ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যাত্রা এখন ধূসর স্মৃতির পালা

প্রকাশিত: ১২:৫০, ১১ এপ্রিল ২০১৯

যাত্রা এখন ধূসর স্মৃতির পালা

হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার, যাত্রা যাত্রা, রুপালি মঞ্চে অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ...। একটা সময় ছিল যখন মাইকে এমন ঘোষণা গ্রামেগঞ্জে শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না। কর্মব্যস্ত মানুষ কাজের ফাঁকে তখনই প্রস্তুতি নিয়ে ফেলত রাতের যাত্রাপালা দর্শনের। উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনায় মুখরিত ছিল যাত্রাদলগুলোতেও। এই কিছু দিন আগেও জোয়ান বৃদ্ধ এবং তারও আগে বাড়ির বউঝিরা পর্যন্ত সারারাত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাত্রাভিনয় দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ত। পুরাণ, ইতিহাস, দেশপ্রেম, মহর্ষী ব্যক্তিত্ব, লোকজ সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্র ও গল্পগুলো জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠত দর্শকের মানসপটে। এ অঞ্চলে যাত্রার সূচনা হয় খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে। যাত্রা অর্থ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন। তখন দলবেঁধে মানুষ যাত্রা করে করে দেবদেবীর বন্দনা করত। এই বন্দনার সঙ্গে অভিনয় যুক্ত হয় শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে। তার আগে থেকেই এ অঞ্চলে পালাগান ও কাহিনী কাব্যের প্রচলন ছিল। তারপর শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা সীতার বারোমাসী রাধার বারোমাসী থেকে ধীরে ধীরে যাত্রাপালা আজকের এই রূপ লাভ করে। জানা যায় রুক্ষ্মীনি হরণ, প্রথম পূর্ণাঙ্গ যাত্রাপালা। তারপর অষ্টাদশ শতকে যাত্রাপালা সমগ্র বাংলায় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। আজ গ্রামীণ বাংলার বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম যাত্রাপালা প্রায় বিলুপ্ত। উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, আকাশ সংস্কৃতির একচ্ছত্র প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, জুয়া, অপ্রাসঙ্গিক অশ্লীল নাচ কেড়ে নিয়েছে বাঙালীর প্রাচীনতম এই লোক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আশির দশকে দেশে ৩০০ যাত্রাদল ছিল। ষাট-সত্তর এবং আশির দশক ছিল যাত্রার রমরমা সময়। ১৯৭৫ সালের পর থেকেই নেমে আসে এই শিল্পের ওপর বিধিনিষেধের খড়গ। আজ এই মুহূর্তে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যাত্রার নাম শুনলেই প্রশাসনের গায়ে যেন আগুন ধরে যায়। স্বাধীনতার পর শিল্পকলা একাডেমি এগিয়ে এসে জাতীয় যাত্রা উৎসবের আয়োজন শুরু করলেও কয়েকবারের পর সেটাও ঝিমিয়ে পড়ে। সারাদেশে ৩০০ দলের মধ্যে এখন ৩০টি দলও আর নেই। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে বেছে নিয়েছে ভিন্ন পেশা। কেউ কেউ ঝুঁকে পড়েছে অনৈতিকতার পথেও। সর্বসাকুল্যে টিকে থাকা এই কয়েকটা দলেও আর দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী গায়ক বাদক-পালাকার নেই। অথচ এক সময় শিশুরাম, সুবল দাস, পরমান্দ অধিকারী, কাঙ্গাল হরিনাথ, মনোমহন বসু, ব্রজেন্দ্র কুমার দে, মীর মোশারফ হোসেন প্রমুখ বিখ্যাতজনও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মীর মোশারফ হোসেন রচনা করেন বেহুলা যাত্রাপালা। সে সময় বিষাদ সিন্ধুর কাহিনী নিয়ে গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হতো। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন রচনা করেন ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। এখন আধুনিক শহুরে লোকজন যাত্রাশিল্পকে মনে করেন অছুৎ। কোন সাহিত্যিককে আর দেখা যায় না নতুন কোন পালা রচনা করতে। করবেনই বা কি করে। যেখানে দলই নেই। নাটরের যাত্রা শিল্পী শেফালী রানী বলেন ২০১০ সালে দল ছেড়ে দিয়েছি। আমরা দলে ৪০-৫০ জন কাজ করতাম। পালা না হলে এতগুলো মানুষ দিনের পর দিন বসে থাকবে কি করে? জীবন তো বসে থাকে না। তাই আমরা যে যার মতো অন্য পথ বেছে নিয়েছি। যাত্রায় আমরা রাজা রানীর পাট করতাম। আমাদের জীবনও ছিল ও রকমই। এখন সেই রাজা রানী সেনাপতিরা মানুষের বাড়িতে কাজ করি, কেউ দিনমজুর। কেউ আবার রিক্সাভ্যান চালায়। প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েও দেশ মাটিকে ভালবেসে হোক, জীবন বাঁচানোর কঠিন সংগ্রামে হোক এখনও প্রায় নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো কিছু দল টিকে আছে। তার মধ্যে যশোরের চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্য সংস্থা, আনন্দ অপেরা, মাগুরার চৈতালী অপেরা, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায়, কোহিনূর অপেরা, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজ মহল অপেরা, রঙ্গমহল অপেরা, দেশ অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট। বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট প্রভৃতি। তার পরও এসব দল নিয়মিত পালা মঞ্চায়ন করতে পারে না এখন। অনিয়মিতভাবে প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং উগ্র মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কদাচিৎ কোথাও কোথাও বেজে উঠে কমলার বনবাস পালার কমলার সেই করুণ আর্তনাদ। দলগুলো এখনও যে পালাগুলো ধরে রেখেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রুপবান রহিম বাদশা, গুনাইবিবি, কমলার বনবাস, কাজলরেখা, মাইকেল মধুসুদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা মা মাটি মানুষ, লালন ফকির, দাতা হাতেম তাই, বাংলার মহানায়ক, এই দেশ এই মাটি, নবাব সিরাজউদদৌলা উল্লেখযোগ্য। এত জনপ্রিয় এ শিল্পধারাকে আজ অশ্লীলতার ধুয়া তুলে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। অথচ যাত্রা সূচনা লগ্নে জনমনে নির্মল আনন্দের খোরাক হিসেবে অবিভূত হয়েছিল। এর সুর সংলাপ ও মননে মানুষের মনের ব্যথা, দুঃখ, বঞ্চনা, দেশপ্রেম মানবিকতার যে বীজ আরোপিত হতো সেটা বিলীন হলো কোথায়? আমাদের আত্মার, আমাদের শেকড়ের এই শিল্পের গায়ে কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দিল কারা? শ্রদ্ধেয় মিলন কান্তি দে, জ্যোৎস্না বিশ্বাসসহ প্রমুখ বিখ্যাতজন মনে করেন অন্যসব অভিযোগের চেয়ে অশ্লীলতাই আমাদের এই শিল্পকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। যেখানে বিশ্বায়নের এই যুগে হাতের মোবাইলের এক বাটনের চাপে বলিউডের মহা মহা নতর্কীদের প্রায় উদোম নৃত্যে ভেসে আসে নিমেশেই সেখানে আমাদের এই প্রাচীন শিল্পটাও কি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক কিছুটা চাকচিক্যের দাবি ধারণ করতে পারে না? সেই চাওয়াটা কি একেবারেই অযৌক্তিক? আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পটাকেও ঠিক একইভাবে অশ্লীলতার কাদা মাখিয়ে বস্তা পরিয়ে রেখে মৃত্যুর সামনে নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। এখন শুধু শেষ পেরেকটা বসানো বাকি। ঠিক তেমনি যাত্রাশিল্পটাও একটা মহলের সুদূর প্রবাসী ষড়যন্ত্রের শিকারে আজ প্রায় নিঃশেষই বলা যায়। তার পরও আমাদের মনে আশার প্রদীপটা জ্বলে মিটিমিটি। কিন্তু সেই প্রদীপের সলতেতে তেল দেয়ার মতোই কেউ নেই।
×