ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় হাসির ফেরিওয়ালা

প্রকাশিত: ১২:৫১, ১১ এপ্রিল ২০১৯

বিদায় হাসির ফেরিওয়ালা

অভিনয় দিয়ে হাসিয়েছেন, কাঁদালেন মৃত্যু দিয়ে। এখানেই একজন শিল্পীর সত্যিকারের সার্থকতা। এমনই এক সার্থক শিল্পী টেলি সামাদ। আজীবন শিল্প চেতনায় নিমগ্ন থেকে মানুষের বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছেন। তার মার্জিত কৌতুক অভিনয়শৈলীতে রুপালি পর্দার দর্শক বুকভরা হাসি নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। এমন একজন মানুষের প্রস্থান মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন। তার প্রস্থানে প্রিয়জনের হারানোর ব্যথায়, কান্নায় ডুবেছেন অনেকেই। শিল্পদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, শিল্পী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত এ নামটি আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমী দর্শক। চিত্রকর হবেন বলে চারুকলায় পদার্পণ, পাশাপাশি সঙ্গীত আর অভিনয় শিক্ষা, এগুলো সমান্তরালে চলেছে জীবনের একপর্বে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন একজন অভিনেতা হিসেবে, কমেডি চরিত্রে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মানুষ হাসানোর মতো এক কঠিন অভিনয়শৈলীতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। পর্দায় নিজের মতো করে বিনোদিত করেছেন সবাইকে। কেন কৌতুক অভিনেতা হলেন? প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষতকারে টেলি সামাদ বলেছিলেন, ‘আমার বয়স যখন কম ছিল। তখন আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছে, তুই কি নায়ক হবি? আমি সব সময় বলেছি, আমি হিরো হবো না। আমি হবো কমেডিয়ান অভিনেতা। কারণ, একজন কমেডিয়ান যদি একবার মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে, তাহলে আর তার মন থেকে বের হয় না। একজন নায়ককে সবাই পছন্দ করে না। কারও ভাললাগে আবার কারও ভাললাগে না কিন্তু একজন কমেডিয়ানের কোন ভাগ নেই, সবাই তাকে পছন্দ করে, তার কথায় সবাই হাসে।’ সত্যিকার অর্থে হাসির রাজ্যে তিনি সবার মধ্যে রাজা হয়ে আছেন। টেলি সামাদ ১৯৪৫ সালের ৮ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের (তৎকালীন বিক্রমপুর) সিরাজদীখান উপজেলার নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম আবদুস সামাদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। অভিনয় জগতে এসে কীভাবে টেলি সামাদ হলেন? নামের আগে ‘টেলি’ শব্দটি কেন ব্যবহার করতেন এই অভিনেতা? স্বাধীনতার পর পর টেলিভিশনে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন টেলি সামাদ। চলচ্চিত্রে তার উপস্থিতিতে সব ছবি হিট। তার কৌতুক দেখতে সিনেমা হলে দর্শকরা ভিড় জমাতো। সবখানেই তখন তাকে নিয়ে চর্চা হতো। সবার মুখে একই কথা, অনেক দিন পর ভাল একজন কৌতুক অভিনেতা পাওয়া গেছে। তিনি বলেছিলেন, একদিন বিটিভির এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই। তখন সেখানে বিটিভির ক্যামেরাম্যান মোস্তফা মামুন বলেন, সামাদ শুন, আজ থেকে তোর নাম টেলি সামাদ। সেই থেকেই আমি আবদুস সামাদ থেকে হয়ে গেলাম টেলি সামাদ। অভিনয়কে ভালবেসে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এ জগতেই ব্যস্ত থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে সর্বশেষ তিনি অভিনয় করেছিলেন ‘জিরো ডিগ্রী’ ছবিতে। এরপর আর দেখা মেলেনি তার। কিন্তু মনের ভেতর পুষে রেখেছিলেন আবারও অভিনয়ে ফিরে আসার ইচ্ছেটা। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়টুকু, কেটে গেল তার শরীরের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ করতে করতেই। অবশেষে সেই যুদ্ধে হেরেই গেলেন নন্দিত এ শিল্পী। এছাড়া টিভিতে সরাসরি একটি গানের অনুষ্ঠান করারও পরিকল্পনা ছিল তার। যেখানে তিনি নিজের ও ভারতের শিল্পীদের গাওয়া কিছু জনপ্রিয় গান গাইবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে অনুষ্ঠানটি তিনি করতে চেয়েছিলেন। সেটিও আর করা হলো না তার। গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, অভিনয় ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে অসম্ভব। দীর্ঘ সময়ের বর্ণাঢ্য শিল্পী জীবন টেলি সামাদের। কিন্তু শেষদিকে এসে অসুস্থতা নিয়ে অনেক কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন শক্তিমান এই অভিনেতা। এ সময় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন তিনি। এ বছরের জানুয়ারির শেষদিকে বাসায় ফিরেন। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসাতেই থাকতেন। তখন বলেছিলেন, হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর আমার শোবার রুমে হাসপাতালের মতো বিছানা করে দেয়া হয়েছে। দুজন নার্স সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেন। ভাত একদমই খেতে পারি না। ফল-মূল, জুস, স্যুপ জাতীয় খাবার খেতে হয়। ফোনেও খুব কম কথা বলি। শুয়েই থাকতে হয় বিছানায়। একদমই শুয়ে থাকতে ভাললাগে না। দৌড়াতে এবং আগের মতো কাজ করতে মন চায় আমার। টেলি সামাদের মৃত্যুতে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রিয় এই মানুষটির মৃত্যু সংবাদ শুনে থমকে গিয়েছেন অনেকেই। চলচ্চিত্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ও জনপ্রিয় অভিনেতা টেলি সামাদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক জীবনে অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে টেলি সামাদ জয় করে নিয়েছেন এদেশের অসংখ্য সিনেমাপ্রেমীর হৃদয়। ১৯৭৩ সালে ‘কার বউ’ চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। ‘নয়নমনি’ ও ‘পায়ে চলার পথ’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেন। ‘মনা পাগলা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ৫০টির মতো চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন। অভিনয়জীবনে চার দশকে ৬০০-এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ভালবেসে নেমে পড়েছিলেন অভিনয় আঙ্গিনায়। চার দশক ধরে মাতিয়েছেন সিনেমা অঙ্গন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হাসির ফেরিওয়ালা হয়ে হাসি বিলিয়েছেন মানুষের অন্তরে। প্রিয় ব্যক্তিত্ব টেলি সামাদকে হারিয়ে আজ কাঁদছে বাংলাদেশ; কাঁদছে এ দেশের চলচ্চিত্র। তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ-বিদায়। শব্দটির আপাদমস্তক বিষাদে ভরা। মানবজীবনের সর্বশেষ যে বিদায় অবধারিত হয়ে আসে তার নাম মৃত্যু। বিদায় কমেডিয়ান টেলি সামাদ। তোমার অভিনয়ের মধ্যে তুমি বেঁচে থাকবে।
×