ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদুল হাসান

আমার বাবা ও একাত্তরের অম্লান স্মৃতিময় স্থানগুলো

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১২ এপ্রিল ২০১৯

আমার বাবা ও একাত্তরের অম্লান স্মৃতিময় স্থানগুলো

মা-মাটি-মাতৃভূমি ও বাঙালীর আত্মপরিচয় নিহিত আছে- বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অমোচনীয় ইতিহাসের ভেতরে। ইতিহাস ও আত্মপরিচয় ছাড়া পৃথিবীতে কোন জাতি কোন দিন দাঁড়াতে পারেনি। যে জাতির কোন ইতিহাস নেই, সে জাতির কোন বর্তমান কিংবা আগামী নেই। আমরা বর্তমানের ভেতরে বসবাস করলেও অতীতই আমাদের প্রেরণা ও শক্তি। ১৯৭১ আমাদের ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত লাল অধ্যায়-যার লাল-কালো অক্ষরের ভেতরে আছে বাঙালীর শক্তি ও অস্তিত্ব। বাংলাদেশের ইতিহাস ও দর্শনকে অন্তরে ধারণ করেই আমরা বর্তমানে বসবাস করি। আজ আমি ১৯৭১ সালের কথা বলব। আমাদের শরণার্থী জীবনের কথা বলব। শুধু স্মৃতিচারণ নয়, এ আমার আত্মজীবনের জার্নাল। রক্ত নিংড়ানো অস্তিত্বের সেই লড়াইয়ে, আত্মজীবনী বিষয়ক এসব জার্নালে সময়ের ইতিহাসকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার সন্তানদের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়া দিয়ে আমাদের লাল টগবগে পূর্ব-পুরুষেরাই এই দেশ স্বাধীন করেছেন, আমার প্রয়াত পিতা ছিলেন তাঁদের একজন। তাই, আমার লেখার সর্বাংশে জড়িয়ে আছে আমার বাবার স্বপ্ন ও লড়াই। আত্মজীবনের লড়াইকে লিখতে এসে একজন লেখককে ভূমির ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলে উদাসীন গল্প লিখলে চলে না। আমি পূর্বপুরুষের লড়াইয়ের কথা, আমার বাবার কথা বলতে চাই। আমি জানি, দেশের প্রতি দায় ও আত্ম-অস্তিত্বের এই জার্নাল কখনই মূল্যহীন হয়ে যাবে না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসব লেখা অমূল্য হয়ে উঠবে। উত্তরাধিকারীরাই ইতিহাসের ভাষা ও শক্তিকে বহন করেন। আমাদের কৃতী, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে তাদের কাছেই রেখে যেতে হবে। আমাদের সময়-যাপন, লড়াই, ঐতিহ্য, দৃষ্টি ও দৃষ্টিকোণ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আকর বলে বিবেচিত হবে। উত্তরাধিকারের পথরেখায় ওরা পথ চলতে থাকুক। পিতার ইতিহাস, মুক্তির ইতিহাস মানসে ধারণ করে ওরা আত্ম-পরিচয়ের শক্তিতে বেঁচে থাকুক। আমি আমার পিতার লড়াইয়ের ইতিহাসটাকে এই প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে চাই। আমি তো লেখক নই। শব্দের সঙ্গে বসবাস করতে শিখিনি। খাতা-কলম নিয়ে তাই চুপ করে বসে থাকি। একটা দায় ও দায়িত্ব নিয়ে লেখার টেবিলে বসে থাকি। ফ্রেমে বাঁধা বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বাবার দৃষ্টি ও দর্শনকে লিখতে চেষ্টা করি। ॥ দুই ॥ নেত্রকোনা জেলার হাওড়াঞ্চলে আমার জন্ম। ছোট একটা থানা শহরে কেটেছে আমার শৈশব ও যৌবন কাল। এখানকার মানুষেরা উকিল মুন্সির গানের মতো সহজ-সরল ও উদার। এখানকার মাটিতে সোনালি ফসল। এখানকার কংস, ধনু আর জলমগ্ন হাওড়ে মাছ আর মাছ। এখানকার জমির মতো এখানকার মানুষের মনটাও উর্বর। খুব অল্পতেই এই অঞ্চলের মানুষ খুশি হয়। এই অঞ্চলের মানুষ বাইরে যেতে চায় না। কেন যাবে? হাওড় ভর্তি ধান-মাছ রেখে কোন দুঃখে মানুষেরা বাইরে যাবে। কুয়াশার শীতল বাতাসে, রৌদ্রের হাসিতে এখানকার মাঠ থেকে ভেসে আসে পাকা ধানের সুবাস। এই ধানের সুবাস নাকে নিয়ে কেউ অসুখী হতে পারে না। এমন ভাঁটি অঞ্চলের মানুষ আমি। আমার বাবা ডাক্তার আখলাকুল হোসেন আহমেদ। একজন মানুষ যখন আরেকজনকে দেখিয়ে বলে, ‘উনি আখলাক ডাক্তারের ছেলে’- আমার বুকটা তখন শান্তিতে ভরে যায়। হাওড় ও ভাটি বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে আমার বাবাকে এক নামে সবাই চেনেন। বাবাও সবাইকে চেনেন। হাওড়ের মতো বিশাল তাঁর মন। তিনি বেশিরভাগ পরিচিতদের নাম ধরেই ডাকতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির সবার নাম বলে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। বাবার ছায়ার পাশে বসতে বসতে মানবিকতা, উদারতা, আন্তরিকতা শিখেছি। বাবা বলতেন, ‘ভাষা শিখতে হবে। ভাষা শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কী বাংলা কী ইংরেজী। দুটি ভাষাতেই পারদর্শী হতে হবে। নিজেকে প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম ভাষা। ভাষা শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানার্জন অসম্ভব।’ ভাল ফলাফলে তিনি অসম্ভব খুশি হতেন। স্কুলে আমার প্রথম স্থান অর্জনে খুবই আনন্দিত হতেন। অনার্সে প্রথম শ্রেণী পাবার কথা শুনে কতই না আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, সবার কাছে আমার ভাল ফলাফলের কথা বলতেন। আমি যখন বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী করতে অস্ট্রেলিয়ায় যাই, তিনি যে কত খুশি হয়েছিলেন তা আজও মনে পড়ে। আমাদের উপজেলায় কোন তরুণ কর্মকর্তা এলে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে মিশতেন। আমরা ছোটবেলায় এ রকম অনেক কর্মকর্তার প্রশংসা শুনেছি বাবার মুখে। বাবা বলতেন, ‘এই অফিসার খুব সৎ’। আমার বাবার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বাবাকে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন প্রদান করেন। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-২২ আসনে নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বাবা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কাজ করেন। আজ আমি সে স্থানগুলোর কথা লিখব। আমার পিতার স্মৃতির খোঁজে এই স্থানগুলোতে আমি ভ্রমণ করে এসেছি। ॥ তিন ॥ মেঘালয়ের পথে পথে ৪ থেকে ৭ এপ্রিল ২০১৮ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে এসেছি। বর্ডারের এবড়ো-থেবড়ো পথ ধরে কখনও হেঁটেছি আবার গাড়িতে পথ পাড়ি দিয়েছি আর শিহরিত হয়েছি। এই শিহরণ ও চেতনাকে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের রাঙামাটির পথে ছড়িয়ে আছে ১৯৭১ এর স্মৃতি। আমার পিতার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মেঘালয়ের এই দুর্গম পথে আমি বাবার স্মৃতিময় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে এসেছি। মেঘালয়ের এই তলদেশেই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ১১ নং সেক্টর। মেঘালয়ের এই নির্জন ছায়াতেই আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ শরণার্থী। গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সাউথ গারো হিলের এমনই একটি প্রধান ক্যাম্পের নাম মহেষখলা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এই ভাঁটি বাংলার লোকেরা দলে দলে সীমান্ত এলাকায় হাজির হচ্ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তখন প্রধান দায়িত্ব ছিল এই অসহায় মানুষদের সহায়তা করা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মানুষ এই মহেষখলা দিয়েই ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেছিল। ভারতের অভ্যন্তরেও মহেষখলা নামে একটি স্থান ও বাজার রয়েছে। মূলত ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় মহেষখলা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মহেষখলার এক ভাগ ভারতে এবং এক ভাগ বাংলাদেশে পড়েছে। এটি মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত এলাকা। এই মহেষখলা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন বাবা। পরবর্তী সময়ে তিনি সিভিল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল (Civil Administrative Council of Bhali Area of ¸mensingh District N.E. Zone No II) এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। হাজার হাজার মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা, খাবারের যোগাড়, ঔষধের যোগাড়- এই ছিল তাঁর কাজ। মহেষখলা ক্যাম্পে যাওয়ার আগে তিনি এবং আবদুল খালেক (এমপিএ) মিলে পুরো ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করেছেন। এ সময় সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আঃ হেকিম চৌধুরীও দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্যাম্পে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছেন। ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছেন। বাবার মতো আওয়ামী লীগের নেতারা সে দিন ঠিকই বুঝেছিলেন গেরিলা ওয়ারফেয়ার ছাড়া পাকিস্তানী আর্মির মতো একটি শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কোনভাবেই পারব না। তাই এই ভাটি অঞ্চল থেকে কৃষক, ছাত্র জনতাকে সংগ্রহ করে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে একটা শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী তৈরিতেই কাজ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি মহাদের, রংড়া, তুরা বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার স্মৃতি ও স্বাক্ষরগুলোকে খুঁজতেই আমার এই মেঘালয় ভ্রমণ। আমি জানি না আমার এই লেখা কেউ পড়বেন কি-না! কিন্তু একটা বিশুদ্ধ ও নিবেদিত মনে আমি বাবার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় জায়গাগুলো পরিভ্রমণ করেছি। এই ভ্রমণের মাধ্যমে আমি প্রজন্মের সঙ্গে প্রজন্মের একটা সাঁকো বাঁধতে চেয়েছি। এই ভ্রমণের সঙ্গে আমার স্ত্রী লায়লা আরজুমান এবং আমার ছোট ছেলে সাবাব ছিল। আমার বড় ছেলে সাদাবকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারলে খুব ভাল হতো। ইতিহাস সম্পর্কে ওর জানার আগ্রহ প্রবল, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেনি। যাক, শেরপুরের নালিতাবাড়ির নাকুয়া বর্ডার দিয়ে আমরা ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করি। সীমান্তে বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, শেরপুর পুলিশ সুপার, বিজিবির সেক্টর কমান্ডারসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আমাদের বিদায় জানালেন। সীমান্তে প্রবেশের পর সাউথ হিল গারো ডিস্ট্রিক্টের একজন সহকারী কমিশনার, গোহাটীতে কর্মরত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ আমাদের অভ্যর্থনা জানান। ওরা আমাদের একটি স্মৃতিসৌধে নিয়ে যায়। এই স্মৃতিসৌধটিও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ইঝঋ এর যে ৯ জন বীর সেনানী এখানে জীবন দান করেছেন তাদের উদ্দেশে নির্মিত ও তাদের নাম সম্বলিত এই স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করি। কত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা! এই নয়জন ভারতীয় সৈনিক হয়তো জীবনে কল্পনাও করেননি যে- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন দিতে হবে। কিন্তু সৈনিকের ধর্ম পালন করে ওরা নয়জন এই মাটিতে শুয়ে আছেন। এই বীর সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিসৌধ থেকে বেরিয়ে আসি। (চলবে...) লেখক : সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
×