ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ শিশুর সুক্ষ্ম পরিচর্যা

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ১২ এপ্রিল ২০১৯

বিশেষ শিশুর সুক্ষ্ম পরিচর্যা

অটিজম! একটি রোগ। কারও কারও ধারণা এটি একটি মানসিক ব্যাধি অথবা ভয়াবহ অন্য কোন শারীরিক ও মানসিক অবস্থা। বাস্তবে অটিজম হচ্ছে বিকাশজনিত সমস্যা যা পরিব্যাপক ধরনের হয়ে থাকে। এই ধরনের সমস্যা শৈশবের প্রথম ভাগে দেখা যায়। যেখানে সামাজিক, বৌদ্ধিক, যোগাযোগ ও অন্যান্য দক্ষতাগুলোর বিকাশ লাভ দেরিতে হয় বা সঠিকভাবে হয় না। অটিজম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ আউটোস থেকে যার অর্থ আত্ম বা নিজ। ১৯৪৩ সালে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ লিও কের্নার অটিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। মমার্থ হিসেবে আসলে বিশেষ ধরনের স্নায়ুবিক সমস্যাই হলো অটিজম। অটিজম রোগাক্রান্ত শিশু নিজস্ব একটি মনোজগতে বসবাস করে। তাদের এই জগত চারপাশের জগত থেকে একেবারেই পৃথক থাকে। তাই তাদের আচার-আচরণও স্বাভাবিক হয় না, ফলে সামাজিক বিকাশ ও সামাজিক যোগাযোগ যেমন কথা বলা, ভাব বিনিময় করার ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। অটিজম শব্দটির কোন যথার্থ বাংলা প্রতিশব্ধ নেই যেসব আচরণের মাধ্যমে বোঝা যায় শিশুটি অটিষ্টিক সেগুলো হলো : ক। শিশুটি দেরিতে কথা বলা এবং কম কথা বলা। খ। চোখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক যোগাযোগ স্থাপন করে না। গ। পুনরাবৃত্তিমূলক কর্মকা-ে যেমন- মোচড়/ পাক খাওয়া এপাশ ওপাশ করা বা দোলা, নিজেকে কামড়ানো কিছুর সঙ্গে মাথা দিয়ে আঘাত করা। ঘ। সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা বা খেলাধুলা করতে চায় না। ঙ। একা থাকতে পছন্দ করে। চ। ডাকলে সাড়া দিতে চায় না। ছ। হাসলে হাসবে না। জ। কথা জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগ সময়েই তার জবাব দেয় না অর্থাৎ কথা বলতে পারলেও তার মাধ্যমে যোগাযোগ না করা। ঝ। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। ঞ। ক্ষুধা পেলে অথবা বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে বাবা মা অথবা কাছের মানুষকে সঠিক সময়ে বোঝাতে পারে না। ট। সাধারণত বাচ্চারা যে ধরনের খেলাধুলা করে যেমন বল খেলা, লুকোচুরি খেলা এগুলোতে অবসর গ্রহণ করে না। ঠ। জেদী এবং একগুয়ে স্বভাবের হয়। ড। বন্ধু বা সঙ্গী তৈরি করতে পারে না। ঢ। স্বাভাবিক প্রচলিত শব্দ না বলে নিজস্ব বানানো শব্দ বলে যা বেশিরভাগ সময়েই বোধ গম্যের বাইরে ইত্যাদি। সাধারণত তিন বছরের মধ্যেই অটিজম শনাক্ত করা যায়। এই শিশুরা তাদের সমবয়সীদের থেকে বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগে পিছিয়ে থাকে। যা ৩ বছরেই প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। তবে কিছু কিছু বাচ্চারা জন্মেও সময় থেকেই কিছু অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ করে থাকে। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই অটিজম আলোচনার তুঙ্গে। এই কালো ব্যাধির মূল কারণ অজানা। তবে কিছু কারণের সঙ্গে অটিজমের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে ধারণা করা হয়। যেমন- গর্ভকালীন সময়ে মায়ের রুবেলা, বা অন্য কোন ইনফেকশন হওয়া যাতে মায়ের থেকে বাচ্চারাও আক্রান্ত হয় অথবা মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ, গর্ভাবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী জ্বর ও বাবার বয়স বেশি হলেও অটিজমের ঝুঁকি বাড়ে। মা বাবার কারও যদি বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার বা সিজোফ্লোনিয়া থাকে তাহলেও বাচ্চার অটিজমের ঝুঁকি বাড়ে। মেয়েদের থেকে ছেলেদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় চারগুণ বেশি। বাবা মার যদি বাচ্চাকে দেখে সন্দেহ হয় তবে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এই রোগ লুকানোর কিছু না। যত তাড়াতাড়ি এটি শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল। এমতাবস্থায় বিল¤¦ না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ও অবশ্যই চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ পালন করতে হবে। এই ধরনের অটিজম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসাবান্ধব। এদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। তবে এই ক্ষেত্রে প্রাথমিক দায়িত্ব বাবা মারই। এই ধরনের বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের কখনই যেন মনে না হয় যে সে কারো সহমর্মিতা পাচ্ছে না বা কাউকে মনের কথা খুলে বলতে পারছে না। সন্তানের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। ওর সুবিধা-অসুবিধাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বাবা মার থেকে ভাল আর কেউই এই কাজ করতে পারবে না। এটি খুব সহজ কাজ নয় যদিও তার পরও বাবা মা মনের জোর হারাবেন না। একটা কথা মনে রাখতে হবে বাবা মাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ অবল¤¦ন। বাবা মায়ের কেউ একজন যদি স্পেশাল এডুকেশন ট্রেনিং নিতে পারেন তাহলে খুবই ভাল হয়। এই নতুন শিক্ষা সন্তানকে নতুন করে চিনতে বাবা মাকে সাহায্য করবে। অটিজমের স্বীকার বাচ্চাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে স্পেশাল এডুকেশন এর গুরুত্ব অপরিসীম। স্পেশাল স্কুলে সাধারণ পড়ার পাশাপাশি ভোকেশনাল শ্রেণীর ভাষাশিক্ষা সোশ্যাল ওয়ার্ক এবং নিয়মিত কাউ›িসলিং করানো ব্যবস্থা থাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগীতার আয়োজন করা বা বেড়াতে নিয়ে যাওয়া এ সবেরও ব্যবস্থা থাকে এই সব স্কুলগুলোতে। এর ফলে এই বাচ্চারা একই রকম অনেকের সঙ্গে নতুন ভাবে পরিচিত হয়। যাতে করে ওদের ভাবনা-চিন্তার পরিসরটাও অনেক বেড়ে যায়। অটিস্টক শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অভিভাবক ও সরকারী উদোক্তা ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অটিজম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক ফোরাম। এ কথা অনস্বীকার্য যে এই বিশেষ বাচ্চাদের সমাজের মূল শ্রোতে আসার পথে অনেক প্রতিকূলতার শিকার হতে হয়। তবে প্রত্যেকটি শিশুর মাঝেই আছে বিশাল সম্ভাবনা। তাই অটিস্টিক শিশুটি বোঝা মনে না করে তাদের লুকিয়ে না রেখে বরং পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত করা, আত্ম সম্মান বর্ধিত করা এবং কিভাবে নিজের সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণ করা যায় সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা, সহযোগিতা ও সমাজের সকল স্থরের তথা প্রাতিষ্ঠানিক পূর্ণ সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। ২০০৮ সালে জাতিসংঘ ০২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা অটিজম চিকিৎসা ও সচেতনতাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বছর ১১তম অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হলো।
×