ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেঁচে থাকল শুধু প্রতিবাদ

প্রকাশিত: ১৩:৪৫, ১১ এপ্রিল ২০১৯

বেঁচে থাকল শুধু প্রতিবাদ

মোরসালিন মিজান ॥ প্রতিবাদটা বেঁচে থাকল। নুসরাত আর নেই! আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে সবার সামনে ছটফট করতে করতে মারা গেল মেয়েটি। আহা মৃত্যু! ২০১৯ সালে এসেও এমন করুণ মৃত্যু দেখতে হলো বাংলাদেশকে। আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে, চুরমার হয়ে যাওয়া স্বপ্ন নিয়ে ফেনী থেকে ঢাকায় এসেছিল নুসরাত। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে প্রাণপন লড়ছিল। সংশপ্তক হয়ে বিদায় নিয়েছে। এই পঁচে গলে যাওয়া সমাজ থেকে, দানব পুরুষের থাবা থেকে চিরতরে মুক্ত হলো আরও একজন নারী। তবে তার প্রতিবাদ হারিয়ে যাওয়ার নয়। নারী হয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নুসরাত যে প্রতিবাদ করেছে, রুখে দাঁড়ানোর তার যে প্রত্যয় আমরা সেটিকেই বাংলাদেশ মানব। নুসরাত গুটিয়ে যায়নি। মুখ বুজে সহ্য করেনি শুধু। তার একলা সংগ্রাম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। ফেনীর সোনাগাজীর মেয়ে নুসরাত। সেখানকার একটি মাদ্রাসায় পড়ত। কিন্তু কি লজ্জার কথা, ওই মাদ্রাসারই প্রিন্সিপাল সিরাজ উদদৌলা নিজের কক্ষে ছাত্রীটিকে ডেকে নেন। অধ্যক্ষের কক্ষেই যৌন হয়রানির শিকার হয় সে। এর পর চুপ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা। কত রকমের ফন্দি। হুককি ধমকি। কাজ হয় না। মোটেও টলানো যায় না নুসরাতকে। বিচার প্রার্থী হয়ে থানায় যায় সে। মামলা হয় অপরাধীর বিরুদ্ধে। বর্বর শিক্ষককে যেতে হয় কারাগারে। কিন্তু নুসরাত তখনও জানত না, তার লড়াইয়ের সবে শুরু। এর কিছুদিন পর আলিম প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিতে মাদ্রাসায় যায় সে। হলে প্রবেশের আগ মুহূর্তে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যায় অধ্যক্ষের পাঠানো দুর্বৃত্তরা। মধ্যযুগীয় বর্বরতা যাকে বলে ঠিক তা-ই হয় মেয়েটির সঙ্গে। তার হাত পা বেঁধে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। নুসরাত ওই অবস্থায় নিজেকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করে। তাকে দ্রুত নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিক্যালে। বার্ন ইউনিটে ঢোকানোর সময় তোলা ছবিতে দেখা যায়, গোটা শরীর ব্যান্ডেজ করা। এমন নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষ হয়? সারা দেশজুড়ে এই এক প্রশ্ন তখন। ধরেই নেয়া হয়েছিল টেকানো মুস্কিল হবে। কিন্তু বিস্ময় নিয়ে সবাই দেখল, আগুনে পোড়া এইটুকুন মেয়ে মৃত্যুর ভয় কাটিয়ে উঠেছে। হাসপাতালে শুয়ে সে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে। ভাইকে বলেছে, আমার যা কিছু হয় হোক, তবুও ওদের যেন বিচার হয়। কণ্ঠনালী পুড়ে গেছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। এর পরও বিচার চায় সে। দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে চিকিৎসককে সে জানায়, নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরা চারজন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ওই চারজনের একজনের নাম শম্পা বলেও জানিয়ে যায় সে। সবই বিচার পাওয়ার আশায়। পুলিশের খুঁজে বের করা খাতায়ও প্রতিবাদী নুসরাত। সেখানে সে লিখেছে, ‘আমি লড়ব শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। মরে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া। আমি মরব না, আমি বাঁচব। আমি তাকে শাস্তি দেব। যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। পরের কথাগুলো বাংলাদেশের আইনও বলে। নুসরাত লিখে, ‘আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে, তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নিবে। আমি তাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেবো। ইনশাআল্লাহ।’ এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার খবর শুনে অনেক বাবা মায়ের বুক হয়ত সেদিন ধরফর করে উঠেছিল। নিজের মেয়েটির সঙ্গে একটু আগে কথা হয়েছে, তার পরও অফিস থেকে বাবা ফোন দিয়েছেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চেয়েছেন, কোথায় আছিস মা? ঠিক আছিস তো? মা জানতে চেয়েছেন, কখন স্কুল শেষ হবে? কলেজে আর কটা ক্লাস বাকি? ভার্সিটি শেষে সরাসরি বাসায় ফিরছিস তো? নুসরাতের মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে গল্পটা। প্রতিটি বাবা মা শোক করবেন। মাতম করবেন। কিন্তু তার বেশি বিবেচনায় নেবেন নুসরাতের সংগ্রামী চেতনাকে। নিজেদের মেয়েকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেবেন। নারী নিজেও নিজের ভেতরের শক্তি সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন। নতুন করে শপথ নেবেন। আর তাহলেই স্বার্থক হবে নুসরাতের সংগ্রাম। পৃথিবীর কেউ ভাল তো বাসে না/এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না...। নারীর জন্য ভালবাসার পৃথিবী হোক। চরম শাস্তি পাক অপরাধী শিক্ষক। তা না হলেই কেবল দায় মুক্তি পেতে পারি আমরা। নচেত একদমই নয়।
×