ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁচানো গেল না নুসরাতকে

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১১ এপ্রিল ২০১৯

বাঁচানো গেল না নুসরাতকে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবিক মানুষের সকল প্রার্থনা ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেলেন নুসরাত। শত কান্নাও ফেরাতে পারল না তাকে। যেন চির মুক্তির আশায় রণে ভঙ্গ দিলেন তিনি। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদটুকু জানিয়ে গেলেন। যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদের কারণে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া ফেনীর এই মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফী বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্নালিল্লাহে...রাজিউন)। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢামেক বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসক অধ্যাপক রায়হানা আওয়াল। অগ্নিদগ্ধ ওই মাদ্রাসাছাত্রী ঢামেক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার শরীরের ৮০ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েটির ফুসফুসকে সক্রিয় করতে মঙ্গলবার অস্ত্রোপচার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোক বার্তায় তিনি নুসরাতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নুসরাতের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত এ বছর আলিম পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে গত মার্চে সোনাগাজী থানায় একটি মামলা করে নুসরাতের পরিবার। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের অনুসারীরা গত শনিবার পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখান থেকে ফেনী সদর হাসপাতালে এবং পরে শনিবার রাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাতের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সোমবার তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। সোমবারই তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা মেডিক্যালের চিকিৎসকরা নুসরাতের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল রিপোর্ট পাঠানোর পর ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয় তাদের। এই অবস্থায় নুসরাতকে না পাঠানোর পক্ষে মত দেন সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা। নুসরাতের শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের। রোগীর যে শারীরিক অবস্থা, তাতে সিঙ্গাপুরে নেয়ার জন্য ৫ ঘণ্টা এয়ার জার্নি করার মতো অবস্থা তার নাই। নুসরাত ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীতে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, গত শনিবার সকালে ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রে আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বোরকা পরা চার নারী তাকে মামলা তুলে নিতে বলে। তাতে রাজি না হওয়ায় ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। জবানবন্দীতে নুসরাত বলেন, বোরকায় মুখ ঢাকা থাকায় ওই চারজনের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। তবে এক পর্যায়ে তাদের একজন আরেকজনকে শম্পা নামে ডেকেছে, সেটা তার মনে আছে। নুসরাতের ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বলেন, বুধবার সকালে আমি ও আমার মা ওকে আইসিইউতে দেখতে যাই। ও আমাকে বলে, ভাই আমার যা কিছু হয় হয়ে যাক প্রিন্সিপাল সিরাজ উদদৌলা ও তার সহযোগী যারা আমার গায়ে আগুন দিয়েছে তাদের যেন বিচার হয়। ভাই, ভাই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বাঁচাও, আমার যদি এখানে চিকিৎসা ঠিক মতো না হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমাকে দেশের বাইরে নিয়ে চলো। রায়হান বলেন, এ কথাগুলো বলার সময় ওর শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। এরপর আর কোন কথা বলতে পারেনি, ওকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। রায়হান আরও বলেন, এর আগে সে আমাকে জানায়, যারা তার গায়ে আগুন দেয় তাদের ওর পরিচিত মনে হয়েছে, কিন্তু চিনতে পারেনি। প্রতিদিন আমার বোনের সঙ্গে আমার বড় ভাই নোমান তাকে মাদ্রাসায় রেখে আসে। সেদিন মাদ্রাসার পিয়ন মোস্তফা আমার বড় ভাইকে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেয়নি। সেও এ ঘটনায় জড়িত। তাকেও বিচারের আওতায় আনা হোক। নুসরাতের সঙ্গে কথা বলে তার মামা মোঃ সেলিম বলেন, আমি ওকে বার বার জিজ্ঞেস করেছি বল কে তোর গায়ে আগুন দিয়েছে? উত্তরে সে আমাকে বলে, মামা তাদের কণ্ঠটা আমার চেনা, আমার কাছের (পরিচিত) মানুষ, হাতটা ফর্সা। চেহারাটা মনে করতে পারছি না। আজ সকালেও তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি চেহারা বলতে পারে নাই। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ দশজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিষয়ে সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন বলেন, জবানবন্দীতে নাম আসা শম্পাকে খুঁজতে গিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নুসরাতের সহপাঠী পপিকে আটক করা হয়েছে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আছে কি না এবং এ ঘটনায় জড়িতদের সন্ধান পেতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, শ্লীলতাহানির মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিচারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে তাতে বাধা দিয়েছিলেন পপি। অধ্যক্ষের পক্ষে মানববন্ধনেও তাকে দেখা যায়। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান যে মামলা করেছেন, সেখানে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আসামির তালিকায় নাম থাকা বাকি সাতজন হলেন- পৌর কাউন্সিলর মাকসুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, সাবেক ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নূর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের। এদের মধ্যে জোবায়েরকেও মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সময় হাতমোজা, চশমা ও বোরকা পরিহিত আরও চারজনকে আসামি করা হয়েছে এ মামলায়। আসামি গ্রেফতারে গড়িমসি এবং কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ সেখানকার পুলিশ সদস্যদের অপসারণের দাবি তুলেছিলেন স্থানীয়রা। এই প্রেক্ষাপটে মোয়াজ্জেমকে থানার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে। আর নুসরাতকে হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্তভার থানার হাত থেকে দেয়া হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। এদিকে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সেই সঙ্গে ওই মাদ্রাসার প্রভাষক আফসার উদ্দিন ও আরিফুল ইসলামকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। পুলিশের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরীফ উদ্দিন আহমেদ বুধবার এ আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন বলেন, গ্রেফতার ওই তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। শুনানি শেষে বিচারক সিরাজ উদদৌলাকে সাত দিন এবং বাকি দুজনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। এ ছাড়া মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি জোবায়ের আহমেদ এবং সন্দেহভাজন হিসেবে আটক সিরাজ উদদৌলার ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপিকেও সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। আদালত এখনও তাদের রিমান্ড শুনানির তারিখ দেয়নি বলে পরিদর্শক কামাল হোসেন জানান। জানা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার মারা যাওয়া ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকালে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বুধবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, রাতে নুসরাতের মরদেহ হিমঘরে রাখা হবে। সকালে মরদেহের ময়নাতদন্ত করে পুলিশ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করবে।
×