ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বসল দশম স্প্যান

পদ্মা সেতুর ১৫শ’ মিটার দৃশ্যমান

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ১১ এপ্রিল ২০১৯

পদ্মা সেতুর ১৫শ’ মিটার দৃশ্যমান

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ চৈত্রের ভর দুপুর। রোদে তেজ নেই। পদ্মায় নতুন টলটলে পানিতে ঢেউ আছে। পদ্মার চরের ফসলের মাঠগুলো ঘন সবুজ, সতেজ। চারদিকে নির্মল পরিবেশ। এরই মধ্যে মূল পদ্মায় বসে গেল বিশাল ¯প্যান। ১৫০ মিটার দীর্ঘ ফোর লেনের ৩ হাজার ২৪০ টন ওজনের এই স্টিলের ¯প্যান এত সহজে দু’খুঁটির ওপর এত স্মুথলি বসতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ১২টা। তখন এক সংবাদকর্মী আপন মনে গেয়ে ওঠেন স্টেশনের রেল গাড়িটা মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা...।’ এর আগে ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজ ওয়ার্কশপের জেটি থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেয় খুঁটিতে। এভাবেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হলো দেড় কিলোমিটারে। স্প্যান সংখ্যা দু’অঙ্কে গড়াল। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। বাঙালীর বীরত্বের জৌলুস আরও ছড়িয়ে পড়ল। বুধবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ১৩ ও ১৪ নম্বর পিলারের ওপর দশম স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) বসানো হলো। এর মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো সেতুর দেড় কিলোমিটার (১৫০০ মিটার) আবকাঠামো। এটি সেতুর সবচেয়ে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং স্প্যান বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। দুপুর সাড়ে ১২টায় সেতুর মাওয়া প্রান্তের ১৩ ও ১৪ নং খুঁটির ওপর ৩নং মডিউলের ‘৩-এ’ নম্বর স্প্যানটি বসানো হয়। এটি মাওয়া প্রান্তে দ্বিতীয় স্প্যান। বহু প্রতীক্ষার পর বুধবার মাওয়া প্রান্তে এ স্প্যানটি বসানো হলো। যদিও পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসানোর কথা ছিল মাওয়া প্রান্তে। কিন্তু নদীর তলদেশের মাটি নরম থাকায় এ পারের কাজ পরে ধরা হয়। আগে তাই জাজিরায় কাজ শুরু হয়। একে একে জাজিরায় ৮টি স্প্যান বসানো হয়েছে। এবার স্থায়ীভাবে স্প্যান বসতে যাচ্ছে মাওয়ায়। তাই পদ্মার এ পারের মানুষ বেজায় খুশি। এর আগে অস্থায়ীভাবে মাওয়া প্রান্তে ৪ ও ৫ নম্বর খুঁটিতে একটি স্প্যান বসানো হয়। ৬ ও ৭ নম্বর খুঁটিতে এটি বসানোর কথা ছিল। কিন্তু ৬ ও ৭ নং খুঁটি প্রস্তুত না থাকায় অস্থায়ীভাবে এটি ৪ ও ৫ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয়েছে। পরবর্তীতে ৬ ও ৭ নম্বর খুঁটি প্রস্তুত হবার পর এটি সরিয়ে নেয়া হবে। বুধবার সকাল ৮টা ৩২ মিনিটের দিকে মাওয়া কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ধূসর রংয়ের ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ও ৩ হাজার ১৪০ টন ওজনের স্প্যানকে তিন হাজার ৬০০ টন ধারণ ক্ষমতার তিয়ান-ই ভাসমান ক্রেনটি বহন করে নিয়ে রওয়ানা করে। এবং স্পটে পৌঁছে সকাল ৯টা ২৮ মিনিটের দিকে। নবম স্প্যান বসানোর ১৯ দিনের মাথায় বসানো হলো দশম স্প্যানটি। পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী জানান, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ১৩ ও ১৪ নং খুঁটির দূরত্ব কম হওয়ায় বুধবার সকালে স্প্যানটি নিয়ে রওনা দেয়া ভাসমান ক্রেন তিয়ান-ই। দুপুরের মধ্যেই বসানো সম্ভব হয় স্প্যানটি। জাজিরা প্রান্তে স্প্যান বসানোর ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণে একদিন আগেই রওয়ানা দিতে হয় স্প্যান নিয়ে। তবে এবার অন্যান্য স্প্যান বসানোর সময়ের হিসাবে খুব কম সময়েই এটি বসানো সম্ভব হলো। যদিও আবহাওয়া খারাপের কারণে একটুু বিলম্ব হয় রওয়ানা দিতে। প্রকৌশলী আরও জানান, মূল সেতুর ২৯৪ পাইলের মধ্যে ইতোমধ্যে ২৪৭ পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। এসব খুঁটির ওপরে ৪১টি ¯প্যান বসানো হবে। ইতোমধ্যেই ১০টি স্প্যান বসে গেছে। ৪২ খুঁটির মধ্যে ২২ খুঁটির নির্মাণ পুরোপুরি হয়ে গেছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে আরও ১০ খুঁটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি বলেন পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের পিয়ার-৬ ও ৭ এবং ১৩ ও ১৪ এর কাজটি সবচেয়ে বেশি কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে প্রথম পর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়া ৬ ও ৭ নম্বর খুঁটির পাইল অবশেষে শেষ হতে যাচ্ছে কাল বৃহস্পতিবার। ৭ নম্বর খুঁটিতে ৭টি পাইলই স্থাপন হয়ে গেছে। এর মধ্যে চারটি ট্যাম (খাঁজকাটা) পাইল। আর ৬ নম্বর খুঁটির ৬ ছয়টি পাইলই সম্পন্ন হয়েছে। বাকি একটি পাইলও সম্পন্ন হওয়ার পথে। বাকি অংশটুকু কাল বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে। ৬ ও ৭ এবং ১৩ ও ১৪ নম্বর এ দুটি জটিল পিয়ারসহ পিয়ার উঠানোর সমাধান বের করতে প্রায় এক বছর কাজ পিছিয়েছিল। তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর ১০টি স্প্যান স্থায়ীভাবে বসানো হয়েছে এবং জাজিরা প্রান্তে ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২ পিয়ারে ৮ এবং মাওয়া প্রান্তে ৪ ও ৫ নম্বর ও ১৩ ও ১৪ নম্বর ২তে স্প্যান বসানো হয়েছে। সে হিসেবে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর ১২০০ মিটার এবং মওয়া প্রান্তে ৩০০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে। মোট ১৫০০ মিটার দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু। তবে মাওয়া প্রান্তে অস্থায়ী স্প্যান (স্প্যান ১-এফ) রাখা আছে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারে। এটি মূলত বসানো হবে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে। কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে জায়গা না থাকায় স্প্যানটি ৪ ও ৫ নম্বর পিলারে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়। পদ্মা সেতুর ২৯৪ পাইলে মোট ৪২ পিলারে ৪১ স্প্যান বসানো হবে। এখন স্প্যান বসানো বাকি রয়েছে ৩১। এদিকে আগামী ২০ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তে ১১তম স্প্যান বসানোর কথা রয়েছে। সেতুর ৩৪ ও ৩৩ নম্বর খুঁটির ওপর বসবে ‘৬সি’ নম্বর এই স্প্যানটি। এর পরিকল্পনাও এখন চূড়ান্ত। ৩৪ নম্বর খুঁটিতে লেফটিং ফ্রেম (স্প্যান ঝুলিয়ে রাখার যন্ত্র) বসানো হচ্ছে এখন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজ শুরু হয় পদ্মাসেতুর। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো।
×