ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আর কত সহিংসতা...

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ১২ এপ্রিল ২০১৯

আর কত সহিংসতা...

তীব্র দহনের যন্ত্রণায় কাতরানোর সময়েও নুসরাতের শেষ আকুতির সঙ্গে সম্মিলিত কণ্ঠের আওয়াজ এমন বর্বরোচিত হামলার দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় আইনী নিষ্পত্তি। পুরনো বছরের সব আবর্জনা ধুয়ে-মুছে সাফ করার সময়ে আবারও এক তরুণী দগ্ধতার আগুনে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ১৪২৬ সালকে স্বাগত জানাতে যখন বাংলাদেশ নানামাত্রিক আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে প্রস্তুত তখনই গণমাধ্যমের আঙিনা ভারি হয়ে গেল এক অনাবশ্যক দুর্ঘটনার নির্মম আঘাতে। নৃশংসতার এমন বলি হয়েছে এক মাদ্রাসাছাত্রী। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থীকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তারই সতীর্থরা। এই নিরীহ ছাত্রীটির অপরাধ ছিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজদৌলা তার নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করলে তার মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ফলে অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে পুলিশ আটক করে। সে শিক্ষক এখনও কারাগারে! ইতোমধ্যে নুসরতকে হুমকি দেয়া হতে থাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু নুসরত এবং তার পরিবার নিজেদের করা মামলা নিয়ে কোন ধরনের সমঝোতায় যেতে রাজি হয়নি। ফলে অন্য উপায় না দেখে পরীক্ষার্থীকে মাদ্রাসার ছাদে কৌশলে ডেকে নিয়ে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়া হয়। সে জোর কণ্ঠে অস্বীকার করলে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা (বোরখা) কয়েক ছাত্রী তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে। দগ্ধ ঝলসানো শরীর নিয়ে মেয়েটি দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হযে ছোটাছুটি করতে থাকার এক পর্যায়ে অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে নিতে পরামর্শ দেন। এখন নুসরত ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছে। শরীরের প্রায় ৮০ ভাগ পুড়ে যাওয়া এই শিক্ষার্থী এখনও শঙ্কামুক্ত নন বলে চিকিৎসকরা জানান। এমন লোমহর্ষক বীভৎস ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দেয়। দিনের বেলায় পরীক্ষার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও যদি কোন মেয়েকে নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে পবিত্র এই অঙ্গনটির উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। শুধু তাই নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ আসনে যিনি বসে আছেন তারই প্ররোচনায় এমন নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। শিক্ষা শুধু জাতির মেরুদ-ই নয় একজন শিক্ষক ও পিতৃস্থানীয় অভিভাবক। যার স্নেহছায়ায় ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যার্জন ছাড়াও নিশ্চিন্তে নিরাপদে তাদের অবস্থান নির্বিঘœ করে। সেই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকই যদি হায়েনার বেশ ধরে হিংস্রতায় কোন ছাত্রীকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় সেখানে সমাজ প্রচলিত আইন, বিচার কিংবা ন্যায় নীতি কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তা ভাবাও যায় না। কোন মানুষের ব্যক্তিক বিবেক যদি তাকে সচেতনতায় পরিশীলিত ও মার্জিত করতে না পারে তা হলে শুধু বিচারিক প্রক্রিয়ায় এমন দুষ্কর্মকে রোধ করা যায় কিনা সেটাও ভাবার বিষয়। মানুষের মধ্যে পশুত্ব, দেবত্ব দুই শক্তিই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সে নিজেকে মানবিক বোধ, রুচি, শিক্ষা এবং সুস্থ সংস্কার চেতনায় শুদ্ধ শক্তিকেই লালন করে। অন্য মাত্রায় ভয়ঙ্কর অপশক্তিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বিকৃত রুচি আর অপসংস্কৃতি কোন মানুষকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয় সেটাও তার নীতিহীন বিবেকের বোধ আর অভিব্যক্তিরই বহির্প্রকাশ। কোন ঘৃণ্য অপকর্ম থেকে মানুষ যদি নিজেকে মুক্ত করতে না পারে, তাহলে তার আদর্শিক চেতনা, শিক্ষা, ধর্ম, সামাজিক ন্যায়বোধ কি পর্যায়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল। আর সেখানেই সব মানুষকে দায়বদ্ধতার পরিচয় দেয়া প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। যে কোন নারীর প্রথমে পরিচয়ই মা। মাকে যারা সম্মান করতে পারে না তাদের কি সন্তান হওয়ার যোগ্যতা থাকে? পরবর্তীতে একটি নারী কোন পুরুষের ঘরনি হয়। তার স্বামী যদি বিশ্বাস আর ভরসা ভঙ্গ করে ন্যক্কারজনক কোন কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সে তার স্ত্রীর প্রতিও করে জঘন্য অন্যায়। এক সময় এই পুরুষই পিতৃত্বের মর্যাদায় কোন কন্যা সন্তানের জনক হয়। আর সেই পুরুষই যদি তার মেয়ের সমবয়সী অন্য কোন নারীকে লাঞ্ছিত করে তাহলে মেয়ের কাছে তার অশুভ কর্মটি কি ধুলায় লুণ্ঠিত হয় না? জানি না যারা এসব জঘন্য অপরাধ করে তাদের এমন বোধ, বুদ্ধি আর বিবেচনা কোথায় গিয়ে মেশে। নারীর সম্মান আর মর্যাদাকে যদি যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হতে হয় তাহলে সে দায়ভাগ কার? চলে আসা সামাজিক অপসংস্কার? নাকি সুস্থ ও স্বাভাবিক মূল্যবোধের স্খলন? ব্যক্তিক কু-মনোবৃত্তির জঘন্য অভিলাষ শুধু কি পুরুষকে বিভ্রান্ত করে? নারীরাও কি এমন দায়ভাগ থেকে নিজেকে সরাতে পারবে? নুসরতকে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দিল তারই সহপাঠী ছাত্রীরা। জানি না কি করে মেয়েরাই কোন পুরুষের কুকর্ম ঢাকতে এমন জঘন্য কাজের ভার নিতে পারে? সে উত্তরও নিশ্চয়ই তাদের জানা আছে। ব্যাপারটা খোলাসা করা অত্যন্ত জরুরী।
×