্রথম প্রবক্তা রাজা রামমোহন রায়। তিনি যে পশ্চিমকে দেখতে পেয়েছেন তা শাস্ত্রধারী পশ্চিম নয়, বাণিজ্যজীবী পশ্চিম নয়, জ্ঞানে প্রাণে উদ্ভাসিত পশ্চিম। শুধু তাই নয় অজ্ঞানতার অন্ধকারে আড়ালে থাকা নারী জাতির আলোকবর্তিকা নিয়েও হাজির হন রাজা রামমোহন। শুধু নারী শিক্ষায় নয়, স্ত্রীজাতির যাবতীয় গুণাবলী স্বীকার করে তাদের যথাযথ মর্যাদায় আসীন করার তাগিদও অনুভব করেছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবক্তা এই নতুন আলোর দিশারি। এই কথা অনস্বীকার্য যে নবজাগরণের নতুন সময়ে স্ত্রী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল ব্রাহ্ম বালিকাদের বিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে। যার অনেক কৃতিত্ব বর্তায় এইা সমৃদ্ধ সময়ের আধুনিক পুরুষ রাজা রামমোহনের ওপর। কারণ পুরো বঙ্গীয় রেনেসাঁস যাদের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে তারাই সমাজের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে নারীকে নতুন সূর্যের আলো দেখাতে তৎপর হন। রবীন্দ্রনাথের ওপর এই ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ‘বঙ্গদর্শনের’ তাগিদে নৌকাডুবি উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে কবি এই কাহিনীর ঘটনার বাতাবরণে যেভাবে ব্রাহ্ম ধর্মের সক্রিয় উপস্থিতিকে দৃশ্যমান করে তোলেন তা রবীন্দ্র গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও আলোচকদের দৃষ্টি নিবন্ধ করে। বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক সৈয়দ আকরাম হোসেনের মতে ‘নৌকাডুবি’ই প্রথম উপন্যাস যেখানে কবি প্রথমবারের মতো ব্রাহ্ম ধর্মকে বিশেষ বার্তায় পাঠকদের উপহার দেন। আর বিস্ময়করভাবে সেটা আধুনিক শিক্ষায় পারদর্শী হেমনলিনীর চারিত্রীক বলিষ্ঠতায়। ব্রাহ্ম পিতার সন্তান হেমনলিনী শুধু নতুন শিক্ষাকে গ্রহণ করাই নয় নবসংস্কৃতির এক অনমনীয় ধারকও। উপন্যাসটিতে কড়া হিন্দুত্ববাদ এবং উদার মানবিক ব্রাহ্ম ধর্মের যৌক্তিক নিয়মনিষ্ঠতা পাশাপাশি বিরাজ করে। তখন সমাজের মধ্যে ধর্মীয় আবহের এক দ্বৈত পালাক্রম। কমলা আর রমেশ গোঁড়া হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি আর হেমনলিনী ব্রাহ্ম সমাজের নবদ্যুতির কিরণছটা। হিন্দুত্ব এবং নিরাকার ব্রহ্মের দ্বৈত অবস্থায় সমকালীন আঙিনায় যে বিচিত্র আবহ সেটাই এই উপন্যাসের মূল সারবত্তা। পরবর্তীতে কবির সবচাইতে বলিষ্ঠ উপন্যাস ‘গোরা’তেও এই নব্য ব্রাহ্ম সংস্কৃতির এক অভাবনীয় বলয় যেখানে নায়িকা সুচরিতা নতুন আলোয় উদ্ভাসিত, নবদিগন্তের পথিকৃৎ। এখানেও সনাতন হিন্দু ধর্মের সঙ্গে উদারনৈতিক আধুনিক ব্রাহ্ম ধর্মের এক অপূর্ব যোগসাজশ যা কবির সৃজন দ্যোতনায় নানামাত্রিকে প্রভাবিত করে। এখানে লক্ষণীয় ‘নৌকাডুবি’ ও ‘গোরা’র দুই শিক্ষিত রমণী ব্রাহ্ম পরিবারের আদর্শিক চেতনায় সমৃদ্ধ। যা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক আবশ্যকীয় গতিপ্রবাহ। যা রাবিন্দ্রীক চৈতন্যকে বিভিন্নভাবে আন্দোলিত করে ধর্মীয় বোধ আর সংস্কৃতিকে লালন করাই শুধু নয়, মনন আর সৃজন শৌর্যে অনবদ্য করে তোলাও সময়ের বলিষ্ঠ প্রত্যয়। নতুন আলোর আর এক সাহসী যোদ্ধা বিদ্যাসাগর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সত্যিকারের পথদ্রষ্টা। সাহিত্যের আঙিনায়, সমাজ-সংস্কারের পরিসীমায় কর্মোদ্যোগের নির্ভীক সহযোদ্ধার ভূমিকায় বিদ্যাসাগর ছিলেন কবির পরম পূজনীয়, শ্রদ্ধার্হ এবং অত্যন্ত কাছের মানুষ। ‘চারিত্রপূজা’ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের চারিত্রীক মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে কবি এই আধুনিক মানুষটির পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ সম্পর্কে বলেন, এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁহার পৌত্রকে আর কোন সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয় সম্পদের উত্তরাধিকারী বণ্টন একমাত্র ভগবানের হস্তে, সেই চরিত্র মাহাত্ম্য অখ-ভাবে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়াছেন।’ পিতামহের দৃঢ়চিত্তের এই উত্তরাধিকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চারিত্রীক শৌর্যও ছিল পর্বত প্রমাণ। শুধু তাই নয় বঙ্গীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যথার্থ ধারক উনিশ শতকের এই প্রাণপুরুষ যেভাবে মাতৃভাষাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন সেটাও বাংলা সাহিত্যের এক অকৃত্রিম সম্পদ। কঠিন, জটিল ও দুর্বোধ্য বাংলা ভাষায় ছন্দময় গতি, শৈল্পিক বোধ, সরলতা এবং সহজবোধ্যতা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অভূতপূর্ব কীর্তি আজও বাঙালী সমাজকে যথার্থ পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা কোনভাবেই কট্টর আর কঠিনতার আবর্তে ঢেকে যেতে পারে না। সেই অনধিগম্য কাঠিন্য থেকে বের হয়ে বাংলাভাষা সাধারণ এবং নান্দনিকতায় রূপ নেয় বিদ্যাসাগরের অনমনীয় জ্ঞান শৌর্যে। যে জ্ঞান চর্চার নিরবচ্ছিন্ন গতি বাংলাভাষাকে এক পরিশীলিত, সহজগামিতা এবং স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যতায় সাধারণ পাঠককে নিবিষ্ট করতে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। বিদ্যাসাগর পূর্ব বাংলা ভাষা ছিল জটিল আর কঠিনতার দুর্গম পথের অধীন। পাঠক সমাজ নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে যাকে আয়ত্তে আনতে হিমশিম খেত। সেই দুর্বোধ্যতা বিদ্যাসাগরের সাবলীল স্পর্শে কিভাবে যে সমস্ত বন্ধন জাল ছিঁড়ে বের হয়ে পড়ল তাও কবির কাছে এক মুগ্ধতার বিস্ময়। অভিভূত কবির সাহিত্য চর্চার বিভিন্ন আঙ্গিকে বিদ্যাসাগরীয় এই সহজবোধ্যতা কতখানি প্রভাবিত করে তাও রবীন্দ্রনাথের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়। ‘চারিত্র্যপূজায় কবির উক্তি স্মরণ করা যেতে পারেÑ ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অনাবশ্যক সমস্যাড়ম্বর ভার হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলোর মধ্যে অংশযোজনায় সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।’ আজন্ম অনুপ্রাণিত কবি এই দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের চারিত্রীক ঐশ্বর্য, মানবিক বোধ, জ্ঞান সাধনার পরিপূর্ণ আধার এবং দয়াশীল আধুনিক মানুষটির অক্ষয় সম্পদের চির অনুরাগী ছিলেন। যা রবীন্দ্রনাথের মনন ও কর্ম দ্যোতনায় যুগান্তকারী অবদান রাখে। মানবতার জয়গানে, মনুষ্যত্বের অবগাহনে বিদ্যাসাগরের যে অনমনীয় চৈতন্য, নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা, চিরস্থায়ী ব্যক্তি শৌর্যের বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে কবিকে মুগ্ধতার যে জায়গায় নিয়ে যায় তা শুধু তার সাহিত্যের আঙিনা সমৃদ্ধ হয়েছে এমনটা নয়, পুরো বঙ্গদেশের বটবৃক্ষের ছায়া হিসেবেও তাকে ঐশ্বর্যম-িত করা হয়েছে। ক্ষুধিত, পীড়িত ও অনাথ বঙ্গবাসির জীবনে উনিশ শতকের এই কিংবদন্তি সামনে উপস্থিত নাই। কিন্তু যে অমৃত সমান চারিত্রীক শৌর্য তিনি বাংলা ও বাঙালীকে উপহার দিয়েছেন তা কেবল মাতৃভূমিতে চিরস্থায়িত্বের রূপে যুগের পর যুগ রোপিত থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরই শুধু নয় সময়ের বলিষ্ঠ পথিকরাও এমন দেশ নায়কের ছত্রছায়ায় জীবনকে নানা মাত্রিকে উদ্দীপ্ত ও শাণিত করবে। চিন্তায়, চেতনায়, আদর্শে বিদ্যাসাগরীয় মনন সম্পদ ধারণ করা বিশ্বকবি এইভাবে এই কৃতী পুরুষের জয়গানে নিজেকে পূর্ণ করেছেন। দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছেÑ ‘দয়া নয়, বিদ্যা নয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব এবং যতই তাহা অনুভব করিব ততই আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ এবং বিধাতার উদ্দেশ্য সফল হইবে এবং বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালীর জাতীয় জীবনে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।’ বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য মননশীলতার যৌক্তিক আঙিনায় ঠা-া এবং ধীরস্থির অনুভবে বিদ্যাসাগরকে হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদিত করলেও সৃজনশীলতার শৈল্পিক দ্যোতনায় এর প্রভাব যৎকিঞ্চিত। কবিসৃষ্ট সিংহভাগ নারীর বাল্যকালে বিয়ে হয়। বিধবা বিবাহ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে দামিনী ছাড়া আর কারও হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। আর বোধ হয় ‘পলাতকা’ কাব্যে ‘নিষ্কৃতি’ কবিতায় অকাল বিধবা মঞ্জুলিকা তার পছন্দের মানুষের সঙ্গে ঘর ছাড়লে পিতার অভিশাপে জর্জরিত হয়। উনিশ শতকের বিরাট কাল পর্বজুড়ে আর এক বাঙালীর স্বপ্নের পুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অনন্য প্রতিভাকে নবদ্যুতির উর্বর ভূমিতে ফসল ফলিয়ে সফলতার শীর্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনক এই বাঙালী ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত প্রথম ভারতীয় ¯œাতক। সুতরাং শিক্ষায়, মননে, সৃষ্টিশীলতায় এই কালজয়ী সাহিত্যিক বাঙালী সমাজকে নানা দিক থেকে প্রভাবিত করেন। বঙ্কিম প্রভাবিত এই সুবর্ণ সময়টি আত্মস্থ করতে আর এক বাংলা সাহিত্যের মহানায়ক রবীন্দ্রনাথের মোটেও ভাবতে হয়নি। হিন্দু-পুনরুত্থানবাদের সফল প্রবক্তা বঙ্কিম চন্দ্র বাঙালী সমাজকে আধুনিক ধারা এবং অনেক নতুনত্বের স্বাদ দিলেও সনাতন পন্থায় পেছনের দিকে ঠেলেও দেন। রক্ষণশীল বঙ্কিম কবি কর্তৃক বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা এবং যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু শিল্প চেতনায় সমৃদ্ধ সৃজনশীল বঙ্কিম চন্দ্র নানাভাবে কবিকে আলোড়িত ও আচ্ছন্ন করে রাখে। তাই কবির সাহিত্যে বঙ্কিমের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উপন্যাস তো অনেকখানি। আর নারী চরিত্র নির্ণয়ে ও নারীর সামাজিক অবস্থান নিরূপণে? রবীন্দ্রনাথের অনেক সময় লেগেছে বঙ্কিম চন্দ্রের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে। ‘কৃষ্ণ চরিত’ গ্রন্থে বঙ্কিম চন্দ্র আপত্তি তোলেনÑ দ্রোপদীর পঞ্চস্বামী হয়েছিল কিনা। এই গ্রন্থের পর্যালোচনায় রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে অভিমত ব্যক্ত করেনÑ দ্রোপদীর পঞ্চপতির ঘটনা যদি মহাভারতের বাহুল্য কিংবা পরবর্তীতে অন্যের দ্বারা পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হয় তবে লেখক কৃষ্ণচরিত্রের যে সব মাহাত্ম্য মহাভারত থেকে নেন সে বিষয়ে সংশয় থাকাও আবশ্যক। ব্যাসের মহাভারত বিভিন্ন মুনির নানা মতে হয়তবা সংশোধিত হতেও পারে। তাহলে দ্রোপদী আর কৃষ্ণের ঘটনাও একই কাতারে দাঁড়াবে। ১৮৭২ সালে বঙ্গ দর্শনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে বঙ্কিম চন্দ্রের সে সময়কার সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষ’। কবির বয়স মাত্র এগারো বছর। নিজের লেখাতেই আছে অতি বাল্যকাল থেকে সব ধরনের বই পড়ার অভ্যাস ছিল কবির সহজাত। পাঠ্য অপাঠ্য বিবেচনায় আনার বয়সও তখন নয়। কবির বিখ্যাত মনোস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘চোখের বালি’র ভূমিকায় লিপিবদ্ধ আছে কিভাবে রুদ্ধশ্বাসে ‘বিষবৃক্ষে’র রস সম্ভোগ করেছেন। বালক বয়সের সেই স্মৃতি দীর্ঘদিন হৃদয়ের গভীরে দাগ কাটা ছিল। ‘চোখের বালি’ যখন উপন্যাস হিসেবে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে সে সময় কবির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। আশা, বিনোদিনী কিংবা মহেন্দ্র আর বিহারির গন্তব্য কোথায় গিয়ে পরিণতি পাবে সে দোলাচল এক সময় কেটেও যায়। আশা মহেন্দ্রের পারিবারিক বন্ধনের গ্রন্থি আরও দৃঢ় করলেন। আর বিনোদিনীকে নিয়ে গেলেন আশ্রমের দ্বারে। ভেতরের বোধ আর চেতনা থেকে ভূমিকা লিখতে গিয়ে স্মরণে আনলেন ১১ বছর বয়সের এক বালক ‘বিষবৃক্ষে’র মতো এমন একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের ভেতরে কিভাবে প্রবেশ করলো। আধুনিক এবং নবযুগের উদ্দীপ্ত এক উদীয়মান কিশোরী মিশনারি স্কুলে শিক্ষা লাভ করেও সামাজিক বিপরীত স্রোত তাকে অকাল বৈধব্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করায়। সেই থেকে বিনোদিনীর যে পথচলা তা সময়ের স্রোতে ভাসমান হয়েও পরিণতিতে রক্ষণশীলতার গতিই নায়িকার শেষ ঠিকানা হয়। সৃজন ও মননশীলতার সুদীর্ঘ পথযাত্রায় রবীন্দ্রনাথের পারিপার্শ্বিক আর্থ-সামাজিক বলয় কবিকে যে মাত্রায় উদ্বুদ্ধ ও প্রাণিত করে সেখানে অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রাণপুরুষ তাঁর অগ্রজদের আধুনিক চৈতন্যের বিশাল বলয়কে আত্মস্থ করতে বীরদর্পে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তাঁদেরকে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও অগ্রনায়কের সুউচ্চ আসনে বসিয়ে মূল সারবত্তাটুকু নিতে মোটেও কার্পণ্য করেননি। যে উদার মানবিক ও গ্রহণ করার মনোবৃত্তি তাঁকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে। আর তাই উনিশ শতকের নবযুগের সুবর্ণ সময়ে জন্ম নেয়া কবি যে বিরাট ঐতিহ্যের স্বর্ণ অধ্যায়ে শৈশব, কৈশোর পার করে যৌবনের সন্ধিক্ষণে অগ্রসরমান মনন চেতনা ঋদ্ধ করলেন সেখানে এক অপরাজেয় সৃজন ব্যক্তিত্ব কাল থেকে কালান্তরে তাঁর প্রতি নিবেদিত অনুগামীদের নিয়তই শাণিত করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয় সেখানে কবির মানস চেতনা সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে সেটাই তো স্বাভাবিক। যুগোত্তীর্ণ সৃষ্টিশীল ক্ষমতা কবিকে যেমন সমকালের ঐশ্বর্য আত্মস্থ করায়, সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যিক চেতনাও তাঁকে সার্বক্ষণিক অনুপ্রাণিত করে। একইভাবে অল্প বয়সে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ তাঁর সৃজনী প্রতিভাকে নানাদিক থেকে পরিপূর্ণও করে। উনিশ শতকীয় নতুন আলোর প্রবহমান দীপ্তি, ঠাকুরবাড়ির স্বকীয় মহিমা, প্রাচীন সমাজের ভাব সম্পদ, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের মনন ও চারিত্রীক শৌর্য এবং বিদেশ ভ্রমণের বিরাট অভিজ্ঞতা কবির সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে, চৈতন্যে দীপ্তি ছড়ায়, নিজস্ব মহিমান্বিত বৈভবে যুগ ও কালকে অতিক্রম করতে অবিস্মরণীয় অবদানও রাখে। যে সফল অভিযোজনে অনন্য রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার এক বিস্ময়কর ঘটনা পরম্পরা। ‘জীবন স্মৃতি’তে আছে সমকালীন সমাজ, অপসৃয়মান অতীত ঐতিহ্য, ঠাকুরবাড়ির জ্ঞানী-গুণীর মহাসম্মিলন, ইউরোপীয় শাসন ও সংস্কৃতির প্রভাব, বিদ্যালয় গমনের শুভ মুহূর্তগুলো কিভাবে মনঃপীড়ার কারণ হয়, পিতার পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব, মাতৃবিয়োগ আর নতুন বৌঠানের চিরতরে চলে যাওয়া আর এসবের মধ্যে কবির সাবলীলভাবে বেড়ে ওঠা, নিজেকে তৈরি করা, সৃষ্টিশীল আঙ্গিনাকে নিয়মিত পরিচর্যা আর সাধনা করা সবই যেন এক ঐতিহ্যিক ভাব সম্পদে নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছা। যা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান করে তোলে প্রচলিত পরিবেশের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেও এক দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং মনন অভিব্যক্তি কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে জীবনভর চালিত করে যা অসাধারণ ও বিশাল হয়ে ওঠা এক কীর্তিমান সাধকের জীবন গাঁথা।
×