ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মসমর্পণে চরমপন্থীরা

প্রকাশিত: ০৯:২২, ১২ এপ্রিল ২০১৯

আত্মসমর্পণে চরমপন্থীরা

রাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা তাদের না থাকলেও কথিত শ্রেণীশত্রু ও জোতদারসহ সাধারণ মানুষ হত্যায় ছিল পারদর্শী। ‘কমিউনিজম’ সম্পর্কে কোন পাঠ বা চর্চা না থাকলেও তা প্রতিষ্ঠার নামে ওরা বেছে নিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট, ডাকাতি আর দেশ ও জনগণ বিরোধী কর্মকাণ্ড। স্বাধীনতা পূর্বাপর সময়ে এই সব চরমপন্থী চরম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল যে, তার থেকে ফেরার আর কোন উপায় ছিল না তাদের। পরিবার আর স্ত্রী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন-রাত পালিয়ে বেড়ানো, খাওয়া-ঘুম ঠিক নেই, পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর সামনে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার নামে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসী জীবন বেছে নিয়ে চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল এক সময়। দোর্দ- প্রতাপে এক সময় তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ‘বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেত’ অবস্থা ছিল। থানা ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র লুট আর পুলিশ হত্যা ছিল তাদের অন্যতম ব্রত এবং ধর্মও। সরকারী খাদ্যগুদাম লুট এবং অগ্নিসংযোগে ওরা পারদর্শী ছিল। সেতু, কালভার্ট ভেঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করার কাজেও ছিল সিদ্ধহস্ত। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে চরমপন্থী সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকা- শুরু করে। এরা নিজেদের চীনপন্থী বলে দাবি করত। অনেকে এমন স্লোগানও দিয়েছে এবং দেয়াল লিখন করেছে যে, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।’ আরও জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করত মাও জেদংয়ের ভাষ্য, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের বিভিন্ন গ্রুপ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সমর্থন করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধা নিধনে মত্ত ছিল। এদের দল বা গোষ্ঠীপতিরা মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে প্রচার চালায়। চীন পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় এবং গণহত্যায় সমর্থন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এরা অবস্থান নেয়। এদের অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশকে ওরা মেনে নিতে পারেনি। তাই কেউ কেউ সংগঠনের নামের আগে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা ব্যবহার করত। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ইত্যাদি নামে দল, উপদল, গোষ্ঠীর তৎপরতা চলে। দলভেঙ্গে দল গঠন করা ছিল সহজাত। মতভেদ হলেই দলীয় প্রতিপক্ষকে হত্যা করা ছিল ওদের ‘কমিউনিজম’ চর্চা। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে শ্রেণীশত্রু ও জোতদার খতমের রাজনীতির ধারক মোহাম্মদ তোয়াহা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘গলাকাটার রাজনীতি করে ভুল করেছি।’ স্রেফ ভুল! মানুষ হত্যা করেও এরা পার পেয়েছেন! আরেক গলাকাটা রাজনীতিক আবদুল হক ১৯৭৪ সালে ভুট্টোকে পত্র দিয়েছিলেন অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য চেয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদের গণবাহিনীও মানুষ হত্যাসহ সম্পদ ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছিল। হেন অপকর্ম নেই, যা তারা করেনি। প্রকাশ্যে ঈদের জামাতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে। থানা লুট, এমপি ও পুলিশ হত্যা, খাদ্যগুদামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট সবই চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সামরিক শাসক জিয়ার ক্ষমতা দখলের পর এদের একটি অংশ জিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এই দলগুলো নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। একপর্যায়ে এরা পুরোপুরি ডাকাত বনে যায়। এদের কোন রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন গ্রুপের দখলে থাকায় নিজেদের মধ্যে হানাহানির মাত্রাও বাড়তে থাকে। বর্তমান সরকার আমলে এদের ‘রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক’ তৎপরতা কমে আসে। ২০ বছর আগে ১৯৯৯ সালে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার চার শতাধিক চরমপন্থী সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তাদের আনসার বাহিনীতে বিশেষ নিয়োগ দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়। এবার ১৫ জেলার ৫৯৫ জন চরমপন্থী আত্মসমর্পণ করলেও এখনও অধরা রয়েছে বহু চরমপন্থী। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মুক্ত পরিবেশে এরা বসবাস করুক- এটা সরকারসহ দেশবাসীও চায়।
×